Advertisement
E-Paper

কুলীন হওয়ার দৌড়ে এতদিনের ব্রাত্য বাংলা

বোতল বিক্রির বাজার দখলে ‘বিদেশি দৈত্য’দের হারিয়ে জয় এখন বামনেরই! নামে-ভারে-বিপণনে বরাবর বহু যোজন এগিয়ে থাকা বিদেশি সুরাকে পিছনে ফেলে এ রাজ্যে দ্রুত বাজারের দখল বাড়াচ্ছে দেশি মদ।

গার্গী গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৫ ০৩:০৫

বোতল বিক্রির বাজার দখলে ‘বিদেশি দৈত্য’দের হারিয়ে জয় এখন বামনেরই!

নামে-ভারে-বিপণনে বরাবর বহু যোজন এগিয়ে থাকা বিদেশি সুরাকে পিছনে ফেলে এ রাজ্যে দ্রুত বাজারের দখল বাড়াচ্ছে দেশি মদ। হুইস্কি, ভদকা, জিন, রাম-এর মতো ভারতে তৈরি বিদেশি মদের (ইন্ডিয়া মেড ফরেন লিকার বা আইএমএফএল) বিক্রি যেখানে ১৭ শতাংশ কমেছে, সেখানে দেশি বা বাংলা মদের বিক্রি বেড়েছে ২০ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, আবগারি রাজস্বের সিংহভাগই আসছে তুলনায় সস্তার বাংলা মদ থেকে। ২০১৪-’১৫ অর্থবর্ষে সেই অঙ্ক ছুঁয়েছে ৩,৬০০ কোটি টাকা।

শহুরে সামাজিকতায় বাংলা মদ বরাবরই ব্রাত্য। তার পরিচিতি বরং খালাসিটোলা বা বারদুয়ারির নিম্নবিত্ত মানুষের পছন্দ হিসেবে। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরে প্রান্তিক মানুষের গলা ভেজানোর উপকরণ হিসেবেই তা চিরকাল চিহ্নিত। সস্তার উপকরণে তৈরি হওয়ায় তার উগ্র গন্ধ আর সেই সঙ্গে বিপণনের অভাব কোনও দিনই ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে দেয়নি এই পানীয়কে। কিন্তু গত এক-দেড় বছর ধরে এই ছবি দ্রুত বদলাচ্ছে। এখনও চিনের মাও তাই কিংবা কোরিয়ার সোজুর মতো ‘জাতে উঠতে’ না-পারলেও দেশি মদের বিক্রি বেড়েছে বহুগুণ। সরকারি নীতির দৌলতে বিদেশি মদের দোকানের তাকে জায়গা পাওয়া যেমন এর কারণ, তেমনই এর পিছনে রয়েছে উন্নততর পানীয়, প্যাকেজিং আর বিপণন কৌশলও।

সরকারের নতুন আবগারি নীতির দৌলতে এখন একই লাইসেন্সে বাংলা মদ বিক্রি করতে পারছেন আইএমএফএল বিক্রেতারা। ফলে বিপণিতে হুইস্কি, ভদকার বোতলের পাশে জায়গা করে নিচ্ছে দেশি মদও। এই পানীয়ের বিক্রি বাড়ার যা অন্যতম কারণ। তবে একমাত্র নয়। কারণ, বাংলা মদের এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে বাহারি প্যাকেজিং আর নতুন বিপণন কৌশলের জুটি। বোতলের চেহারা যতটা সম্ভব আকর্ষণীয় করার চেষ্টা হচ্ছে। টিভিতে-হোর্ডিংয়ে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞাপন। রীতিমতো চমকপ্রদ বিভিন্ন মদের নামও। উড়ান, ক্যাপ্টেন, পিনকন বাংলা নম্বর ওয়ান, টারজান, দাদা, ওয়ান্ডার ইত্যাদি।

ক্রেতাদের বারবার বিপণিতে টেনে আনতে স্বাদ বাড়ানোর উপরও জোর দিচ্ছে দেশি মদের সংস্থাগুলি। শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত সংস্থা পিনকন স্পিরিটের প্রধান মনোরঞ্জন রায়ের দাবি, জোয়ার, বাজরা, গমের মতো শস্যদানা থেকে মদ তৈরি করে তাঁর সংস্থা। তাতে উৎপাদন খরচ লিটারে ছ’টাকা বেশি পড়লেও স্বাদ ভাল হয়। বাংলা মদের কাঁচামালের বৃহত্তম উৎপাদক আইএফবি-র প্রধান বিক্রম নাগও জানান, আগে বাংলা মদে উৎকট গন্ধ আর রং থাকত। কিন্তু এখন উন্নত কাঁচামাল ও উৎপাদন কৌশলের জন্য তা আর থাকে না। এই কারণে স্বাদ ও গন্ধ দুই-ই উন্নত হয়েছে বলে দাবি করছেন টারজান, উড়ানের মতো ব্র্যান্ডগুলির প্রস্তুতকারকরাও।

স্বাদ-গন্ধের এই ফারাক আর নতুন বিপণন কৌশলের যুগলবন্দীই বদলে দিচ্ছে দেশি মদের বাজার। পরিসংখ্যান বলছে, এ রাজ্যে মাসে ন’কোটি দেশি মদের বোতলের চাহিদা রয়েছে। ফলে শুধু বাংলা মদের দোকানে নয়, তা বিক্রি হচ্ছে এমন অনেক বিপণিতে, যেখানে আগে শুধু আইএমএফএল-ই বিক্রি হত।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, মারকাটারি বিপণনের জোরেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে চিনের মাও তাই কিংবা কোরিয়ার সোজু। স্বাদে বা গন্ধে তেমন আহামরি না-হওয়া সত্ত্বেও ওই বিপণনেরই জোরে পর্যটকদের খাওয়ার পাতে পৌঁছে গিয়েছে গোয়ার স্থানীয় মদ ফেনি। বিক্রমবাবু মনে করেন, ‘‘সোজু বা ফেনির মতো ওই উচ্চতায় পৌঁছনো বাংলা মদের পক্ষেও অসম্ভব নয়। তবে তার জন্য বিপণন ও ব্র্যান্ডিং নিয়ে যে ধরনের চিন্তাভাবনা জরুরি, তা এখনও শুরুই হয়নি।’’ তাঁর মতে, সেই সঙ্গে পথের কাঁটা হতে পারে পণ্যের দাম। বিক্রমবাবুর প্রশ্ন, ‘‘যে দামে মাও তাই বা সোজু বিমানবন্দরের ডিউটি-ফ্রি দোকানে বিক্রি হয়, সেই দর বাংলা মদ হাঁকতে পারবে কি?’’

তবে বাজার দখলের রাস্তায় দেশি মদ যে ভাবে এগোচ্ছে, তাতে অশনি সংকেত দেখছেন আইএমএফএল প্রস্তুতকারকরা। এক কর্তার ক্ষোভ, করের বোঝায় এক লাফে দাম বেড়ে গিয়েছে অনেকখানি। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই চাহিদা কমেছে। আর দামের অসম প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলা মদ।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যে ৪৮% বাজার এখনও আইএমএফএল-এর দখলে। ৩৯% দেশি মদের কব্জায়। ১১% বিয়ার ও বাকি ২% ওয়াইন ও অন্যান্য সুরার দখলে। কিন্তু বাজারে দেশি মদের দখল যে ভাবে বাড়ছে, তাতে এই হিসেব অন্যরকম হওয়ার দিকে হাঁটছে বলে অনেকের ধারণা।

abpnewsletters Bengal liquor gagri guha thakurata advertisement kolkata India
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy