Advertisement
১৬ মে ২০২৪
শুধু ভাইরাস নয়, তাকে ঘিরে অজস্র প্রতিকূলতা জয় করার কাহিনি
Coronavirus

‘রোগকে রুখতে গিয়ে মনের দূরত্ব যেন তৈরি না হয়’

তিন মাস আগের সেই সব কথা মনে করে কিছু ক্ষণ চুপ হয়ে যান বরাহনগরের বাসিন্দা স্বপন বণিক। প্রায় ২৩ দিন লড়াইয়ের পরে তিনিও করোনা-যুদ্ধের এক জয়ী।

জয়ী: বরাহনগরের বাড়িতে স্বপন বণিক। নিজস্ব চিত্র

জয়ী: বরাহনগরের বাড়িতে স্বপন বণিক। নিজস্ব চিত্র

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২০ ০৪:০৮
Share: Save:

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময়ে তাঁর জ্ঞান ছিল না। দিন আটেক পরে যখন জ্ঞান ফিরেছিল, অবাকই হয়েছিলেন সাতষট্টি বছরের বৃদ্ধ। পরিবারের লোকেরা তাঁকে দেখতে আসবে এমনটা তিনি ভাবলেও, কেউ আসছেন না দেখে। মাঝেমধ্যে অবশ্য হাসপাতাল থেকে ফোনে ছেলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়া হত।

তিন মাস আগের সেই সব কথা মনে করে কিছু ক্ষণ চুপ হয়ে যান বরাহনগরের বাসিন্দা স্বপন বণিক। প্রায় ২৩ দিন লড়াইয়ের পরে তিনিও করোনা-যুদ্ধের এক জয়ী। বলছেন, ‘‘বাঁচার তাগিদ থাকলে তবেই এ লড়াই জেতা যায়।’’

এক সময়ে জেসপে কাজ করতেন স্বপনবাবু। এক বার কোমরের হাড় ভেঙে ছিল তাঁর। তিন বছর আগে ডুয়াল চেম্বার পেসমেকার বসেছে। মৃদু সেরিব্রাল অ্যাটাকও হয়ে গিয়েছে বৃদ্ধের। সিওপিডি এবং উচ্চ রক্তচাপের দীর্ঘদিনের রোগী তিনি। স্বপনবাবুর কথায়, ‘‘করোনায় সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে থাকাকালীন এক রাতে হৃদ্‌যন্ত্রের বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করে চিকিৎসকেরা সেখান থেকেও ফিরিয়ে এনেছেন। তবে আমিও বাঁচার স্বপ্ন দেখতাম।’’

সুস্থ হয়ে স্বপনবাবু জানতে পারেন, রাজ্যের ২০তম ও বরাহনগরে প্রথম করোনা আক্রান্ত তিনি। ২১ মার্চ স্বপনবাবুর ভাই প্রথম জ্বরে আক্রান্ত হন। তার কয়েক দিন আগেই মধ্যপ্রদেশ ঘুরে এসেছিলেন সেই ভাই। জ্বর না কমায় ওই প্রৌঢ়কে ২৩ মার্চ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জানা যায়, তাঁর টাইফয়েড হয়েছে। কিন্তু পরদিন থেকেই নিঃশ্বাসের সমস্যা, ঘনঘন প্রস্রাব, কাশি শুরু হয় স্বপনবাবুর। বাড়িতেই অক্সিজেন সিলিন্ডার এনে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা হলেও, জ্বর আসায় ২৬ মার্চ লেক টাউনের এক বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেই সময় থেকেই তাঁর জ্ঞান ছিল না। ২৯ মার্চ স্বপনবাবুর কোভিড পজ়িটিভ রিপোর্ট আসতেই গোটা পরিবারকে মানসিক চাপের শিকার হতে হয় বলে আজও আক্ষেপ করেন তিনি। স্বপনবাবুর বক্তব্য, ‘‘ভাইয়ের ভিন্ রাজ্য ভ্রমণের কথা গোপন করেছি বলে মিথ্যা অভিযোগ তোলেন প্রতিবেশীরা। সেই সময়ে গোটা পরিবারকে অপরাধী বানানো হয়েছিল।’’

এ দিকে, স্বপনবাবুর করোনা হতেই যৌথ পরিবারের ১৮ জনের অস্থায়ী ঠিকানা হয়েছিল, রাজারহাট কোয়রান্টিন কেন্দ্র। তত দিনে লেকটাউনের হাসপাতাল থেকে বাইপাসের বেসরকারি কোভিড হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে স্বপনবাবুকে। সেখানে জ্ঞান ফেরার পর থেকে সারাক্ষণ উদগ্রীব হয়ে থাকতেন কত ক্ষণে ছেলে বা বাড়ির কেউ তাঁকে দেখতে আসবেন। ছেলে বা অন্যদের সঙ্গে ফোনে কথা হলেও তাঁকে কেউ জানাননি গোটা পরিবারের কোয়রান্টিন কেন্দ্রে থাকার কথা। বরং ছেলে বলতেন, ‘লকডাউন চলছে। তাই বাস, ট্রেন সব বন্ধ। পুলিশ বেরোতে দিচ্ছে না।’ স্বপনবাবু বলেন, ‘‘বাইরের পরিস্থিতি তো জানতাম না। তাই ওঁদের বলতাম অ্যাপ-ক্যাব করে আয়।’’

ওই হাসপাতাল থেকে এক দিনের জন্য বৃদ্ধকে পাঠানো হয়েছিল এম আর বাঙুর হাসপাতালে। সেখান থেকে ফের সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে কয়েক দিন ভর্তি থাকার পরে ১৮ এপ্রিল বাড়ি ফেরেন তিনি।

আগে প্রতিদিন পাড়ার দোকানে বা রাস্তায় বেরোলেও, এখন ঘরেই দিন কাটাচ্ছেন বৃদ্ধ। আত্মীয়, পরিচিতদের সঙ্গে কথা হলেই তাঁদের মনে করোনা ভীতি কাটানোর পরামর্শ দেন তিনি। জানালেন, সংক্রমণ রুখতে মাস্ক পরা, বার বার হাত ধোয়ার পাশাপাশি পাতিলেবুর রস, গরম জল, গোলমরিচ-আদা দিয়ে চা খাওয়াও বেশ উপকারী। নিজেও মেনে চলেন সে সব। এখন দিনে কয়েক বার গরম জলে গার্গল করেন স্বপনবাবু। এক বছরের নাতনি সম্প্রীতিকে কোলে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখানোর ফাঁকে বৃদ্ধ বললেন, ‘‘খেয়াল রাখতে হবে, রোগকে রুখতে গিয়ে মনের দূরত্ব যেন তৈরি না হয়।’’ (চলবে)

আরও পড়ুন: করোনার রিপোর্ট পেতে দশ দিন, ভোগান্তি যুবকের

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Covid-19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE