Advertisement
E-Paper

জরি শিল্পের গলায় ফাঁস

নোট বাতিল ও জিএসটি-র জেরে কোপ পড়েছে ছোট শিল্পে। সব চেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছেন মেয়েরানোট বাতিল ও জিএসটি-র জেরে কোপ পড়েছে ছোট শিল্পে। সব চেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছেন মেয়েরা

গার্গী গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৯ ০১:২১
কমেই সই: সামান্য হলেও কাজ আসছে। কিন্তু ভাটা মজুরিতে। পাঁচলার বাড়িতে জরির কাজে মগ্ন সালমা। নিজস্ব চিত্র

কমেই সই: সামান্য হলেও কাজ আসছে। কিন্তু ভাটা মজুরিতে। পাঁচলার বাড়িতে জরির কাজে মগ্ন সালমা। নিজস্ব চিত্র

এক মানুষেরও কম উচ্চতার মাটির ঘর। ঘর জুড়ে ‘কারচোপ’। যে কাঠের কাঠামোয় টানটান করে বাঁধা রয়েছে শাড়ি। হলুদ জমিতে সোনালি-রুপোলি জরির ফুল তুলছে সালমা। হাওড়ার পাঁচলা ব্লকের গাববেড়িয়া গ্রামের সালমা খাতুন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। আগে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করত। এখন সারাদিনই আঙুলে সূচ। আর কলেজ শুরু হলে? এক লহমার ম্লান হয়ে গেল সপ্তদশীর মুখ। বলল, ‘‘কলেজে পড়া বোধহয় হবে না। দাদাদের সঙ্গে হাতে হাতে কাজ না করলে সংসার চলবে কী করে? এখন তো কাজ-মজুরি, সবই কমেছে।’’

কেন কমল কাজ ও মজুরি? এলাকার বাসিন্দারাই বলছেন, ছবিটা বদলে গিয়েছে ২০১৬ সালে নোটবন্দির পর। সে বছরের নভেম্বরে এক ধাক্কায় বাতিল হয়ে গিয়েছিল প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকার কাজ। মহাজনদের থেকে কাজ পাননি ওস্তাগরেরা। ওস্তাগরদের থেকে কাজ জোটেনি কারিগরদের। পাশাপাশি দিল্লি, মুম্বই থেকেও কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিলেন বহু পুরুষ। ফলে সম্প্রতি কাজ কিছুটা ফিরলেও কাজের লোক বেড়েছে। আর চাহিদা ও জোগানের নিয়ম মেনেই কমেছে মজুরি। বেশি সমস্যায় পড়েছেন মহিলারা।

ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, নোট বাতিলের পরে সব চেয়ে বেশি চোট খেয়েছিল মূলত নগদে কারবার চালানো ছোট ব্যবসা। হাওড়ার জরি শিল্পও যার বাইরে নয়। পাঁচলা, আমতা এক ও দুই, উদয়নারায়ণপুর, সাঁকরাইল ব্লকের একের পর এক গ্রামে এখনও ধুঁকছে এই শিল্প।

গাববেড়িয়া গ্রামেরই আয়েশার পরিস্থিতি সালমার মতোই। ১০ বছর বয়সে জরির কাজে হাতখড়ি। নবম শ্রেণির পরে আর স্কুল যাওয়া হয়নি। মাটির ঘরে কারচোপে হেলান দিয়ে আয়েশা বললেন, ‘‘বর্ষার আগে ঘরের চাল ঠিক না করলে জরির কাজের কাপড়-জামা কোথায় রাখব জানি না। পোশাকে জল পড়লে আর বরাত পাব না।’’ বরাত বলতে ব্লাউজ, জামার হাত ও গলায় জরি বসানোর মতো ছোট ছোট কাজ। কাজ প্রতি মজুরি মাত্র ২৫ টাকা। এখানেও সমস্যায় মেয়েরা। কারণ, ওস্তাগরের কাছ থেকে বড় কাজের বরাত মূলত পুরুষেরাই নিয়ে আসেন। আয়েশা জানান, মা-মেয়ের সংসারে সেই সুবিধা নেই।

এ ভাবেই ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন জরি শিল্পের সঙ্গে জড়িত মহিলা কারিগরেরা। সারা ভারত জরি শিল্পী কল্যাণ সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক মুজিবর রহমান মল্লিকের দাবি, শুধু নোটবন্দি নয়। তড়িঘড়ি জিএসটি চালুর ফলেও সমস্যা বেড়েছে হাওড়ার ৬০০ বছরের পুরনো জরি শিল্পের। যা ছন্দে ফিরতে পারেনি এখনও। মুজিবর জানালেন, অনেকেই বাধ্য হয়ে বাপ-ঠাকুরদার কাজ ছেড়েছেন। ভিন রাজ্যে গিয়ে দিনমজুরি করছেন। কিন্তু ঘর সংসার ফেলে মহিলাদের পক্ষে অন্য রাজ্যে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জেলার প্রায় ছ’লক্ষ জরি শিল্পী। তাঁদের প্রায় ৫০% মহিলা। এখন নোটবন্দি ও জিএসটির সমস্যা সব চেয়ে বেশি পোহাতে হচ্ছে তাঁদের। জনৈক জরি শিল্পী হাসিনা বিবির প্রশ্ন, ‘‘অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়িকে ফেলে কোথায় যাব? অন্য কোথাও গিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে দেব কী করে?’’

অথচ ২০১২ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই জেলায় জরি হাবের উদ্বোধন করেছিলেন। শেখ আলি, সুজান শেখ, হান্নান মোল্লার মতো জরি শিল্পীদের অভিযোগ, ওই হাব কার্যত মহাজনদের দখলে। শেখ আলি বলেন, ‘‘আমাদের পুঁজি নেই। বিপণন কৌশলও বুঝি না। সমবায় তৈরি না করলে লাভ হবে না।’’ ফলে যাঁদের ঘরে ফেরানোর জন্য এই হাব তৈরি করা হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, সেই তাঁরাই ফের ভিন্‌ রাজ্যে ফিরতে চাইছেন। গাববেড়িয়ার আমিন মল্লিকই যেমন মুম্বই থেকে দুই ছেলেকে নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু এখন আবার ছেলেদের সেখানে পাঠাতে চাইছেন। শুধু পেটের টানে নয়। ঘরে বৌ আনতেও এই ব্যবস্থা। আমীন বলেন, ‘‘জরি শিল্পীদের ঘরে মেয়ে দেবে কে? দিনে নিয়মিত ৫০ টাকাও তো জোটে না!’’

Brocade Industry Demonetisation Lok Sabha Election 2019
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy