চিন্তিত: অর্থনীতির ছবি রঙচটা। গালে হাত মোদীর। —ফাইল চিত্র।
নোটবন্দির ধাক্কার পরেও গত এপ্রিলে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির দাবি ছিল, চলতি অর্থবর্ষের শেষে ৭.৫ শতাংশে পৌঁছে যাবে বৃদ্ধির হার। আর তার পিছনে অন্যতম বড় ভূমিকা থাকবে জিএসটি চালুর। সেখানে শুক্রবার এই আর্থিক বছরের বৃদ্ধির পূর্বাভাস শেষমেশ ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে বাধ্য হল কেন্দ্র। আর তা মিলে গেলে, এই হারই হবে নরেন্দ্র মোদীর জমানায় গত চার বছরে সব থেকে কম।
সেই সঙ্গে কেন্দ্র এ দিন ঠারেঠোরে মানলও যে, জিএসটি চালুর আঁচ পড়ছে অর্থনীতির উপরে। সংসদে মাঝরাতে ঢাকঢোল পিটিয়ে যে কর ব্যবস্থা চালুর সময়ে তাকে স্বাধীন ভারতে আর্থিক ক্ষেত্রে বৃহত্তম সংস্কারের তকমা দিয়েছিল তারা।
এ দিন কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দফতরের প্রকাশিত তথ্য থেকেই স্পষ্ট, এই অর্থবর্ষে চোখে পড়ার মতো ধাক্কা খেয়েছে কৃষি এবং কল-কারখানায় উৎপাদন। দেশের অর্থনীতির, বিশেষত কর্মসংস্থানের যা মূল ভিত্তি। কমেছে পণ্য ও পরিষেবার মোট যুক্তমূল্য (জিভিএ) বৃদ্ধির হার। এমনকী মাথাপিছু মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনও (পার হেড জিডিপি) কমেছে আগের বছরের তুলনায়। সব মিলিয়ে ফুটে উঠেছে অর্থনীতির মলিন ছবি। যা টেনে নামিয়েছে বৃদ্ধির পূর্বাভাসকে।
আর্থিক বছরের শুরুতে করা ৭.৩% তো দূর অস্ত্, পরে বলা ৬.৭% পূর্বাভাস ধরে রাখা থেকেও পিছিয়ে আসতে বাধ্য হল কেন্দ্র। মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ কার্যত মেনেওছেন যে, জিএসটি চালুর ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি অর্থনীতি।
আরও পড়ুন: নিখরচার ওষুধে জব্বর কোপ
কেন্দ্রীয় আর্থিক বিষয়ক সচিব সুভাষ চন্দ্র গর্গের অবশ্য দাবি, ‘‘৬.৫% বৃদ্ধির পূর্বাভাস মানে শেষ ছ’মাসে ৭% বৃদ্ধি। অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ এখন স্পষ্ট।’’ কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্র তো কিছু দিন আগেও বলছিল, নোট বাতিলের ‘সাময়িক যন্ত্রণা’ এখন অতীত। ক্রমশ মসৃণ হয়ে আসছে জিএসটি-ও। তা হলে শেষ দুই ত্রৈমাসিকে ৭ শতাংশ বৃদ্ধি টপকানোর পূর্বাভাস তারা করতে পারল না কেন?
গর্গ দাবি করেছেন, দেশে লগ্নির পরিমাণ বাড়ছে দ্রুত। কিন্তু সেখানেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি থেকে শুরু করে শিল্প— বৃদ্ধির ছবি বিবর্ণ প্রায় সর্বত্র। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের কটাক্ষ, ‘‘এখনও কি সরকার বলবে যে বৃদ্ধির হার চাঙ্গা? বছরে দু’কোটি চাকরিরই বা কী হবে?’’ তাঁর দাবি, এমনটা যে হতে চলেছে, তা বারবার বলেছেন তাঁরা। সেই আশঙ্কাই এখন সত্যি হচ্ছে।
কংগ্রেস মুখপাত্র রণজিৎ সূর্যেওয়ালার মতে, এক জন দাম্ভিক প্রধানমন্ত্রী আর ব্যর্থ অর্থমন্ত্রীর যুগলবন্দিই সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে দেশের অর্থনীতিকে। তাঁর কথায়, ‘‘কাঁটা গাছ লাগানো হয়েছে। তাতে কি আম ফলবে?’’ আর সিপিআইএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির কথায়, ‘‘আর্থিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্তই হল, জোটবদ্ধ সমাজ। ভোটের জন্য বিভেদের বিষ ছড়ালে এমন হবেই।’’
টানা ১৫ মাস লাগাতার কমার পরে চলতি অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সামান্য মুখ তুলেছিল বৃদ্ধির হার (৬.৩%)। তখনও মোদী সরকার বুক বাজিয়ে দাবি করছিল যে, সব থেকে খারাপ সময় কেটে গিয়েছে অর্থনীতির। এ বার তার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। জেটলি বলেছিলেন, ‘‘নোট বাতিল আর জিএসটি চালু— দুই সংস্কারের প্রভাবকেই পিছনে রেখে এ বার বৃদ্ধির চাকায় গতি বাড়বে দেশের অর্থনীতির।’’ এখন কিন্তু বিরোধী এবং বিশেষজ্ঞদের একাংশের প্রশ্ন, তবে কি ৬.৫-৭ শতাংশ বৃদ্ধির হারেই সন্তুষ্ট মোদী সরকার। এই হার তো ইউপিএ জমানার ঘোর দুর্দিনেও বজায় থেকেছে। তখন কিন্তু অর্থনীতি সামলাতে সরকারের অপদার্থতা আর নীতিপঙ্গুত্ব নিয়ে নাগাড়ে আক্রমণ করে গিয়েছেন মোদী।
বিরোধীদের মতে, ক্ষমতায় আসার সময়ে অর্থনীতিকে ভাল অবস্থায় পেয়েছিলেন মোদী। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কম ছিল। সরে গিয়েছিল বিশ্বজোড়া মন্দার মেঘ। সম্ভাবনা ছিল অর্থনীতির মসৃণ ‘টেক অফের’। কিন্তু প্রথমে নোট বাতিল ও পরে তড়িঘড়ি জিএসটি চালু সেই সম্ভাবনায় কুড়ুল বসিয়েছে। তা সে এখন জেটলি যতই স্বল্প মেয়াদে তেতো ওষুধের কথা বলুন। কেউ কেউ তাই বলছেন, মসৃণ গতিতে চলতে থাকা কোনও গাড়িকে হ্যাঁচকা ব্রেক কষে থামানোর পরে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফের চালু করলে যেমন হয়, এ বার আর্থিক বৃদ্ধির পূর্বাভাসও কিছুটা তেমনই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy