বিদ্যা-বিপর্যয়: (১) ১ অক্টোবর বেদিচ্যুত হয়েছিল মূর্তি। (২) ৮ জুন ফের আক্রান্ত মনীষীর মূর্তি। (৩) ১৪ মে-ও সেই লজ্জাজনক ঘটনারই পুনরাবৃত্তি।
দিনটা ছিল ২৬ অক্টোবর, ১৯৭০। রাত তখন ১১টা। লালবাজারের কন্ট্রোল রুমে হঠাৎই একটি ফোন এসেছিল। সংশ্লিষ্ট কর্তব্যরত পুলিশকর্মী টেলিফোন তুললে ওপাশ থেকে শুধু বলা হয়েছিল—‘দেখুন কলেজ স্কোয়ারে কারা যেন বিদ্যাসাগর ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মূর্তির মাথা কেটে নিয়ে গিয়েছে।’
পরের দিন, অর্থাৎ ২৭ অক্টোবর তখনকার সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় লেখা হল, ‘এক অক্টোবরের পরে বিদ্যাসাগরের মূর্তির এই দ্বিতীয় লাঞ্ছনা। আগের ঘটনায় ঈশ্বরচন্দ্রের মূর্তি ভুলুণ্ঠিত, বেদিচ্যুত এবং ত্রিখণ্ডিত হয়েছিল তাঁরই সাধের মেটরপলিটন স্কুলের বহুবাজার শাখায় (ক্রিক রো)।’ (ভাষা ও বানান অপরিবর্তিত)। সে বার মূর্তির শিরচ্ছেদ করা হয়েছিল।
তার আট বছর পরে, অর্থাৎ ১৯৭৮ সালের ৯ জুন আবার প্রথম পাতার শিরোনামে বিদ্যাসাগর! সংবাদপত্রে লেখা হল,—‘বিদ্যাসাগরের মাথা আবার কাটা গেল’! লেখা হল,—‘সেই লজ্জাজনক ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। বিদ্যাসাগরের আবার মুণ্ডচ্ছেদ।’ সে বার বিদ্যাসাগরের মূর্তির মাথা ফেলে দেওয়া হয়েছিল গোলদীঘিতে।
ফলে এক বার নয়! কখনও নতুন শিক্ষার প্রবর্তনের জন্য, কখনও ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা না করার জন্য বিরুদ্ধবাদীরা বিদ্যাসাগরের মূর্তিকে ভেঙেছে, কখনও মাথা কেটে নিয়েছে। যে রঙই থাকুক না কেন, একাধিক রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা, তাদের আক্রোশের মুখে পড়তে হয়েছে বিদ্যাসাগরকে!
ইতিহাসের তথ্য বলছে, বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর প্রায় এক মাস পরে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে এক শোকসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সভাতেই বিদ্যাসাগরের মূর্তি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশ্য শুধু বিদ্যাসাগরই নন, ১৮৯১ সালের অগস্টে টাউন হলের ওই সভায় রাজেন্দ্রলাল মিত্রের স্মৃতিরক্ষার প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল বিশেষ কমিটি। সেই কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ। কমল সরকারের ‘কলকাতার স্ট্যাচু’ বইটি থেকে জানা যাচ্ছে, ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা তহবিলে ২,৫০০ টাকা দেন মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ। মহারাজকুমার বিনয়কৃষ্ণ দেব দিয়েছিলেন ১,০০০ টাকা।... সেই অনুষ্ঠানের প্রায় আট বছর পরে সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরবর্তীকালে নানা সময়ে আঘাত নেমে আসতে থাকে বিদ্যাসাগরের মূর্তির উপরে।
কিন্তু বারবার শুধু বিদ্যাসাগরই কেন এই আক্রোশের শিকার?
শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলছেন, ‘‘সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষার পথিকৃৎ এবং সেই শিক্ষার প্রচার ও ভিত্তি নির্মাণে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা সর্বাধিক, এক সময়ে অনেকে এমনটাই মনে করতেন। তাই তাঁদের আক্রোশ গিয়ে পড়েছিল বিদ্যাসাগরের উপরে। সেখানে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী মুক্তি নিয়ে তাঁর ভূমিকা কোনও প্রাধান্যই পায়নি।’’ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি বারিদবরণ ঘোষ বলছেন, ‘‘বিদ্যাসাগর ধর্ম মানতেন না।
তিনি যখন কাশীতে ছিলেন, তখন এক সময়ে তাঁকে বলা হয়েছিল যে কেন তিনি কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরে আসেন না? তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার বাবা-মা-ই বিশ্বনাথ ও ভগবতী।’’ ফলে বিদ্যাসাগর যে আক্রমণের সহজ লক্ষ্য হবেন, এতে আর আশ্চর্যের কী!’’ নারী অধিকার রক্ষা কর্মী তথা শিক্ষক শাশ্বতী ঘোষের আবার পাল্টা প্রশ্ন, বাঙালি সমাজ কি কোনওদিন বিদ্যাসাগরকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান সম্মান দিয়েছে? শাশ্বতীদেবীর কথায়, ‘‘বাঙালি সমাজ কোনও দিনই যুক্তিনিষ্ঠ, কর্মোদ্যোগী, দৃঢ়, শ্লথতাকে ঘৃণা করা বিদ্যাসাগরকে সহ্য করতে পারেনি! বরং তাঁর দৃঢ়তাকে, ব্যক্তিত্বকে বাঙালি সমাজ সব সময় ভয় পেয়েছে।’’
ভয় রয়েছে মনে। তাঁর দৃঢ়তাকে, তাঁর মেরুদণ্ডকে! সেই ভয় পাল্টে যাচ্ছে অক্ষম আক্রোশে, বলছেন বিশেষজ্ঞেরা। আর সেই ভয়ের কারণেই তাঁর মূর্তি ভাঙার প্রথায় ‘লজ্জাজনক ভাবে’ এক হয়ে যাচ্ছে সত্তরের দশক এবং ২০১৯!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy