Advertisement
E-Paper

একাধারে বিতর্কিত ও শ্রদ্ধাভাজন

ঘরানা-রহিত কেউ কেউ ব্যতিক্রমী তকমা পান, কেউ কেউ বা একেবারে একটেরে হয়ে পড়েন, যেমন সমাজ-মনের আলোচক প্রয়াত মানসী দাশগুপ্ত।

গৌতম ভদ্র

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৩৫
আশিস নন্দী

আশিস নন্দী

মানুষের যে কোনও ধরনের সৃজনশীল ক্রিয়াকাণ্ড বা কারুকৃতি প্রথমে মননে জারিত হয়, পরে প্রয়োগে সিদ্ধি পায়। তবে সৃষ্টির এই দ্বিত্ব প্রক্রিয়াতে মাঝে মাঝে খিঁচ থাকে। কিছু তৈরি করতে গিয়ে কোনও না কোনও আদিকল্পের প্রতি একনিষ্ঠতায়, প্রায়োগিক আবৃত্তি ও অভ্যাসের অনুজ্ঞায় আমরা এক ছকে পড়ে যাই। বিষয়ের প্রাচুর্য বা তথ্যের সমাবেশে ছকের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে কিন্তু বৃত্তের ধরাবাঁধা বেষ্টনীর বাইরে যাওয়া অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। ফলে চিন্তা ও চর্চায় প্রায়ই ঘরানা, সিলসিলা বা পারিভাষিক অর্থে ‘প্রস্থান’ বা ‘প্রকৃষ্ট স্থান’ শব্দটি আকার-প্রকার সমেত গেঁড়ে বসে। যে কোনও চর্চায় ঘরানার কার্যকারিতা স্বীকৃত। ঘরানার নির্দিষ্ট অনুশীলনে মেধার পরিশীলন হয়, পরম্পরা সমৃদ্ধ হয়, আলোচনা ও বিশ্লেষণে ঘরানা নির্ণয়ের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্মের স্থানটুকু নির্দেশিত হয়। তবে এ কথাও তো ধার্য যে ঘরানা গণ্ডি দাগিয়ে দেয়, বিশুদ্ধতার দাবি তুলে চেনা ও জানার মধ্যেই ভাবনা ও পরিচিতিকে আটকে রাখে, বাইরের বড় একটা কাউকে গণ্ডির মধ্যে আনতে গররাজি হয়। ঘরানা-রহিত কেউ কেউ ব্যতিক্রমী তকমা পান, কেউ কেউ বা একেবারে একটেরে হয়ে পড়েন, যেমন সমাজ-মনের আলোচক প্রয়াত মানসী দাশগুপ্ত।

ঠিক সে ভাবেই আজকের ভারতের সমাজশাস্ত্রের আলোচনায় আশিস নন্দীর অবস্থান চেনাজানা যে কোনও ‘প্রস্থান’-এর বাইরে, তিনিও নিজেকে সরাসরি ‘ইন্টেলেকচুয়াল স্ট্রিট ফাইটার’ বলতে ভালবাসেন। ওই যুযুধান ভূমিকায় তিনি পরিচিত, মাঝে মাঝেই গণপরিসরে বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসেন; দেওরালার সতীদাহ বা দলিত ও দুর্নীতি, প্রসঙ্গের রকমফের থাকতে পারে। তাঁর লেখার পরিধিও বিস্তৃত ও বৈচিত্রে ভরপুর। জাতীয়তাবাদ ও ‘সেকুলার-ইজ়ম’, রবীন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রশেখর বসু, রামানুজন ও জগদীশচন্দ্র বসুর মতো ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চিন্তকের ভাবনাজগৎ, আইনবিদ রাধাবিনোদ পালের দায়বোধ ও দায়-ভাগ নিয়ে চিন্তা, ক্রিকেট ও চলচ্চিত্রের বিনোদন থেকে আধুনিক কালে হিংসার রাজনীতি ও মনন— নানা রকমারি বিষয় নিয়ে তাঁর একরাশ বই ও প্রবন্ধ আছে। তাঁর রচনার একটি অমনিবাস বেরিয়েছে; আরও চারটি অমনিবাস বেরোতে পারে। অথচ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক জয়ন্তী বসু আশিস নন্দীর লেখার আলোচনা কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সিলেবাসে সরাসরি দেখেননি, আমিও আমার বিদ্যায়তনিক সমাজশাস্ত্রের পাঠ্যক্রমে তাঁর রচনার বড় একটা উল্লেখ পাইনি। তথাকথিত অ্যাকাডেমিক নিরিখে তিনি বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ছুটে বেড়ান, কোনও এক আদি ও অকৃত্রিম আর্কাইভ্স-এ ডুব দিয়ে ধারাবাহিক অটুট বৃত্তান্ত তৈরি করার তাগিদ যেন তাঁর নেই। নানা বিষয়ে চিত্তাকর্ষক মন্তব্য তিনি করতে পারেন কিন্তু গবেষণার অতলান্ত গভীরতা তাঁর রচনায় প্রত্যাশিত নয়। কোনও প্রক্রিয়ার ছকে ঢুকতে তাঁর অনীহা। তা হলে কোন ‘ডিসিপ্লিন’ বা বিদ্যাসংগ্রহের বর্গে তাঁকে কব্জায় আনব?

এই জিজ্ঞাসার ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেই আশিস নন্দীর আশিতম জন্মবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য রূপে প্রকাশিত সঙ্কলনগ্রন্থে বিভিন্ন বিষয়ানুসারী বিদ্যাজীবীরা তাঁদের মত বলেছেন, তাঁদের নিজেদের চিন্তনে ও পাঠাভ্যাসে আশিসের স্বকীয় ভাবনার স্থানটুকু নিয়ে ভেবেছেন। এক জন ফ্যান বা অনুরাগীর খোলা চিঠির ঢঙে লেখা সাবলীল প্রবন্ধে দীপেশ চক্রবর্তী জানিয়েছেন যে কী ভাবে আধুনিকতা ও প্রচলিত সেকুলার-ইজ়মের কিছু গ্রাহ্য ধারণার স্বতঃসিদ্ধতার সমালোচনায় তিনি আশিস নন্দীর তোলা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসায় আলোড়িত হয়েছিলেন। আর্কাইভ্স-এর প্রতি আশিস নন্দীর নিজস্ব ধারণায় দীপেশ অভিভূতও হয়েছেন। কেন না, ভারতে বসেই চারপাশে ছড়ানো ছিটানো অতি সাধারণ সহজলভ্য আকরগুলোকে মথিত করে আশিস নন্দী তাঁর বড় প্রশ্নগুলো ফেঁদেছেন, কোনও এক দুর্লভ দূরস্থিত প্রাসঙ্গিক আর্কাইভ্স না পাওয়ার জন্য তাঁর অন্বেষাকে থামিয়ে দেননি। আর একটি রচনায় ত্রিদীপ সুহ্‌রুদ জানিয়েছেন যে, আশিস নন্দীর ‘ইন্টিমেট এনিমি’ বইটা গুজরাতিতে অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বেশ মুশকিলে পড়েছিলেন, ‘অন্তরঙ্গ অরি’ বলে প্রতিশব্দটা নির্বাচিত করেছিলেন। ওই অনুবাদকর্মের অনুষঙ্গে গাঁধী-মননের অলিগলিতে ত্রিদীপের যাত্রা শুরু হয়। ত্রিদীপ বুঝতে পারেন যে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জেহাদে জাহিরির সঙ্গে তাল রেখে চলছে গাঁধীর অন্তর্যুদ্ধ, যেন এক জেহাদে বা তিনি, মননসত্তার কুমতির বিরুদ্ধে লড়াই, দুই লড়াই অন্যোন্য সম্পর্কে আবদ্ধ। আশিস নন্দীর রচনাসূত্র ধরেই দার্শনিক রঘুরামারাজু দেখিয়েছেন যে বিবেকানন্দের দর্শনচিন্তা ও সমাজচিন্তার টানাপড়েন, নব বেদান্তের প্রয়োগ কী ভাবে মুক্তির আশ্বাস আনে, আবার নতুন ভাবে সামাজিক থাকেরও সৃষ্টি করে।

শ্রদ্ধার্ঘ্যের এই সঙ্কলনগ্রন্থে আরও কিছু প্রবন্ধ আছে, সবগুলিতে রুচিভেদে সমান পাঠসুখ হয় না। দাদা আশিস নন্দীর ব্যক্তিস্বভাব ও চিন্তার অভ্যাস নিয়ে ভাই মনীশ নন্দীর স্মৃতিচারণটি মনোজ্ঞ। আর এক জন বিখ্যাত সমাজশাস্ত্রী মাইসোর নরসিংহাচার শ্রীনিবাসের দু’টি গল্প ও তাঁর নৃবিজ্ঞানের উপর রচা গ্রন্থের উপর ত্রিলোকীনাথ মদন-এর একটি পূর্বপ্রকাশিত প্রবন্ধ সঙ্কলনগ্রন্থে জায়গা পেয়েছে। শ্রীনিবাসের লেখা দু’টিমাত্র ছোটগল্প কল্পনার সূত্রে তাঁর নৃতত্ত্বচিন্তার ফাঁকফোকরকে ছুঁয়ে যায় কি না, সেটাই মদনের উপজীব্য বিষয়। সেই টানেই প্রাতিভ দৃষ্টি উদ্ভাসনের কথাটুকু বলেই মদন থেমে গিয়েছেন, নন্দী বা নৃতত্ত্ববিদ গণনাথ ওবেসেকেরের সাম্প্রতিক বক্তব্যের সঙ্গে একদম বহসে যাননি। ঠিক সে ভাবেই প্রাত্যহিক হন্টন বা পা-চালির দর্শন নিয়ে শিব বিশ্বনাথন একটি আকর্ষক বিষয়ের আলোচনা শুরু করেছিলেন, তবে বিষয়টাকে বেশি ঠেলেননি, পা চালিয়ে পৌঁছননি কোনও এক বৌদ্ধবিহারে, যেখানে সঙ্ঘারামের অনুশাসনে ভিক্ষুদের প্রাত্যহিক বেড়ানো যাপিত জীবনের অঙ্গ ছিল। শরদিন্দুর ‘গৌড়মল্লার’ উপন্যাসে রক্তমৃত্তিকা বিহারে বজ্র-এর চোখে সেই দৃশ্যই প্রথমে ধরা পড়েছিল।

সবচেয়ে বেমানান লাগে বইয়ের প্রচ্ছদেই একটি দাপুটে ঘোষণা, ‘‘আশিস নন্দী স্ট্যান্ডস অ্যাজ় দ্য ফ্রানৎজ় ফ্যানন অব আওয়ার টাইম’’। পণ্যবাজারে বই-ও পণ্য, হাজার ইচ্ছা থাকলেও চটজলদি তকমার ছাপ এড়ানো মুশকিল।

বই পড়ার টানেই ঢুকে পড়ে অন্য বই। আশিস নন্দীর একটি সেরা বই বাংলা ভাষায় দেওয়া এক পুস্তিকাসদৃশ সাক্ষাৎকার, জয়ন্তী বসু ছিলেন প্রশ্নকারী, বছর তিনেক আগে বেরিয়েছিল। [দ্রষ্টব্য, ‘ফুটপাথ পেরোলেই সমুদ্র: আশিসবাবু আপনি কি আত্মগত?’, তালপাতা, ২০১৫]। এই জমাটি আলাপচারিতাকে আশিস নন্দী নিজের প্রথম বাংলা বই বলেছেন, আমিও এই রকম সৃষ্টিশীল আত্মসমীক্ষা কম পড়েছি। শ্রদ্ধার্ঘ্যের সঙ্কলনে অবশ্য কেউই এই রচনার কথা উল্লেখ করেননি, সঙ্কলনে মুদ্রিত সাক্ষাৎকারটিতে আশিসও নীরব থেকেছেন। বাংলা সাক্ষাৎকারে আশিস জানিয়েছেন যে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে সব রকম ছোটাছুটির মধ্যে তাঁর অন্বেষার দিশাটি অটুট আছে। সেটা হল আধুনিকতার সঙ্গে টানাপড়েনের রাজনীতির মাধ্যমে ভারতীয় ‘ব্যক্তিক ও সমষ্টিগত’ মননের গঠন বিচার করা। সেই মননের প্রকাশ তো নানা ভাবে সমাজজীবনের নানা কর্মকাণ্ডে ধরা পড়া, বিদ্যাজীবীর কাজ হল তাকে দেখতে, শুনতে ও পড়তে জানা।

এই সব জানার প্রাকশর্ত হচ্ছে নিয়ত পরিপ্রশ্ন করার তাগিদ, তা হলেই ‘ঠুনকো, বস্তাপচা’ আদর্শবাদ ও অনিবার্য, স্বয়ংসিদ্ধ প্রগতিবাদের ঘোমটা খুলে যাবে। লেখার মাধ্যমে পরিপ্রশ্ন করার তাগিদটুকু আশিস তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের নানা জিজ্ঞাসুর মধ্যে চারিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, তাঁর মতে, কোনও আধুনিকতা নিখাদ নয়, সব আধুনিকতাই নিজের মতো করে পুরাণ তৈরি করে, কোনও পরিচয়ই নিটোল নয়। ‘পর’ তো বাইরে নেই, আত্মতেই নিহিত আছে। আমাদের নিজেদের স্বাদেশিকতায় গডসের প্রতীতি তো গাঁধীর প্রতীতির প্রতিবেশী, হিংসার প্রণোদনায় শুধু অন্যের শয়তানি ষড়যন্ত্রের উস্কানি খোঁজাটা নিজের মনকে চোখ ঠারা মাত্র। এই বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আশিস নন্দী তাঁর বিশ্লেষণে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক উপযোগিতা থোড়াই কেয়ার করেছেন, সেই জন্য তিনি বিতর্কিত ও শ্রদ্ধাভাজন।

সমাজ-মননের তাত্ত্বিক রূপে আশিস আধুনিকতার যুক্তিভূমি ও কল্পভূমির সংযোগ ও সমবায়ের মধ্যে অসম মিশ্রণ ও বিষম হিক্কাকে চিহ্নিত করে থাকেন। একাধারে যুক্তিবাদী হিংস্রতা ও কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর কল্পবাদী ঈপ্সার বিরুদ্ধেই তিনি ‘স্ট্রিট ফাইটার’। তবে তাঁর জেহাদেও নৈতিকতা আছে, তা হল সমাজে সমানুভূতি ও সহানুভূতির চর্চা করা। হয়তো বা তাঁর ঈপ্সাতে বৌদ্ধ করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষার ছায়া আছে, ছায়াটি অস্পষ্ট, ধূসর। আশি বছর বয়সেও আশিস নন্দী অন্বেষায় সচল, পরিপ্রশ্ন করার প্রত্যয়ে অবিচল। বর্তমান ভারতে তাঁর মতো লেখক কমই আছেন, যাঁর লেখা পড়ে শত বৈমত্য থাকা সত্ত্বেও পাঠকের মনে একটি শ্লোক গুনগুনিয়ে ওঠে, ‘‘তরবোহপি হি জীবন্তি, জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ। স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি।।’’

Ashis Nandy আশিস নন্দী Book review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy