সিঁড়ির মুখে ফ্যালফ্যালে চোখে বসে আট সন্তানকে এখনও খুঁজে চলেছে বরাহনগরের পরি। নিজস্ব চিত্র
ছটফটে চোখ দুটো অদ্ভুত রকমের ‘শান্ত’। এক মুহূর্তের সুযোগ পেলেই ছুটে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে চাইছে সদ্য সন্তানহারা মা। বারবার তাকে টেনে আনছেন পরিজনেরা। অগত্যা সিঁড়ির মুখে ফ্যালফ্যালে চোখে বসে আট সন্তানকে এখনও খুঁজে চলেছে বরাহনগরের পরি ওরফে মুম্বি।
শনিবার দুপুরের আগুনে পরির চোখের সামনে ঝলসে গিয়েছে তার আট সন্তান। সব দেখেও আগুনের তাপের কাছে হার মেনেছিল ছ’বছরের পোষ্যটি। সন্তান হারানোর ব্যাথা বলতে না পারলেও চোখের কোণ বেয়ে পড়া জলের ধারাই যেন সব বুঝিয়ে দিচ্ছে। সে দিকে তাকালে কেঁদে ফেলছেন পরির মনিব পৃথা মুখোপাধ্যায়রাও। বরাহনগর পুরসভার ওই কাউন্সিলরের বাড়ির মেজ়েনাইন ফ্লোরেই শনিবার আগুন লাগে। সেখানেই ছিল পরি ও তার সাত দিন বয়সের আট ছানা। পরিকে প্রতিবেশীরা উদ্ধার করলেও বাঁচানো যায়নি ছানাদের।
পশু চিকিৎসক মিন্টু চৌধুরী বলেন, ‘‘এমন হওয়া খুবই স্বাভাবিক। পোষ্যটি খুবই আতঙ্ক ও মানসিক কষ্টের মধ্যে রয়েছে। সবার মধ্যে রেখে বেশি করে খেলাধুলো করানো বা বাড়িতে যদি বাচ্চা থাকে, তার সঙ্গে কুকুরটিকে খেলতে দিলে ওর মন অনেকটা হাল্কা হবে।’’
রবিবারও কুমোরপাড়া লেনের ওই বাড়ি জুড়ে প্রিয়জন হারানোর বেদনা। পৃথাদেবী জানান, আগুন নিভিয়ে দমকল ও প্রতিবেশীরা চলে যাওয়ার পরে পরিকে নিয়ে আসা হয় দোতলায়। ওঠার সময়ে বারবার করে মেজ়েনাইন ফ্লোরের ঘরটিতে সন্তানের খোঁজে ঢোকার চেষ্টা করেছে সে।
শনিবার সন্ধ্যা নামতেই সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে পরি। চিৎকার করে উঠেছে বারবার। কিন্তু নীচে যেতে না পেরে এক সময়ে চুপ করে বসে পড়েছে ঘরের কোণে। রুটিনমাফিক রাতে দুধ-রুটির বাটি সামনে দিলেও তাতে মুখ দিতে চায়নি। শেষে কোনও মতে জোর করে অল্প খাবার খাওয়ানো হয়েছে তাকে। পৃথাদেবী বলেন, ‘‘ঘুরতে ফিরতে জল খেত মুম্বি। ঘটনার পর থেকে জলে মুখ দিচ্ছে না। সারা রাত ঘুমোয়নি। বারবার উঠে ঘরে পায়চারি করেছে।’’
রবিবার সকাল থেকেও এক অবস্থা ল্যাব্রাডর প্রজাতির ওই পোষ্যের। পৃথাদেবীর মেয়ে ঋতশ্রী জানান, শনিবারও অফিস যাওয়ার সময়ে তিনি দেখেছিলেন আট ছানাকে কোলের কাছে নিয়ে বসে রয়েছে পরি। ঋতশ্রী বলেন, ‘‘আটটি ছানা নেই ভাবতে পারছি না। আর পরি তো মা।’’ এ দিন সকাল থেকে পরিকে দোতলার ঘরেই নিজেদের মাঝে রেখেছেন ঋতশ্রীরা। কোনও ভাবেই সে যাতে নীচে যেতে না পারে, সে দিকে লক্ষ রাখছেন সকলে। দুপুরে প্রিয় খাবার ভাত-মাংসের ঝোলেও মুখ দিতে চায়নি পরি। মুখে বল নিয়ে লোফালুফি খেলা তার খুব পছন্দের। কিন্তু ঘটনার পর থেকে সেই বল আর মুখে নেয়নি।
এ দিন পরিকে কোলে টেনে নিয়ে পৃথাদেবী বলেন, ‘‘ওর মনের ভিতরে যে কত ঝড় বইছে, তা কি আমরা জানি?’’ তবে পরির ‘শান্ত’ চোখই জানে, তার মনের অশান্তির ঠিকানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy