Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

বিশ্ববিদ্যালয়-নগরীর ইতিহাস

চৈতন্যচরিতে প্রথমে রূপ ও পরে সনাতনের শিক্ষার এই যে বিবরণ রয়েছে, তা থেকে জ্ঞানপীঠ নবদ্বীপের বিদ্যাচর্চার রীতি-প্রথার আভাস পাওয়া যায়। রূপের শিক্ষা শুরু হয় রামকেলিতে এক জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তিতে। সনাতনের কাশীতে, এক মকর সংক্রান্তির পরে।

ভক্তি: শ্রীচৈতন্যের নগর-সংকীর্তন। দীনেশচন্দ্র সেনের বৃহৎ বঙ্গ  (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থ থেকে গৃহীত প্রাচীন চিত্রের অংশ।

ভক্তি: শ্রীচৈতন্যের নগর-সংকীর্তন। দীনেশচন্দ্র সেনের বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থ থেকে গৃহীত প্রাচীন চিত্রের অংশ।

অলখ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

নবদ্বীপ বিদ্যাসমাজের ইতিহাস

যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী

৬০০.০০

নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ (পরি: অক্ষর প্রকাশনী)

ভরা জ্যৈষ্ঠ। সমুদ্রের বালি আগুনের মতো তেতে। প্রভুর ডাক শুনে তার উপর দিয়েই ছুটছেন সনাতন। তাঁর প্রভু জানেন, ‘‘তপ্ত বালুকায় তোমার পায়ে হৈল ব্রণ।’’ কিন্তু ‘‘চলিতে না পার কেমনে হইল সহন।।’’ সনাতন জানালেন, কষ্ট তিনি বুঝতেও পারেননি। জড়িয়ে ধরলেন তাঁর প্রভু আর তাতে সনাতনের শরীরের ‘‘কণ্ডুরসা প্রভুর শ্রীঅঙ্গে লাগিল।’’ আর এর পরেও সনাতনের পরীক্ষা শেষ হল না।

চৈতন্যচরিতে প্রথমে রূপ ও পরে সনাতনের শিক্ষার এই যে বিবরণ রয়েছে, তা থেকে জ্ঞানপীঠ নবদ্বীপের বিদ্যাচর্চার রীতি-প্রথার আভাস পাওয়া যায়। রূপের শিক্ষা শুরু হয় রামকেলিতে এক জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তিতে। সনাতনের কাশীতে, এক মকর সংক্রান্তির পরে। সংক্রান্তি, নদী-সন্ধি তাঁর জীবনে বার বার এসেছে।

বৃন্দাবন যাওয়ার পথে কাশী গিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। মধ্যাহ্নে, এত ঘাট থাকতে, স্নান করলেন শ্মশানঘাট মণিকর্ণিকায়। স্মর্তব্য, তাঁর পূর্বাশ্রমের নামের সঙ্গে কার্ষ্ণ সম্পর্ক খুব কম। তাঁরই একটি নাম ছিল বিশ্বম্ভর। এমনকি, মায়ের নাম শচী, পিতার একটি নাম পুরন্দর, মাতামহের নীলাম্বর, মাসির সর্বজয়া ও মেসোমশায়ের চন্দ্রশেখর। সেই তিনি স্নানান্তে প্রথমে বিশ্বেশ্বরের কাছে যান, তারপরে বিন্দুমাধবে। কিছু দিন পরে গেলেন বৃন্দাবনে। রঘুনাথদাস গোস্বামীর সাক্ষ্য থেকে অনুমান করা যায়, ‘‘প্রকাণ্ড শরীর শুদ্ধ কাঞ্চন-বরণ আজানুলম্বিত ভুজ কমল-নয়ন’’ সেই সন্ন্যাসীর পোশাক বলতে ছিল কৌপীন আর অরুণ বর্ণের বহিঃবস্ত্র। ভিড় তো হবেই। সেই ভিড় ঠেলে প্রয়াগে এসে মকর সংক্রান্তিতে স্নান করলেন। শরীর ক্লান্ত। তবু ‘‘রূপগোসাঞিরে শিক্ষা দেন শক্তি সঞ্চারিয়া।।’’ কৃষ্ণভক্তি, ভক্তিতত্ত্ব এবং রসতত্ত্বের প্রান্ত পর্যন্ত উজাড় করে দিলেন রূপকে— ‘‘প্রভু কহে শুন রূপ ভক্তিরসের লক্ষণ। সূত্ররূপ কহি বিস্তার না যায় বর্ণন।’’

চরিতকাব্যে তখন বার বার বলা হচ্ছে, চৈতন্য তাঁর মত গ্রন্থে বাঁধতে চাইছেন। অনুমান করা যায়, ভক্তিতত্ত্বের যে রূপ মনে তৈরি রয়েছে, তার যে একটি তাত্ত্বিক প্রকাশ দরকার, তার যে ব্যাখ্যা প্রয়োজন, সেই ব্যাখ্যা প্রমাণ-সাপেক্ষ ও সেই প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ডে স্বীকৃত হতে হবে, তা নবদ্বীপের সন্তান চৈতন্য তখন মনে করছিলেন। প্রয়াগে দশ দিন ধরে রূপের কাছে সেই ভাবনার একটি সূচিই যেন তাই তিনি স্থির করলেন।

এই যে আগে সূচি তৈরি করে নেওয়া, এই হল নবদ্বীপের অভ্রান্ত স্বাক্ষর। চিন্তা-শৃঙ্খলা সূচিতে বিন্যস্ত করার পরে পাঠবস্তু ও গ্রন্থকর্তাও বিন্যস্ত করলেন। কাশীতে ফিরলেন। কবিকর্ণপূরের শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয়-এর মতে, সনাতনের সঙ্গে চৈতন্যের দেখা হয়েছে একেবারে কাশীতেই। সেখানেই দু’মাস ধরে সনাতন পাঠ পেলেন। তাঁর পাঠবস্তু যে পৃথক, তার একটি উদাহরণ, কৃষ্ণদাসের বিবরণ মতো, প্রয়াগে রূপকে যে প্রায় সওয়াশো লাইন বলেছিলেন, তার মধ্যে ‘রস’ শব্দটি আলাদা করে বা যুক্ত ভাবে মোটামুটি কুড়ি বার উল্লেখ করেছেন। সনাতনের ক্ষেত্রে মোটামুটি প্রথম ছ’শো লাইনে শব্দটি এসেছে মাত্র বার দু’য়েক।

তখন প্রপাতের মতো তাঁর একটির পর একটি মত আছড়ে পড়ছে। চিন্তার প্রচণ্ড ও মধুর সংঘাত তাতে ধরা পড়ছে। এক বার বলছেন ‘আমি ত বাউল’, তাই ‘আন কহিতে আর’ বলেন। অর্থাৎ, চিন্তাশৃঙ্খলার বিপর্যয় ঘটাতে পারে এমন অবস্থাকে তিনি চিহ্নিত করতে চাইছেন, হয়তো একই সঙ্গে নতুন শৃঙ্খলা রচনাও করছেন। কৃষ্ণমাধুর্যের বিবরণ দিচ্ছেন, ‘‘যেই স্মিত জ্যোৎস্নাভার মধুর হৈতে সুমধুর তাতে হৈতে সুমধুর তাতে হৈতে অতি সুমধুর।’’ কিন্তু সনাতন এর পরে যখন সেই প্রসঙ্গ তুলছেন যে, বাসুদেব সার্বভৌমের কাছে তিনি একটি শ্লোকের আঠারোটি ব্যাখ্যা করেছিলেন, সেই শ্লোকটিরই এ বার একষট্টি রকম ব্যাখ্যা দিলেন তাঁকে। এই যে একটি শ্লোকের এত রকম ব্যাখ্যা, তাতে তো বিদ্যাশর্তের নানা শৃঙ্খলা মেনেও নিচ্ছেন চৈতন্য। আবার পরক্ষণেই অনায়াসে ভেঙে দিচ্ছেন শর্ত সমূহ। বলছেন, কৃষ্ণের বাঁশির ‘ধ্বনি বড় উদ্ধত’। কতটা উদ্ধত? বলছেন, ‘‘লোকধর্ম লজ্জাভয় সব জ্ঞান লুপ্ত হয় ঐছে নাচায় সব নারীগণে।।’’ কিন্তু আবার, যখন সনাতনকে বললেন, ‘‘ভক্তিস্মৃতি-শাস্ত্র করি করিহ প্রচার’’, অর্থাৎ সরাসরি বই লিখতেই নির্দেশ, তখন লোকধর্মের কথা এতটাই কঠিন ভাবে বলছেন— ‘‘সর্বত্র প্রমাণ দিবে পুরাণবচন। শ্রীমূর্তি বিষ্ণুমন্দির চরণ-লক্ষণ।। সামান্য সদাচার আর বৈষ্ণব আচার। কর্তব্য অকর্তব্য স্মার্ত ব্যবহার।।’’ যে নির্দেশ পরে মানা হল হরিভক্তিবিলাস-এ। কী ভাবে দাঁত মাজতে হবে, তারও নির্দেশ রয়েছে সেখানে। কিন্তু কেন পুরাণ? কেন ষড়দর্শন, বেদ নয়? সে তর্ক তোলা থাক, কিন্তু বার বার কৃষ্ণের সঙ্গে সূর্যের তুলনা যে তিনি করছেন, তা থেকে বোঝা যায়, সংহিতা ও উপনিষদে অবগাহন করেছেন।

সনাতনের শরীরও খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল চৈতন্যের কাছে। বলছেন, ‘‘মুঞি যে শিক্ষাইনু তোরে স্ফূরুক সকল। এই তোমার বল হৈতে হবে মোর বল।’’ তাই আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রয়োজন। নীলাচলে সনাতনকে চৈতন্য ছাড়তে চাইলেন না— ‘‘প্রভু কহে তোমার দেহ মোর নিজ ধন।... তোমার শরীর মোর প্রধান সাধন। এ শরীরে সাধিব আমি বহু প্রয়োজন।।’’ হরিদাসও সনাতনকে বললেন, ‘‘তোমার দেহ কহে প্রভু মোর নিজধন। তোমা সম ভাগ্যবান নাহি কোনজন।’’ সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সনাতন দায়িত্ব পেলেন ‘‘ভক্ত ভক্তি কৃষ্ণপ্রেম তত্ত্বের নির্ধার’’ রচনার।

নবদ্বীপের এই পাঠ প্রক্রিয়া শুধু চিন্তার বহুত্বকে স্বীকারই করে না, সংঘাতকালীন পর্বেও এই যে তা শৃঙ্খলা বিচারে সমর্থ ও চরিত্র ধরে রেখেই পরস্পরে লীন, তা বিশ্ববিদ্যালয়প্রতিম।

সেই বিশ্ববিদ্যালয়-নগরীর ইতিহাস রচনার মতো প্রচণ্ড একটি কাজ করেছেন প্রবীণ একনিষ্ঠ গবেষক যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী। দীর্ঘকালের চেষ্টায় তিনি এই জনপদটির বিদ্যাসমাজের নানা পরিচয় তুলে ধরেছেন অশেষ প্রয়াসে। নবদ্বীপে নানা মতের যে সংঘাতের কথা এত ক্ষণ বলা হল, তার আলাদা আলাদা স্রোতকে বিচার করেছেন। নবদ্বীপ বিখ্যাত ন্যায়, বিশেষ করে নব্যন্যায় ও স্মৃতির চর্চায় এবং এই নগরীতেই ছিলেন তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। যজ্ঞেশ্বরবাবু এই সব দিক ধরে ধরে আলোচনা করেছেন। নৈয়ায়িক বাসুদেবের কথা বলে পরের অধ্যায়ে মহানৈয়ায়িক বলে খ্যাত রঘুনাথ শিরোমণির কথা বলেছেন। শিরোমণির পরবর্তী কালের কথা বিস্তারিত ভাবে বলার পরে চলে গিয়েছেন স্মার্ত রঘুনন্দনের প্রসঙ্গে। আর তার পরে একাদশ অধ্যায়ে পৌঁছেছেন তন্ত্রচর্চা ও আগমবাগীশের কথায়। এর পরে তুলনামূলক ভাবে আধুনিক কালে এসে তাঁর আলোচ্য নবদ্বীপের ব্যাকরণ চর্চা।

অর্থাৎ, নবদ্বীপের প্রবাদপ্রতিম সন্তানদের নিয়ে নানা তর্কের যেমন তিনি জবাব খুঁজেছেন, তেমনই এক রকম অনালোচিত পণ্ডিতদেরও নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এ কাজ অত্যন্ত কঠিন। প্রত্যেকের সম্পর্কে যেটুকু সংবাদ পাওয়া যায়, তা তাঁকে আলাদা আলাদা করে বিচার করতে হয়েছে। তাঁদের রচনা থেকে খুঁজে পেতে হয়েছে চিন্তার ধরন। সারা ক্ষণ জট ছাড়াতে হয়েছে অজস্র প্রবাদের। কোন বই কে লিখেছেন, তা নিয়েও রয়েছে একাধিক তর্ক। যজ্ঞেশ্বরবাবু সেই সব তর্ককে ছুঁয়ে গিয়েছেন, এইটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chaitanya Mahaprabhu Book Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE