Advertisement
E-Paper

মধ্য এশিয়ার অর্থই অনর্থ ঘটাচ্ছে বাংলাদেশে!

সেই বাংলাদেশ কেন হালে বার বার রক্তাক্ত হচ্ছে? কেন সন্ত্রাসে উত্তরোত্তর দীর্ণ হয়ে উঠছে ‘আমার সোনার বাংলা’? উত্তর খুঁজলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশিষ্ট অ্ধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী।

সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৬ ১৫:৩৪

পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ। ভারতও।

সন্ত্রাসে উত্তরোত্তর দীর্ণ হচ্ছে এই উপমহাদেশ। দিকে দিকে বাড়ছে হিংসার ঘটনা। হিংসা-সন্ত্রাসের ভৌগোলিক বিস্তার ঘটছে খুব দ্রুত। পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের ঘটনাবলীর সঙ্গে আমরা দীর্ঘ দিন ধরেই পরিচিত। কিন্তু ঘরের পাশের বাংলাদেশকে যে ভাবে উত্তরোত্তর রক্তাক্ত হয়ে উঠতে দেখছি আমরা, তা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। বাংলাদেশ যে আমাদের এতটা ভাবায়, তার অন্যতম কারণ একটাই। সেটা হল- খণ্ডিত জাতিসত্তার একটি আপাত-অদৃশ্য অখণ্ড রূপ। ভ্রাতৃত্ববোধ। বাংলাদেশ যেন আমাদের ‘আত্মার আত্মীয়’।

সেই বাংলাদেশ কেন হালে বার বার রক্তাক্ত হচ্ছে? কেন সন্ত্রাসে উত্তরোত্তর দীর্ণ হয়ে উঠছে ‘আমার সোনার বাংলা’?

কোনও এক ‘সোনার হরিণ’ই কি তার ‘মায়া’য় ভুলিয়ে উত্তরোত্তর রক্তাক্ত করে তুলছে বাংলাদেশকে? যদি শুধু অর্থের মানদণ্ডই হয় দেশের সমৃদ্ধির এক ও একমাত্র পরিমাপক, তা হলে সেই সমৃদ্ধি যে আক্ষরিক অর্থেই ‘সোনার হরিণ’ হয়ে ওঠে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেন সেটাই বার বার প্রমাণিত হচ্ছে।

গোটা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থাও হয়ে পড়েছে পুঁজিকেন্দ্রিক। পুঁজির যাবতীয় ‘রূপটান’ লেগেছে, লেগে চলেছে বাংলাদেশের শরীরে। পুঁজি যেমন দেয় বিস্তর যাচাই-বিচার করে, তেমনই অনেক কিছু নিয়ে নেয় নির্বিচারে। যাঁদের তেমন শিক্ষা-দীক্ষা ছিল না, আয়েশ করে গায়েগতরে বেঁচে থাকার জন্য যাঁদের তেমন জমি-জোতও ছিল না, সেই সব বাংলাদেশি রুটি-রুজির টানে আরও বেশি সংখ্যায় পাড়ি দিচ্ছেন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে। সেখানে তাঁরা কাজ করছেন। জড়িয়ে পড়ছেন এক বা একাধিক পেশায়। রোজগারও করছেন তাঁরা প্রচুর পরিমাণে। ঢাকায় বা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা তাঁদের আত্মীয়-পরিজনের কাছে তাঁরা প্রচুর পরিমাণে অর্থ পাঠাচ্ছেন। তাতে শিক্ষা না থাকলেও তাঁদের পরিবারগুলো তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। হু হু করে বিদেশি মুদ্রা ঢুকছে বাংলাদেশে। তাতে আর্থিক ভাবে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় বাড়ছে। আর ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে সমাজের একাংশের। ফলে, আরও বেশি করে দামি বিদেশি ভোগ্যপণ্য বাংলাদেশের বাজারে ঢুকছে। কারণ, সেগুলো কেনার মতো ক্ষমতা বেড়ে গিয়েছে মানুষের। পুঁজির বিকাশের স্বাভাবিক নিয়মে।

কিন্তু মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে কাজ করতে গিয়ে প্রচুর রোজগার করছেন যে বাংলাদেশিরা আর সেখান থেকে পাঠানো অর্থে তাঁদের পরিবারদের সমৃদ্ধ করে তুলছেন, তাঁরা কিন্তু নিজেরা দ্রুত আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন ওই দেশগুলোর স্বাভাবিক ‘আফিমের নেশা’ ধর্মীয় উন্মাদনায়, বাড়াবাড়িতে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা বা অল্প শিক্ষার জন্যই এটা হচ্ছে। তাঁরা মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর কড়া ‘ডোজ’-এর মৌলবাদে আকৃষ্ট হচ্ছেন। আর যে বাংলাদেশিরা রুটি-রুজির টানে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে যাচ্ছেন, শিক্ষা, বংশ পরিচয়, সামাজিক কৌলিন্য তাঁদের তেমন নেই বলে (যাকে ‘সোশ্যাল ক্যাপিটাল’ বলা হয়) তাঁরা চট করে ওই ‘সোনার হরিণ’-এর টানে মজে গিয়ে ওই ধর্মীয় ‘আফিম’-এর নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ছেন। তাঁদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে ওই ‘আফিমের নেশা’ (মৌলবাদ) আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ওই বাংলাদেশিরা শিকড়ের টানে কিছু দিনের জন্য দেশে ফিরে এসে আবার ফিরে যাচ্ছেন আরবের ওই দেশগুলোতে। কিন্তু যখন ফিরছেন, থাকছেন কিছু দিন বাংলাদেশে, তখন হঠাৎ করেই আর্থিক ভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন বলে তাঁরা যেটা প্রত্যাশা করছেন, সেই সম্মান পাচ্ছেন না। তাঁদের সামাজিক প্রতিপত্তিও হচ্ছে না। আর সেটাই তাঁদের উত্তরোত্তর বিক্ষুব্ধ করে তুলছে। প্রতিবাদী করে তুলছে। সমাজের চলতি সব কিছুকেই ভেঙেচুরে দিতে প্ররোচিত করছে। আর তার জন্য হিংসা, সন্ত্রাসে উৎসাহিত করছে।

আরও পড়ুন- ‘শুধুই গুলির শব্দ, জানালার কাচ ভেঙে গেল ঝনঝন করে’

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সুদীর্ঘ সীমান্ত থাকায় ভারতেও ওই সন্ত্রাসের ভৌগোলিক বিস্তৃতি ঘটছে। সরাসরি বা পরোক্ষে। মানতেই হবে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর আওয়ামি লিগ সরকারের চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই তার মোকাবিলায়। ভারতও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করেনি। কিন্তু আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আরও একটু সতর্ক হওয়া উচিত হাসিনা সরকারকে। যাতে আগামী দিনে হিংসা, সন্ত্রাসের দিকে বাংলাদেশি যুব সমাজের বিপথগামী হওয়ার প্রবণতা কমানো যায়।

’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে যে ভাবে আদালতের নির্দেশের মাধ্যমে একের পর এক যুদ্ধাপরাধীকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হচ্ছে আর সে সব দ্রুত কার্যকর করা হচ্ছে, তাতে আমার মনে হয়, বাংলাদেশি যুব সমাজের কাছে এই বার্তা যাচ্ছে যে, হাসিনা সরকার প্রতিশোধস্পৃহায় ভুগছেন। তাঁরা এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন যদি কোনও আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হত বা বাংলাদেশি আদালতে ওই মামলাগুলোয় যদি অন্তত এক জন বিদেশি বিচারপতি রাখা যেত। কেন বলছি এ কথা? কারণ, দেখেছি, ‘হুজি’ নেতাদের প্রাণদণ্ডাদেশ ও তা কার্যকর হওয়ার পর তেমন অসন্তোষ বাংলাদেশের কোথাও দেখিনি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যতই কম হোক, বাংলাদেশে জামাতে ইসলামির মতো মৌলবাদী দলগুলোর কিন্তু গণভিত্তি রয়েছে। ফলে তাদের নেতাদের একের পর এক প্রাণদণ্ডাদেশ দেওয়া হলে বা তা কার্যকর করা হলে সমাজে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে (যারা স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী) একটু অন্য রকম ধারণা হবে না, এ কথা সুনিশ্চিত ভাবে বলা যায় না।

middle east money in bangladesh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy