কী হবে? বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে উদ্বিগ্ন লগ্নিকারী। ছবি: পিটিআই।
আবার সোমবার।
চিনের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ এ দিন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব বাজারে। শেয়ার বেচতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় সাংহাই থেকে টোকিও, মুম্বই থেকে লন্ডন, প্যারিস থেকে আথেন্স সর্বত্র। মুম্বই বাজারের সূচক সেনসেক্স এক ধাক্কায় পড়ে যায় ১৬২৪.৫১ পয়েন্ট। যা এ পর্যন্ত তার ইতিহাসে বৃহত্তম পতন। বাজার খোলার পরে হু হু করে নামতে থাকে ওয়াল স্ট্রিট, ডাও জোন্স নেমে যায় ১০০০ পয়েন্ট। চিন তার মুদ্রা ইউয়ানের দাম কমানোর পর থেকেই বিশেষ করে এশিয়া জুড়ে ডলারের চাহিদা বাড়তে থাকায় এ দিন টাকার দাম এক ধাক্কায় পড়ে যায় ৮২ পয়সা। ২০০৮ সালের ভয়াবহ আর্থিক মন্দার পর থেকে এ ভাবে কেঁপে ওঠেনি বিশ্ব বাজার। সেই দিনটিও ছিল ২১ জানুয়ারি, সোমবার। এ দিনের পতন দেখে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এটা আরও বড় পতনকে ডেকে আনতে পারে। কারণ, তাঁদের মতে, একটি দুষ্টচক্র তৈরি হওয়াতেই সোমবারের এই পতন। যেখানে ঝুঁকি এড়াতে গিয়ে শেয়ার বেচে দিচ্ছেন লগ্নিকারীরা এবং সেটাই আতঙ্ক ছড়িয়ে দরজা খুলে দিচ্ছে আরও বেশি পতনের। শেয়ার বাজারের পতনে এ দিন বিশ্ব বাজারে দামি হয়েছে সোনা। নিরাপদ লগ্নির মাধ্যম হিসেবে লগ্নিকারীরা বেছে নেন সোনাকেই।
ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর আলাদা আলাদা ভাবে অবশ্য আশ্বাস জুগিয়েছেন লগ্নিকারীদের। বলেছেন, বাইরে থেকে তৈরি হওয়া কারণে পড়েছে বাজার। পরিস্থিতির উপর তাঁরা সজাগ দৃষ্টি রাখছেন। জেটলি বলেছেন, অর্থনীতির ভিত এতটাই শক্ত যে, তাকে বাঁচাতে কোনও ত্রাণ প্রকল্পেরও প্রয়োজন নেই। তবে এ দিন ভারতের শেয়ার বাজারের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কবুল করে নিয়েছেন জেটলি। তিনি জানান, ‘‘প্রধানমন্ত্রী আর্থিক সংস্কারকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কৃতসংকল্প।’’ রাজন এ দিন বলেন, ‘‘বিদেশি মুদ্রাভাণ্ডার যথেষ্ট, প্রায় ৩৫,৫০০ কোটি ডলার। তবে মুদ্রার দাম ছাড়া আর সব কিছুই ভারতের নিয়ন্ত্রণে। আর, টাকার পতন ঠেকানোর মতো অনেক হাতিয়ারও শীর্ষ ব্যাঙ্কের হাতে আছে।’’ একই ভাবে লগ্নিকারীদের ভরসা জুগিয়েছেন জার্মান চান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল। তিনি উল্লেখ করেন, ‘‘আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের মতে চিনা শেয়ার বাজারের পতন আসলে ‘সংশোধন’, সঙ্কট নয়। চিন বাজারকে চাঙ্গা রাখতে যথাসাধ্য করবে।’’ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁকোয়া অঁলান্দও বলেছেন, ‘‘চিন নিজেই তার সঙ্কট মেটাতে পারবে। বিশ্বের বাদবাকি বাজারগুলিও শীঘ্রই উঠে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দেবে, চিনের প্রভাব এখন যতটা মনে হচ্ছে, বাস্তবে ততটা বেশি নয়।’’
নজিরবিহীন ধসে সোমবার মুম্বই বাজার বন্ধের সময়ে সেনসেক্স নেমে আসে ২৫ হাজারের ঘরে। থামে ২৫,৭৪১.৫৬ অঙ্কে। এর আগে এক দিনে সূচকের এতটা পতন কখনও হয়নি। এই পতন রাতারাতি বিনিয়োগকারীদের শেয়ারে লগ্নি করা ৭ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ বা শেয়ার মূল্য (মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন) বাজার থেকে মুছে দিয়েছে। এ দিন প্রায় সমস্ত ধরনের শেয়ারের দামই দ্রুত পড়েছে। ব্যাঙ্ক, বিদ্যুৎ, নির্মাণ শিল্প, তেল এবং গ্যাস কোনও ক্ষেত্রই পতনের হাত থেকে রেহাই পায়নি। পাশাপাশি এ দিন বিদেশি মুদ্রার বাজারে লেনদেন শুরু হওয়ার পর দ্রুত পড়তে থাকে টাকার দাম। ডলার কেনাবেচার ক্ষেত্রে টাকার দাম ৮২ পয়সা পড়ে যায়। যার ফলে প্রতি ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬.৬৫ টাকা। গত দু’বছরের মধ্যে টাকার দাম এতটা আগে পড়েনি। মূলত শেয়ার বাজারের পতনই এ দিন টেনে নামায় টাকাকে। বিদেশি লগ্নিকারীরা ভারতের বাজারে শেয়ার বিক্রি করতে থাকায় বেড়ে যায় ডলারের চাহিদা। কারণ, ওই সব লগ্নিকারীরা শেয়ার বেচে পাওয়া টাকা ডলারে রূপান্তরিত করে স্বদেশে নিয়ে যান। এর জেরে ব্যাঙ্কগুলির ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থাগুলি টানা শেয়ার বিক্রি করে চলেছে ভারতে। ওই সব সংস্থা গত শুক্রবারই এ দেশের বাজারে ২৩৪০.৬০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। আমদানিকারীদের বাড়তি ডলারের চাহিদাও টাকার দাম পড়ার অন্যতম কারণ। টাকার দামের পতন ভারতের বিভিন্ন শিল্প সংস্থার উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে যে-সব সংস্থাকে উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল আমদানি করতে হয়, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে ওই সব সংস্থার উপাদন খরচ বেড়ে গিয়েছে। যার ফলে প্রতিযোগিতার বাজারে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তারা।
চিনের শেয়ার বাজারের পতনের ঢেউই এ দিন আছড়ে পড়ে বিশ্ব জুড়ে। চিনের সংবাদ সংস্থা জিনহুয়া জানাচ্ছে, ২০০৭ সালের পর থেকে এত বেশি প়ড়েনি সে দেশের বাজার। প্রধান সূচক সাংহাই কম্পোজিট ইন্ডেক্স এক ধাক্কায় পড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। মুছে গিয়েছে এ বছরের সব লাভ। ২০০৭ সালের পর থেকে এত বেশি পড়েনি সাংহাই সূচক। সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের ৯৯৩টি শেয়ারের লেনদেনই এ দিন মাঝপথে থমকে যায়। মাত্র ১০০টির লেনদেন গড়ায় দিনের শেষ অবধি। চিনের পতন প্রথমে সংক্রামিত হয় এশীয় বাজারে, পরের দিকে ইউরোপ-আমেরিকায়। বেশ কিছু দিন ধরেই আর্থিক সঙ্কটে চিন আর্থিক সমস্যায় ভুগছে। শিল্প বৃদ্ধিও তলানিতে। তার জেরই এসে পড়ছে শেয়ার বাজারে। সোমবারের ধসের অব্যবহিত কারণ কী?
চিনা শেয়ের বাজারে গত ১২ জুনও ধস নামে, যার জেরে মুছে যায় ৪ লক্ষ কোটি ডলারের শেয়ার মূল্য। বাজারকে চাঙ্গা রাখতে মরিয়া চিন সরকার রবিবারই তার ৩.৫ লক্ষ কোটি ইউয়ানের (৫৫ হাজার কোটি ডলার) পেনশন তহবিলের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ারে লগ্নির অনুমতি দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। কিন্তু এতেই হিতে বিপরীত হয়। শেয়ার বাজারের দুরবস্থা নিয়ে প্রমাদ গোনেন স্থানীয় লগ্নিকারীরা। তাঁদের ভয় হয়, এত কিছু করেও শেষ রক্ষা হবে না। বাজার আরও নামবে এই আশঙ্কাতেই তাঁরা নির্বিচারে শেয়ার বেচতে থাকেন। বিশেষ করে সাংহাই কম্পোজিট ইন্ডেক্স ৩৫০০-র নীচে নেমে যাওয়ার পরে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। দিনের শেষে তা পড়েছে ৩০০ পয়েন্টের মতো। জাপানের নিক্কেই পড়েছে প্রায় ৯০০ পয়েন্ট, হংকঙের হ্যাংসেং পড়ে যায় ১১৫৮ পয়েন্ট। দুপুরের মধ্যে ইউরোপের প্রধান প্রধান সূচক পড়ে যায় ৮ শতাংশ। লন্ডনের এফটিএসই ১০০ পড়েছে ৫ শতাংশ বা ২৯০ পয়েন্ট, ফ্রান্সের সিএসি ৪০ নেমেছে ৭ শতাংশ বা ২৪৮ পয়েন্ট। জার্মানির ড্যাক্স পড়ে যায় ৪৭৯ পয়েন্ট। মার্কিন বাজার খোলার পর মূলত শিল্প সংস্থাকে নিয়ে তৈরি সূচক ডাও জোন্স পড়ে যায় ১০০০ পয়েন্ট বা ৬ শতাংশ। পরে অবশ্য পতন দাঁড়ায় ৩০০ পয়েন্টের মতো। পড়েছে ন্যাসডাকও। মার্কিন বাজার খোলার পরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার শেয়ারের উপর। ফেসবুক শেয়ার পড়ে যায় ১৪ শতাংশ, অ্যাপল ১১ শতাংশ।
বাজারের এই মেগা পতনের জেরে আতঙ্ক ছড়ানো ঠেকাতে রাতেই তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক করে মাঠে নামেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সংবাদ সংস্থার খবর, এই দিন জেটলি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমস্যার জেরে ভারতের শেয়ার বাজারে এই পতন। ভারতে এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি, যাকে ওই পতনের কারণ হিসাবে দায়ী করা যেতে পারে।’’ জেটলি আরও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-সহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষই শেয়ার বাজারের পরিস্থিতির উপর নজর রাখছেন। কখন কী ব্যবস্থা নিতে হবে, সে ব্যাপারে সবাই বিশেষ ভাবে সচেতন।’’
তবে আন্তর্জাতিক আর্থিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হতে থাকায় কপালে ভাঁজ পড়েছে ইস্পাত-সহ বিভিন্ন শিল্প সংস্থার কর্তাদের। স্টেট ব্যাঙ্কের প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রতীপ চৌধুরী বলেন, ‘‘এককথায় বলতে পারি অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক।’’ জিন্দল স্টিলের চেয়ারম্যান সজ্জন জিন্দলও জানিয়েছেন, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে ইস্পাতের চাহিদা কমায় তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের ইস্পাত শিল্পের উপর। শুধু তাই নয়, শিল্পমহলের বক্তব্য, সার্বিক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আর্থিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় বিশেষ করে সমস্যার মধ্যে রয়েছে দেশের রফতানি বাণিজ্য। ইউয়ানের অবমূল্যায়ন এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ, চিনা পণ্য দখল করে নিচ্ছে রফতানি বাজার, অভিযোগ শিল্পমহলের। এই সবের বিরূপ প্রভাব উল্লেখযোগ্য ভাবে শেয়ার বাজারের উপর পড়ছে বলে আশঙ্কা তাঁদের।
বস্তুত, দীর্ঘ দিন ধরেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আর্থিক সমস্যায় আক্রান্ত। ২০০৮ সালের বিশ্ব জোড়া মন্দার জের কাটিয়ে আমেরিকার আর্থিক অবস্থা এখনও মজবুত জমিতে দাঁড়াতে পারেনি। মাঝে মধ্যেই এই সবের প্রতিফলন দেখা যায় শেয়ার বাজারে।
ভারতের শেয়ার বাজারের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত ১০টি বড মাপের পতন হয়েছে। এর মধ্যে সাতটিই সোমবারে। যার জন্য আগের মতো এই সোমবারকেও শেয়ার বাজার মহল ‘কালো সোমবার’ বলে আখ্যা দিয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালের ২১ জানুয়ারি ১৪০৮.৩৫ পয়েন্ট পড়েছিল সেনসেক্স। সেদিনও ছিল সোমবার। এত দিন পতনের ওই অঙ্কই ছিল রেকর্ড। এই দিনের পতন সেই নজিরও ভেঙে দিল।
বাজার এই মুহূর্তে চট করে ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। কারণ, বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে নিজেদের দেশে সমস্যা না- থাকলেও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিরূপ প্রভাব পড়ে দেশের আর্থিক অবস্থার উপর। তাই বিশ্ব বাজারের সঙ্কট ভারতেও সূচককে অনিশ্চিত করে তুলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রবীণ বাজার বিশেষজ্ঞ অজিত দে বলেন, ‘‘অন্তত আরও দু’সপ্তাহ বাজার অত্যন্ত অনিশ্চিত থাকবে বলে আমার মনে হয়। তাই সাধারণ ক্ষুদ্র লগ্নিকারীদের উচিত, সপ্তাহ দুয়েক দেখে নিয়ে তার পর লগ্নির পথে এগোনো।’’
অবশ্য এই পড়তি বাজারকে শেয়ার কেনার ভাল সুযোগ বলে মন্তব্য করেছেন ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রাক্তন সভাপতি এবং স্টুয়ার্ট সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান কমল পারেখ। তিনি বলেন, ‘‘বাজার এতটা পড়ে যাওয়ার ফলে এখন বহু ভাল সংস্থার শেয়ার আগের থেকে অনেক কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে আখেরে ভাল মুনাফা করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে বলেই আমার মনে হয়।’’ একই সঙ্গে বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম দ্রুত কমে যাওয়া ভারতের আর্থিক ব্যবস্থার উপর তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তাঁদের স্থির বিশ্বাস। প্রসঙ্গত, আগাম লেনদেনের বাজারে ব্রিটেনে উন্নত মানের তেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম নেমে এসেছে ব্যারেল প্রতি ৪৪ ডলারে। মার্কিন বাজারে তা ছিল ৩৮ ডলারে। তেলের এই দর আমদানি খরচ কমিয়ে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বিশেষ সহায়ক হবে। কারণ, ভারতের আমদানি খাতে সব থেকে বেশি ডলার খরচ হয় তেল আমদানি করতেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy