২০টি দেশের ১৫০ জন শিক্ষার্থী। প্রশস্ত গ্যালারিতে প্রথম লেকচার ক্লাস। ভাষাতত্ত্বের উপর ক্লাস নিচ্ছিলেন অধ্যাপক গেওর্গি পাভলোভিচ। আমি বসেছি গ্যালারির একেবারে শেষদিকে। সদ্য ভাষাশিক্ষার প্রস্তুতিপর্বের পর প্রথম বর্ষে উঠেছি। রুশ ভাষায় ক্লাস হয়। কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না।
ইন্দো–ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী নিয়ে আলোচনা শুরু করে গেওর্গি পাভলোভিচ অনেকটা পড়িয়ে হঠাৎ বললেন, ‘তোমাদের বলে রাখি, একটি দেশ ভাষার প্রশ্নে লড়াই করেছিল এবং সে লড়াইকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। ভাষার প্রশ্নে রক্ত দিয়ে দেশ নির্মাণ করার উদাহরণ পৃথিবীতে একটাই। যে দেশটিকে নিয়ে কথা হচ্ছে সেটি হল— এটুকু বলে একটু থামলেন তিনি। তার পর কণ্ঠটা অনেক বাড়িয়ে দিয়ে টেনে টেনে বললেন, ‘বা–ং–লা–দে–শ।’
আর তার পর গোটা ক্লাসের সকল চোখ ঘুরে গেল আমার দিকে। আমার শরীর তখন কাঁপছে। নিয়ন্ত্রণ নেই নিজের ওপর! আমার প্রতি সবার দৃষ্টি আমাকে যেন কুঁকড়ে দিচ্ছে। কিন্তু হৃদয় ভরে গেছে গর্বে।
গেওর্গি পাভলোভিচ বললেন, ‘কিছু একটা বলো।’
আমি কয়েক বার চেষ্টা করলাম কথা বলতে। কিন্তু কী যেন গলায় দলা পাকিয়ে আছে। একেবারেই কথা বলতে পারছি না আমি। তার পর এক সময় ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রাসনাদার শহরে এতগুলো মানুষের ভালবাসা পেয়ে আমি তখন বিমোহিত! এই ভালবাসা পেয়েছিলাম ভাষার প্রশ্নে আমাদের সংগ্রামের কারণে, সে কথা ভুলতে পারি না। দেশের জন্য ভালবাসা যে চোখের জল হয়ে বের হতে পারে, সে অভিজ্ঞতা আমার সেই প্রথম। এটা ১৯৮৭ সালের ঘটনা।
২
ভারতবর্ষ ভাগ হল সাতচল্লিশে। সেও ধর্মের ভিত্তিতে। মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে বাংলা যখন পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেল, তখনও কেউ বুঝতে পারেনি কী বিপদ আসছে সামনে। ধাক্কাটা দিলেন জিন্না স্বয়ং। তিনি ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় এসে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আর ২৪ মার্চ কার্জন হলে যে দু’টি ভাষণ দিলেন, তাতে ষ্পষ্ট করে জানালেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। দেশভাগের আগে–পরে যে জিন্না ছিলেন বাঙালির নয়নের মণি, তিনি তাঁর এই দুই ভাষণে যুক্তিহীন রূঢ়তার কারণে বাঙালি মন থেকে নির্বাসিত হলেন চিরতরে।
অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কখনও তীব্র, কখনও শিথিল ভাবে চলছিল আন্দোলন। বাহান্ন’র ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ভাষা নিয়ে জিন্নার কথারই পুনরাবৃত্তি করলে ওই আন্দোলনের বারুদে আগুন ধরে যায়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হবে— এ কথা জোর দিয়ে বলেছিলেন নাজিমুদ্দিন। তার এই কথার কারণেই সংগঠিত হয়ে উঠল ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা আন্দোলন। ৪ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ কর্মসূচি ও মিছিলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। সিদ্ধান্ত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল, ধর্মঘট, মিছিল-সহ আইন পরিষদ ঘেরাওয়ের। ইতিহাস তার অনিবার্য পথে এ ভাবেই যাত্রা শুরু করে।
২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের যে বৈঠকটি হয়েছিল আওয়ামি মুসলিম লিগের নবাবপুর রোডের অফিসে, সেখানে ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তখন জ্বলছেন। এই সিদ্ধান্ত কেউ মানবেন না, তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকেই। এর পরই তো আমতলার বৈঠক, আবদুল মতিনের জ্বালাময়ী ভাষণ, ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে সভাপতি গাজিউল হকের বক্তৃতা রচনা করল অন্য এক ইতিহাস।
সে দিন পরিষদ সভা ছিল। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা থেকে শিক্ষার্থীদের সমাবেশ চলে আসে মেডিক্যাল কলেজের সামনে। পরিষদ সদস্যদের দেখা পেলেই শিক্ষার্থীরা ঘিরে ধরে, উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার দাবি জানায়। সে সময়েই চলে গুলি। শহিদ হন রফিক, বরকত, জব্বার। এর পর সারা বাংলা জেগে ওঠে। রাজপথে শুধু মিছিল আর মিছিল।
৩
বাঙালি, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান যেন ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মপরিচয় নিয়ে ভাবতে শুরু করে। বাঙালি বুঝতে শেখে, ভাষা ও সংস্কৃতিতেই আত্মপরিচয়ের হদিস মিলবে। সেই থেকে একাত্তর পর্যন্ত দীর্ঘ সময়টাতে সেই আত্মপরিচয়ই খোঁজা হয়েছে। এখনও চলছে তার সুলুক সন্ধান।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকেই প্রভাতফেরি যেন হয়ে ওঠে মুক্তির কাফেলা। সরকারের রবীন্দ্রবিরোধিতা বাঙালির জাতিচেতনাকে আরও সংহত করে। ছায়ানট, ক্রান্তি-সহ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ‘বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন’, তাদের এক করার চেষ্টা করে যায়। শহিদদের রক্তঋণ শোধ করার অঙ্গীকার দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি বদলে দেয় বাংলার ইতিহাস, বাংলাদেশের মানচিত্র।
৪
অর্জনের কি শেষ আছে?
১৯৫৩ সালেই বের হয় একুশের প্রথম সংকলন, প্রথম সাহিত্যিক দলিল। হাসাস হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় এই সংকলনের প্রকাশক ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী এই অমিততেজ তরুণদের প্রত্যেকেই পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক হয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউজ ১৯৫৫ সালে পরিণত হয় বাংলা অ্যাকাডেমিতে। ১৯৫৬ সালেই বাংলা ভাষা হয় পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাহী আদেশে অফিস–আদালত-সহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জোয়ার আসে। আদালতের দৈনিক শুনানির তালিকাও বাংলায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষার প্রচলন আইন প্রবর্তিত হলে বাংলাদেশ সরকার যে সব আইন, বিধিবিধান, পরিপত্র, বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি প্রকাশ করছে, তা বাংলায় প্রকাশ অব্যাহত আছে (কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ইংরেজি প্রীতি)।
দোকানপাটের নামে, গাড়ির নম্বরে এখন বাংলা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গঠিত হয়েছে। বাংলাপিডিয়া নামে প্রকাশিত হয়েছে আকরগ্রন্থ। আঞ্চলিক ভাষার অভিধান-সহ বাংলা ভাষায় নানা অভিধান প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক শিক্ষা–সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। রক্ত–স্বেদ–শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই দিনটি এখন সারা বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস। আর সিয়েরা লিওন নামে আফ্রিকার দেশটি ২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর নিজের ভাষার পাশাপাশি বাংলাকে তাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
৫
অর্জনের পাশাপাশি মুদ্রার অন্যপাশটাও দেখতে হবে। এরই মাঝে একটা দারুণ ব্যাপার ঘটে আমাদের দেশে। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই যেন মিডিয়ার টনক নড়ে। হঠাৎ করে সবাই বলতে শুরু করে, আরে! ভাষা রক্ষার জন্য কী যেন করার ছিল! কী যেন ছিল অঙ্গীকার! আর নানা ধরনের আক্ষেপের ঢেউ এসে লাগে অনলাইন, প্রিন্ট ও টেলিভিশন–রেডিওর শরীরে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা শহিদ মিনারগুলোর শুশ্রুষা শুরু হয়। মাসব্যাপী হয় বইমেলা। যে প্রকাশকেরা সারা বছর দিয়েছেন কুম্ভকর্ণ ঘুম, তারা এ সময় চোখ মেলে আড়মোড়া ভাঙেন, ভাল–মন্দ বিচার না করেই প্রকাশ করতে থাকেন একের পর এক বই। কে কটা ভাল বই ছাপলেন, সেটা নিয়ে কথা হয় না, কে কটা বই ছাপলেন, তা নিয়েই পাড়া সরগরম। প্রতি বছরই এ সময়টিতে নিয়ম করে বলা হয় সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের কথা, বিচারিক আদালতের রায়ে এখনও বাংলা কেন যথাযোগ্য মর্যাদা পাচ্ছে না, তা নিয়ে থাকে প্রতিবেদন। ফেব্রুয়ারি চলে যায়, তখন আবার পরবর্তী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সবাই ঘুমানোর জন্য তৈরি হয়। এই তো চলে আসছে বছরের পর বছর।
আর একটা কথা না বললেই নয়। ইংরেজি, বাংলা আর মাদ্রাসা শিক্ষা— এই তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। এটা কোনও কাজের কথা নয়। যাঁরা ভিন্ন ভাবে এই তিন মাধ্যমে পড়ছেন, তাঁদের তিন ধরনের মানসিক গড়ন, যার মধ্যে মিলনের পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাটা ঠিক ভাবে শিখে তার পর অন্য ভাষার কাছে যাওয়া হয়ে উঠছে না। বরং কেউ ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পারলেই সমাজে কদর বেশি। ভুলে যাই আমরা, ফরাসি, রুশ, চিনা, জাপানিরা কিন্তু নিজেদের ভাষাকেই এগিয়ে রেখেছে, এর পর দ্বিতীয় ভাষা। এ জায়গায় আমরা নিজের ভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে পারিনি।
৬
বাহান্নর পথ ধরে এই ভূখণ্ডে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র তৈরি করে নিয়েছে বাঙালি।
মুক্তিযুদ্ধের পর নিজ সংস্কৃতি চর্চা বেড়েছে এবং বাড়ছে প্রতি বছর। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের পথ ধরে নতুন কবিরা এসেছেন এবং পাঠকেরা তাঁদের পড়ছেন। মঞ্চনাটকে হয়েছে নানা ধরনের নিরীক্ষা। সংস্কৃতির প্রতিটি অঙ্গেই লেগেছে পরিশ্রম ও চর্চার পরশ।
তাই, এই দিনটি এলে মন ভাল হয়ে যায়।
হ্যাঁ, ভাষার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটাই তো জন্ম দিয়েছে একটি নতুন দেশ।
সেই নতুন দেশের মানুষ বিশ্বমানব হওয়ার জন্য কায়মনে বাঙালি হওয়ার চেষ্টাও করে যাচ্ছে। আর হ্যাঁ, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই পংক্তিটির প্রতি বিশ্বস্ত থাকারও চেষ্টা করছে।
(জাহীদ রেজা নূর সাংবাদিক ও লেখক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy