ঐতিহাসিক: এই নাটমন্দিরকে ঘিরেই উঠছে প্রশ্ন। ছবি: সুদীপ ঘোষ
কত টাকায় বিক্রি হয়েছিল যেন?
১২ লক্ষ টাকায়।
কবে?
সেই তিরিশ বছর আগে!
নথিপত্র ঘেঁটে ঘেঁটে শোভাবাজার নাটমন্দির সম্পর্কে এমনই তথ্য সংগ্রহ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন শোভাবাজার রাজবাড়ির অন্যতম সদস্য প্রবাল দেব। কারণ, সংরক্ষণের যে স্থাপত্যকীর্তিকে এক সময়ে তাঁদেরই পরিবারের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল কলকাতা পুরসভা, তারই রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে তৈরি হয়েছে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা। তাই হাতের কাছে সমস্ত নথি জোগাড় করে রাখছেন প্রবালবাবু। প্রয়োজন হলেই যাতে সেই সব উপযুক্ত জায়গায় পেশ করা যায়।
অবশ্য এই প্রথম বার নয়। নাটমন্দিরের উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে বহু দিন ধরেই প্রশ্ন উঠেছিল। উইয়ের দাপটে বিপন্ন হতে বসেছিল নাটমন্দিরের দেওয়াল। গত বছরে তা সামনে আসার পরে পুর আধিকারিকেরা পরিদর্শন করেছিলেন। ব্যস, ওই পর্যন্তই। প্রবাল দেবের কথায়, ‘‘শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণ দেবের নাতি রাধাকান্ত দেব ১৮৩০ সালে যে নাটমন্দিরটি তৈরি করেছিলেন, সনাতন হিন্দুধর্ম প্রচারে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তবে হিন্দু ধর্ম প্রচার বলতে এখন যা বোঝায়, তেমন বিষয় নয়। বিধবা বিবাহের তর্কসভা, জেমস লঙকে গ্রেফতারির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদসভার মতো আরও অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গেও এই নাটমন্দির জড়িত। তার সংরক্ষণ অবশ্যই দরকার।’’ স্থানীয় কাউন্সিলর করুণা সেনগুপ্তও বলছেন, ‘‘বারবার পুরসভা বলছে সংস্কার হবে। কিন্তু কোনও উদ্যোগই দেখছি না।’’
যদিও সংস্কার প্রসঙ্গে দু’নম্বর বরোর চেয়ারম্যান সাধন সাহার সাফাই, ‘‘ওই নাটমন্দির কী অবস্থায় রয়েছে তা দ্রুত খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’
১৯৮৯ সালে কমল বসু মেয়র থাকাকালীন নয় কাঠা জায়গা জুড়ে থাকা নাটমন্দির ১২ লক্ষ টাকা দিয়ে শোভাবাজার রাজবাড়ির কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল কলকাতা পুরসভা। তখনকার মেয়র পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্তও হয়েছিল, নাটমন্দিরের স্থাপত্যকীর্তি সংরক্ষণের সব চেষ্টা করা হবে। অথচ এক যুগ আগে একবার সংস্কারের পরে তা আর করা হয়নি। হেরিটেজ স্থাপত্যবিদ পার্থরঞ্জন দাশ বলেন, ‘‘নাটমন্দিরের নকশাটা দেখলে বোঝা যাবে ঘর, বারান্দা, করিডরের মধ্যে একটা বাঙালিয়ানার ছোঁয়া রয়েছে। কিন্তু স্তম্ভ বা মূল কাঠামোর দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে, ব্রিটিশদের তুষ্ট করতে ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিকে নকল করা হয়েছে।’’
অবশ্য শুধু সংস্কারই নয়, সংস্কৃতি-কেন্দ্রের পরিসর এখন সুতানুটি পরিষদ ও পুরসভার মধ্যে বিতর্কে সরগরম। সুতানুটি পরিষদের বক্তব্য, শোভাবাজার নাটমন্দির যা প্রায় ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছিল এক সময়ে, তার সংরক্ষণে অন্যতম ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তারা। প্রামাণ্য তথ্য অবশ্য তেমনই বলছে। ২০০৮ সাল নাগাদ নাটমন্দির সংস্কারে যে এক কোটি ২০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল, তার অর্ধেকেরও বেশি টাকা পরিষদের উদ্যোগেই সংগৃহীত হয়েছিল। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সংস্কারের অন্যতম উদ্যোক্তা সংগঠন হিসেবে পরিষদের যত অনুষ্ঠান হত নাটমন্দিরে, তার জন্য তাদের কোনও ভাড়া দিতে হত না। ‘সৌজন্য’ দেখিয়েই পুরসভার তরফে সে ভাড়া নেওয়া হত না।
কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ‘সৌজন্য’-র বাতাবরণে কিঞ্চিৎ বদল এসেছিল। পরিষদের নিজস্ব কোনও অনুষ্ঠান থাকলে পুরসভার তরফে ভাড়া নেওয়া হচ্ছিল, তবে কিছুটা ছাড় দিয়ে। ছাড়ের পরিমাণ ছিল ৫০ শতাংশ। এ পর্যন্ত মোটামুটি ঠিকঠাকই ছিল বলে জানাচ্ছেন পরিষদের সদস্যেরা। কিন্তু গোল বাধল গত মাসে। যখন পরিষদের এক অনুষ্ঠানে ছাড়ের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ভাড়ার ৭৫ শতাংশই নিল পুরসভা।
আর সেই পদ্ধতিকেই ‘অসম্মানজনক’ বলে মনে করছেন পরিষদের সদস্যেরা। সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক গোপীনাথ ঘোষ বলেন, ‘‘ভাড়া দেওয়াটা এখানে কোনও বিষয়ই নয়। বিষয়টা সম্মানের ও সৌজন্যের। নাটমন্দিরের ইতিহাস দেখলেই বোঝা যাবে এর সংস্কারে আমাদের ভূমিকা কী! সেখানে যে ভাবে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তাতে অসৌজন্য প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা ঠিক করেছি পুরো টাকাই এ বার থেকে দেব। ছাড়ের দরকার নেই।’’
কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমার বলেন, ‘‘ছাড়ের বিষয় উল্লেখ রয়েছে এমন কোনও নথি তো থাকতে হবে। সেই নথি নিয়ে তাঁরা আসুন। অবশ্যই ছাড় দেওয়া হবে।
ফলে সংস্কারের অনিশ্চয়তা ও ‘অসৌজন্য’ উত্তর কলকাতার ইতিহাসের অন্যতম কেন্দ্র এখন বিতর্কের মূলে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy