করোনার দাপট বহাল। আর তার মধ্যেই অব্যাহত ছন্দে ফেরার চেষ্টা। কাজকর্মে, রাস্তাঘাটে, দোকান-বাজারে। লকডাউনে থমকে যাওয়া জীবন তাই এখন অনেকটা সচল। তা হলে রিটার্ন জমা নিয়ে খামোখা আলসেমি কেন? অতিমারির কারণে এ বার আয়কর রিটার্ন দাখিলের জন্য বাড়তি সময় দিয়েছে সরকার। কিন্তু সেটাও ফুরিয়ে আসার মুখে। তাই রিটার্ন সংক্রান্ত কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে বা কোনও খটকা থাকলে, তা মিটিয়ে নিতে হবে দ্রুত। না-হলে বিপদে পড়বেন। সেই জন্যই আজকের এই আলোচনা।
কবে জমা
এমনিতে প্রতি বছর ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে তার আগের অর্থবর্ষের রিটার্ন জমা দিতে হয়। ২০১৯-২০ সালের আয়কর রিটার্ন দাখিলের জন্য এ বার প্রথমে তা বাড়িয়ে ৩০ নভেম্বর করেছিল কেন্দ্র। পরের ধাপে সেই মেয়াদ বেড়ে হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর। অর্থাৎ, হাতে আর তিন সপ্তাহ। এর মধ্যেই সমস্ত কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে হবে। শেষ করে ফেলতে হবে হিসেব। কোনও কর দেওয়া বাকি থাকলে, সেটাও দিয়ে দিতে হবে এই ২১ দিনেই। তার পরে নিশ্চিন্তে বসে রিটার্ন জমা দিতে হবে। সেই সঙ্গে সারতে হবে ভেরিফিকেশনের কাজও। পুরো বিষয়টি জটিল মনে হলে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে পারেন।
রিটার্ন দাখিল কেন
এটা ঠিক যে কর দিতে না-হলে রিটার্ন জমা না-দিলেও চলে। তবে অনেক ক্ষেত্রে তা দাখিল করে রাখতে পারলে ভাল। কিছু ক্ষেত্রে আবার এটা জমা দেওয়া বাধ্যতামূলকও। সাধারণত যে সমস্ত কারণে রিটার্ন দেওয়ার কথা বলা হয়, তার মধ্যে রয়েছে—
• মোট রোজগার করমুক্ত আয়ের থেকে বেশি হলে।
• একাধিক সূত্র, যেমন গৃহসম্পত্তি, মূলধনী লাভ থেকে আয় হলে।
• যদি আয়কর রিফান্ড পাওয়ার কথা থাকে।
• যদি বিদেশে সম্পত্তি কিনে থাকেন কেউ এবং সেখান থেকে কোনও রোজগার করে থাকেন।
• যদি বিদেশে যেতে ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়।
• ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণের জন্য আবেদন করতে চাইলে।
• লাভ হোক বা না হোক, লিমিটেড কোম্পানি এবং অংশীদারি ফার্মকে রিটার্ন ফাইল করতেই হয়।
খেয়াল রাখুন
এমনিতে অনলাইনে নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে কিছু ক্ষেত্রে তাতে ছাড় রয়েছে। সেখানে হাতেও ফর্ম ভর্তি করে দাখিল করা যায়। তেমন দুই ক্ষেত্র হল—
• করদাতার বয়স যদি ৮০ বছরের বেশি হয়ে থাকে।
• মোট করযোগ্য আয় ৫ লক্ষ টাকা না-ছাড়ালে এবং রিফান্ড পাওয়ার কোনও ব্যাপার না-থাকলে।
কোন ফর্ম কার
আয়ের ধরন অনুযায়ী রিটার্নের ফর্ম কিন্তু আলাদা। প্রতি বছরই ফর্মে কিছু না-কিছু বদল আনে কেন্দ্র। তাই শুরুতেই জেনে রাখা ভাল কোন ফর্ম কার জন্য। তা হলে নিজেরটি বেছে নিতে সুবিধা হবে। ২০১৯-২০ সালের জন্য মোট সাতটি ফর্ম (আইটিআর) প্রকাশ করেছে আয়কর দফতর। তাই চলুন দেখে নিই, কোনটা কাদের জন্য।
আইটিআর-১
সব চেয়ে বেশি ব্যবহার হয় এই ফর্মেরই। এটি জমা দেওয়ার কথা যে সমস্ত আয়ের ক্ষেত্রে, সেগুলি হল—
• বেতন বা পেনশন বাবদ ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
• একটি গৃহ সম্পত্তি থেকে।
• অন্যান্য সূত্র থেকে (লটারি এবং ঘোড়দৌড় বাদে)।
• কৃষি কাজে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত।
যে সব আয়ের ক্ষেত্রে নয়
• ৫০ লক্ষের বেশি।
• চাষ থেকে ৫০০০ টাকার বেশি।
• করযোগ্য মূলধনী লাভ হিসেবে।
• ব্যবসা বা স্বাধীন পেশা থেকে।
• একাধিক বাড়ি থেকে।
• কোনও সংস্থার ডিরেক্টর হিসেবে।
• সংশ্লিষ্ট বছরে বাজারে নথিভুক্ত নয়, এমন কোনও সংস্থার শেয়ার কিনে।
• ভারতের বাইরে থাকা সম্পত্তি থেকে।
• অনাবাসী ভারতীয় হওয়ার সূত্রে।
• বিদেশ থেকে।
আইটিআর-২
এটি জমা দেওয়ার কথা যে সমস্ত আয়ের ক্ষেত্রে, সেগুলি হল—
• বেতন ও পেনশন থেকে, এক বা একাধিক বাড়ি থেকে, লটারি ও ঘোড়দৌড়-সহ অন্যান্য সূত্রে— এই তিনটি মিলিয়ে ৫০ লক্ষ টাকা ছাড়ালে
• বিদেশে সম্পত্তি এবং বিদেশ থেকে।
• চাষ থেকে ৫০০০-এর বেশি যখন।
• কোনও সংস্থার ডিরেক্টর হিসেবে।
• বাজারে নথিভুক্ত নয়, এমন সংস্থার শেয়ার কিনে।
যে সব আয়ের ক্ষেত্রে নয়
• ব্যক্তি বা হিন্দু অবিভক্ত পরিবারের ব্যবসা বা স্বাধীন পেশা থেকে।
• কোনও করদাতা আইটিআর-১ দাখিলের যোগ্য হলে।
আইটিআর-৩
• কোনও ব্যক্তি বা অবিভক্ত হিন্দু পরিবার, যাঁদের ব্যবসা অথবা পেশাগত আয় রয়েছে।
• উপরের শর্তটি পূরণ করলে এই রিটার্নে বেতন, পেনশন, মূলধনী লাভ, গৃহসম্পত্তি থেকে অথবা অন্যান্য সূত্র থেকে আয় সবই থাকতে পারে।
আইটিআর-৪
• ব্যক্তি, অবিভক্ত হিন্দু পরিবার অথবা অংশীদারি ফার্ম, যারা ধারা ৪৪এডি অথবা ৪৪এই অনুসারে ব্যবসার সম্ভাব্য আয়ের ভিত্তিতে অথবা ৪৪এডিএ অনুযায়ী সম্ভাব্য পেশাগত আয়ের রিটার্ন পেশ করেন।
• এই ফর্মটিতে ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বেতন বা পেনশন বাবদ রোজগার দেখানো যায়।
• একটি গৃহসম্পত্তি থেকে অনধিক ৫০ লক্ষ টাকা আয় বা অন্যান্য সূত্র থেকে আয়ও দেখানো যায়।
কাদের জন্য নয়
• কোনও ব্যক্তি যাঁর বেতন, গৃহ সম্পত্তি অথবা অন্যান্য সূত্র থেকে ৫০ লক্ষ টাকার বেশি আয় রয়েছে।
• যিনি কোনও সংস্থার ডিরেক্টর অথবা নথিভুক্ত নয় এমন শেয়ারে যাঁর লগ্নি আছে।
• কোনও ব্যক্তি, অবিভক্ত হিন্দু পরিবার অথবা অংশীদারি ফার্ম, যাদের নথি আয়কর আইন অনুসারে অডিট করাতে হয়।
আইটিআর-৫
• অংশীদারি ব্যবসা রয়েছে যাঁদের।
• লিমিটেড লায়বিলিটি পার্টনারশিপ।
• অ্যাসোসিয়েশন অব পার্সন্স।
• ব্যক্তি গোষ্ঠী।
• আইনানুগ ব্যক্তি (জুরিডিক্যাল পার্সন)।
• মৃত ব্যক্তির এস্টেট।
• দেউলিয়া ঘোষিত ব্যক্তির এস্টেট।
• ব্যবসার ট্রাস্ট।
• লগ্নি ফান্ড।
আইটিআর-৬
• সমস্ত লিমিটেড সংস্থা (আয়কর আইনের ১১ ধারায় যারা ছাড় নেয়, তারা বাদে)।
আইটিআর-৭
• যে সমস্ত ব্যক্তি বা সংস্থার ক্ষেত্রে আয়কর আইনের ১৩৯ (৪এ), ১৩৯ (৪বি), ১৩৯ (৪সি) অথবা ১৩৯ (৪ডি) ধারা প্রযোজ্য হয়।
কী কী তথ্য লাগবে
যখনই রিটার্ন ফাইল করুন না কেন, নির্দিষ্ট কিছু তথ্য আপনাকে জমা দিতে হবে। তাই সেগুলি প্রথম থেকেই হাতের কাছে গুছিয়ে রাখা ভাল। না-হলে শেষ মুহূর্তে গিয়ে সমস্যা হতে পারে। এ জন্য তৈরি রাখুন—
• প্যান কার্ড।
• আধার কার্ড
• ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্য।
• ফর্ম-১৬ এবং ১৬-এ।
• ফর্ম-২৬ এএস-এর কপি।
• কর সাশ্রয়ের লগ্নি সংক্রান্ত তথ্য।
• সুদ বাবদ আয়-সহ ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট এবং পাসবই।
• করছাড় পাওয়া যায়, এমন সমস্ত খরচের তথ্য।
• শেয়ার বা ফান্ড বিক্রি করলে, তার লাভ বা লোকসানের হিসেব।
• শেয়ার থেকে ডিভিডেন্ডের হিসেব।
• যে সব আয়ে কর নেই, তার তথ্য।
• মোট আয় ৫০ লক্ষ টাকার বেশি হলে আইটিআর-২, ৩ অথবা ৪ (যেটি প্রযোজ্য হবে)-এর সঙ্গে সম্পদ ও দানের বিবরণ দিয়ে ‘শিডিউল এএল’ জুড়তে হবে।
জমার পদ্ধতি
এ জন্য পেশাদারের সাহায্য নিতে পারেন। চাইলে বাড়িতে বসে নিজে নিজেও তা দেওয়া যায়। শুধু চাই কম্পিউটার। নিজে দিতে চাইলে—
• প্রথমে খুলুন www.incometaxindiaefiling.gov.in ওয়েবসাইটটি।
• যে পর্দা খুলবে, সেখানে নাম নথিভুক্ত করতে হবে।
• এ জন্য দিতে হবে ই-মেল ও মোবাইল নম্বর। সেই সঙ্গে তৈরি করতে হবে পাসওয়ার্ড।
• নাম নথিবদ্ধ হলে ইউজ়ার আইডি (আপনার প্যান) এবং পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে লগ-ইন করুন।
• এর পরে পর্দায় ভেসে ওঠা মাই অ্যাকাউন্টে ক্লিক করুন।
• এই পর্যন্ত আসার পরে আপনি নিজের ফর্ম ২৬এএস ডাউনলোড করতে পারবেন।
• এ বার আপনার যে আইটিআর ফর্ম, সেটা ডাউনলোড করুন।
• খেয়াল রাখবেন, এখানে কিছু তথ্য আগে থেকেই ভর্তি করা থাকবে। বাকিটা নিজেকে ভরতে হবে।
ধাপে ধাপে ভরুন
• ব্যক্তিগত তথ্য। যেমন, জন্ম তারিখ, বাবার নাম ইত্যাদি।
• চাকরি করলে সংস্থার নাম, বেতন সংক্রান্ত তথ্য, উৎসে কাটা করের (টিডিএস) তথ্য।
• লগ্নি, খরচ ইত্যাদি বাবদ ছাড় কত।
• অন্যান্য সূত্র থেকে কর কেটে নেওয়ার তথ্য, যা ফর্ম ২৬এএস থেকে পাওয়া যেতে পারে। যে সূত্র থেকে কর কাটা হয়েছে, সেই আয় অবশ্যই রিটার্নে দেখাতে হবে।
• ভরতে হবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য। এখানে মূল অ্যাকাউন্ট ছাড়াও দিতে হবে আপনার অন্যান্য অ্যাকাউন্টের বিবরণ।
• পুরো ফর্ম ভর্তি করা করার পরে তা ভাল করে পরীক্ষা করে মিলিয়ে নিতে হবে। খুঁটিয়ে দেখতে হবে সমস্ত তথ্য ঠিকঠাক রয়েছে কি না। সব জায়গায় ঠিক তথ্য লেখা হয়েছে কি না।
• ফর্ম পূরণ সম্পূর্ণ হলে যদি পর্দায় ‘রিফান্ড’ অথবা ‘নো ট্যাক্স ডিউ’ লেখা ভেসে ওঠে, তা হলে এ বার রিটার্ন দাখিল করতে এগোন।
• রিটার্ন ফাইল করার পরে তা ভেরিফাই করতে হবে। মোবাইলে আসা ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) ব্যবহার করে সেটা করা যায়।
• না-হলে সাইটে ভেসে ওঠা ‘অ্যাকনলেজমেন্ট’ পাতাটির প্রিন্ট নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গা সই করে ১২০ দিনের মধ্যে বেঙ্গালুরুতে আয়কর দফতরের সেন্ট্রালাইজ়ড প্রসেসিং সেন্টারে পাঠিয়ে দিলেও হবে।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)