Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নোটের চোটে কাজ হারিয়ে পরিচারিকা

নোটবন্দি, জিএসটির জেরে কোপ ছোট শিল্পে। বেশি ধাক্কা খেয়েছেন মেয়েরানোটবন্দি, জিএসটির জেরে কোপ ছোট শিল্পে। বেশি ধাক্কা খেয়েছেন মেয়েরা

এক মনে: কাঁথিতে কাজু কারখানায় কাজ করছেন মহিলারা। নিজস্ব চিত্র

এক মনে: কাঁথিতে কাজু কারখানায় কাজ করছেন মহিলারা। নিজস্ব চিত্র

রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৯ ০২:০২
Share: Save:

পশ্চিম মেদিনীপুরের কুপাডাঙার সুখমণি হাঁসদাকে কোনও দিন চোখে দেখেননি পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথির মাজনার পুতুলরানি ভুঁইয়া। কিন্তু বছর আড়াই আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের ঘোষণায় খানিকটা এক সারিতে চলে এসেছিলেন স্বনির্ভরতার স্বপ্ন সত্যি করা এই দুই মহিলা। এক জন নোটবন্দির চোটে কাজ খুইয়েছিলেন। অন্য জনের রোজগার ঠেকেছিল তলানিতে।

২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর নোটবন্দির ঘোষণা করেন মোদী। বাতিল হয়ে যায় বাজারে চালু নোটের প্রায় ৮৬%। নগদের সমস্যায় সাধারণ মানুষ যেমন জেরবার হয়েছিলেন, তেমনই ধাক্কা লেগেছিল ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পে। যাদের বেশির ভাগ লেনদেনই হয় নগদে। আর এর জেরে কাজও হারিয়েছিলেন বহু মানুষ। দুই মেদিনীপুরের কাজুবাদাম ও শালপাতার কারবারিরাও যার বাইরে ছিলেন না।

যেমন, নোট বাতিলের পরপরই কাজ হারিয়েছিলেন পুতুলরানি। স্থানীয় কাজু প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় কাজ করতেন তিনি। নোট বাতিলের জেরে সেই কারখানার ঝাঁপ বন্ধ হয়, আজও খোলেনি। এখন পরিচারিকার কাজ করে সংসার চালান পুতুলরানি। তিনি বলছিলেন, ‘‘নোটবন্দির পরে মালিক কয়েক মাস মাইনে দিতে পারেনি। তার পর এক দিন কারখানাই বন্ধ করে দিল।’’ কাজু কারখানা বন্ধ হওয়ায় কাজ হারান পুতুলরানির মতো বহু মহিলা। তেমনই এক জন রোকেয়া বিবির প্রশ্ন, “নোটবন্দির ফলে আমাদের ভাল হল কই?’’

কাঁথির মাজনার কাজু প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটে অন্তত ৯০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। রামনগর, তাজপুর, মাজনা, শিলামপুরের মতো গ্রামগুলিতে নোটবন্দির আগে প্রায় ৭০০ কাজু প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট ছিল। কাজ করতেন ৭৫ হাজার মানুষ, যাঁদের বেশিরভাগ মহিলা। বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হওয়ায় প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

হুমগড় থেকে উখলার শালজঙ্গল পেরিয়ে পিচের যে রাস্তা বাঁশডিহা হয়ে চন্দ্রকোনা রোড যাওয়ার রাস্তায় মিশেছে, সেখানে দেখা গেল আর এক ছবি। শুকোতে দেওয়া শালপাতা তুলতে ব্যস্ত মধ্য তিরিশের সাঁওতাল মহিলা সুখমণি। সেই শালপাতা নিমকাঠি দিয়ে সেলাই করে বস্তায় ভরে মহাজনের কাছে দিয়ে এলে কিছু টাকা মেলে। কিন্তু সেটা কত? দুই সন্তানের মা বললেন, ‘‘এক হাজার পাতা টিপলে ১০০ থেকে ১১৫ টাকা হয়।’’ সারাদিনে বড়জোর দেড় হাজার পাতা সেলাই করা যায় বলেও জানালেন তিনি। যে টাকা মেলে তা সুখমণির চার জনের সংসারের অন্যতম ভরসা। স্বামী স্বপন হাঁসদা দিনমজুরি করেন।

সুখমণি জানালেন, বছর খানেক আগে ছবিটা ছিল আরও খারাপ। নোটবন্দির পরে আয় এসে ঠেকেছিল তলানিতে। এক হাজার শালপাতা সেলাই করে মিলত ৭০-৭৫ টাকা। সে সময় দু’মুঠো ভাত জোগাড় করতে দিনমজুরিও করেছেন সুখমণি।

ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরে শালপাতা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ১০ লক্ষ। জঙ্গল থেকে শালপাতা এনে কাঠি দিয়ে সেলাই করে, মেশিনে থালা-বাটি বানিয়ে বহু সংসার চলে। নোটবন্দির পরে জিএসটি-র জেরে বড় ধাক্কা খেয়েছিল এই সংসারগুলি।

সারা ভারত শালপাতা শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি তথা পশ্চিমবঙ্গ শালপাতা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গোয়ালতোড়ের সতীশ সিংহের বক্তব্য, সেই সময় কাজ হারিয়েছিলেন রাজ্যের প্রায় ২০ লক্ষ শ্রমিক। আর এঁদের একটা বড় অংশই মহিলা। শালপাতা থেকে জিএসটি তুলে নেওয়ায় এখন এই শিল্পের হাল কিছুটা ফিরেছে, তবে ভয় কাটেনি।

(তথ্য সহায়তা: কিংশুক গুপ্ত, শান্তনু বেরা)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonitisation Small Industry Female Worker
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE