Advertisement
১৯ মে ২০২৪

ব্রাজিলে আস্থা ‘ধন্যি মেয়ে’র ফরোয়ার্ডের

মান্না দে-র গাওয়া মাত্র চার মিনিটের সেই গানের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে লেগেছিল পাক্কা ১৭ ঘণ্টা! ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় রেলগাড়ির ‘নকল’ কামরা বানিয়েই শুটিং হয়েছিল ফুটবলপ্রেমী বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে থাকা ওই গানের দৃশ্য।

অতীত ছুঁয়ে: উত্তমকুমারের শুভেচ্ছাবার্তা লেখা ছবির সামনে অশোকবাবু। মঙ্গলবার, হাওড়ায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

অতীত ছুঁয়ে: উত্তমকুমারের শুভেচ্ছাবার্তা লেখা ছবির সামনে অশোকবাবু। মঙ্গলবার, হাওড়ায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

শান্তনু ঘোষ ও দেবাশিস দাশ
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৮ ০২:৫৫
Share: Save:

‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল...।’

মেঠো রেলপথ ধরে দৌড়চ্ছে ট্রেন। তারই ‘৩৫-কে’ নম্বর কামরায় ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে এক দল যুবক। সঙ্গে তাঁদের পাড়ার মাইক-বিক্রেতা কামাক্ষ্যা মামা। দলের ‘ক্যাপ্টেন’ বগলা আর ‘ভাইস ক্যাপ্টেন’ ঘণ্টেশ্বর-সহ সতীর্থেরা মিলে গেয়ে উঠলেন সেই গান।

মান্না দে-র গাওয়া মাত্র চার মিনিটের সেই গানের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে লেগেছিল পাক্কা ১৭ ঘণ্টা! ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় রেলগাড়ির ‘নকল’ কামরা বানিয়েই শুটিং হয়েছিল ফুটবলপ্রেমী বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে থাকা ওই গানের দৃশ্য। কানে হেডফোন লাগিয়ে সেই গানটাই শুনছিলেন হাওড়ার হালদারপাড়া লেনের ৭৬ বছরের ফুটবলপাগল ‘তরুণ’। যিনি কালীগতি দত্তের মতো স্বপ্ন দেখেন, তাঁর প্রিয় দল ব্রাজিল ছিনিয়ে নিচ্ছে বিশ্বকাপ!

তিনি অশোক কর। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির ওই বৃদ্ধ ছিলেন ‘ধন্যি মেয়ে’-তে কালীগতিবাবুর সর্বমঙ্গলা স্পোর্টিং ক্লাবেরই খেলোয়াড়। যাঁকে সাদা-কালো ওই ছবির জন্য বেছেছিলেন খোদ কালীগতিবাবু বা উত্তমকুমার। ৪৮ বছর আগের সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বারবার চোখের কোণ চিকচিক করে উঠছিল অশোকবাবুর। যৌবনে হাওড়া ইউনিয়নের হয়ে স্টপার হিসেবে খেলতেন মোহনবাগানের ভক্ত ওই বৃদ্ধ। তবে হাড়ভাঙার মাঠে তাঁকে খেলতে হয়েছিল ফরোয়ার্ডে। তাঁর কথায়, ‘‘ছোট থেকেই আমি ফুটবল অন্ত প্রাণ। ওই খেলার সূত্রেই ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতে চাকরি পেয়েছিলাম। তবে এক সময়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পারিবারিক ব্যবসা শুরু করি।’’

আর তখনই পারিবারিক বন্ধু তথা চিত্রগ্রাহক বিজয় ঘোষ হালদারপাড়ার আঠাশ বছরের অশোকের কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসেন, সিনেমার দরকারে ফুটবলের সরঞ্জাম থেকে খেলোয়াড়— সব সরবরাহ করতে হবে। সব বন্দোবস্ত করে এক দিন ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান আশোক। বললেন, ‘‘ওই দিনই উত্তমকুমারের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমি ফুটবল খেলোয়াড় জানা মাত্রই তিনি পরিচালককে বলেন, ‘ওঁকে নিয়ে নাও।’’’

ছিয়াত্তরের বৃদ্ধ জানান, উত্তমকুমারের ইচ্ছাতেই সর্বমঙ্গলা ক্লাবের খেলোয়াড়দের গায়ে উঠেছিল মোহনবাগানের সবুজ-মেরুন জার্সি। আর ইস্টবেঙ্গলের লাল-হলুদ জার্সি ছিল হাড়ভাঙার। পরিকল্পনা ছিল, চলন্ত মার্টিন রেলে চেপেই গানের শুটিং হবে। কিন্তু শুটিংয়ের দিনই কলকাতায় বন্ধ হয়ে গেল মার্টিন রেল। অগত্যা কৃষ্ণনগরে গিয়ে সেই রেলের ছবি তুলে আনা হয়েছিল। সেই ছবি স্ক্রিনে ফেলে সামনে কাঠের নকল কামরা রেখে ‘টেক’ করা হয় ফুটবলের ওই গান। আর হাড়ভাঙা গ্রামের সেট পড়েছিল হাওড়ার জগৎবল্লভপুরে।

সমর্থন: শহরের বুকে যেন এক টুকরো ব্রাজিল। বিশ্বকাপের মরসুমে এ ভাবেই সেজেছে উত্তর কলকাতার ফকির চক্রবর্তী লেন। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সেখানকার সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবার তথা নারায়ণী ফিল্মস-এর মালিক সত্যনারায়ণ খাঁ-এর বাড়ি, মাঠ ও স্কুলকে ঘিরেই তৈরি হয়েছিল হাড়ভাঙা গ্রাম। উত্তমকুমার, জয়া ভাদুড়ী (বচ্চন), পার্থ মুখোপাধ্যায়, জহর রায়, তপেন চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষদের সঙ্গে অশোকবাবুও সাত দিনের জন্য উঠেছিলেন ওই খাঁ বাড়িতেই। সকাল, বিকেল মিলিয়ে চলেছিল দু’টো ফুটবল ম্যাচের শুটিং। লাইট-ক্যামেরার সামনে হলেও পুরো ৯০ মিনিটই খেলতে হত সকলকে। আর তাতে পার্থ ওরফে বগলা-সহ সকলকেই খেলার কারিকুরি তিনিই শেখাতেন বলে জানিয়েছেন অশোকবাবু।

মাঠের রেফারি, পুরোহিত তোতলা ভট্টাচার্য ওরফে রবি ঘোষ কলকাতার মাঠ থেকেই চিনতেন অশোককে। আর খাঁ বাড়িতে এক ঘরে জহর রায়ের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা আজও ভুলতে পারেন না ওই ব্রাজিলভক্ত। আর জয়া ভাদুড়ী-সহ সকলে যখন গ্রাম ঘুরতে বেরোতেন, অশোকবাবু তখন মোড়ায় বসে উত্তমকুমারের থেকে শুনতেন তাঁর মোহনবাগান প্রেমের কথা। মহানায়কের সঙ্গে তাঁর ছবি টাঙানো ঘরের দেওয়ালে।

এখনও প্রতিদিন পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে ফুটবল খেলে বাড়ি ফিরে দেখতে বসেন বিশ্বকাপ। আর স্মৃতির পাতা ওল্টাতে শোনেন, ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা, বোঝে কি আনজনে...।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE