খবরের কাগজের পাতায় অর্থনীতির চর্চা মানেই যেন বৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতি, আর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্যের মতো জটিল বিষয় নিয়ে নীরস কচকচি। খানিকটা বিষয়জ্ঞান না থাকলে যার রসগ্রহণ করা মুশকিল। কিন্তু, অর্থনীতি মানেই কি এমন সব খটমট বিষয়? সাধারণ জীবনের দৈনন্দিন ঘটনা, ভেবেচিন্তে বা চটজলদি নেওয়া সিদ্ধান্ত আর সেই সিদ্ধান্তের ঠিক-ভুল— এ সব মজাদার হিসাবনিকাশ কি অর্থনীতির আওতায় পড়ে না? শাস্ত্রটির কারবারিরা সজোরে বলবেন, পড়ে। কাজ ফেলে রাখলে পরে পস্তাতে হয় জেনেও কেন ‘আজ করছি’, ‘কাল করব’ বলে আলসেমি করে মানুষ? ডায়েটিং করতে করতেও কেক বা ফ্রায়েড চিকেন দেখে হাত বাড়ায় কখন? অফিসের ক্যাশবাক্স ভেঙে টাকা নেওয়ার কথা ভাবতে পারে না যে মানুষ, সে-ই কী ভাবে অফিস থেকে ছেলের হোমওয়ার্কের প্রিন্ট আউট নিয়ে আসতে পারে অদংশিত বিবেকে? কাটমানি নিয়ে কখন হইচই হয় আর কখন হয় না? পরীক্ষার রেজ়াল্টে নম্বরের বন্যা বইলে আসল ক্ষতি কার? কন্যাসন্তান জন্মালে তাকে খুন করার কথা ভাবতে পারে না যে পরিবার, তারাই কী ভাবে নির্দ্বিধায় কন্যাভ্রূণ হত্যা করে?
এই সব প্রশ্নের নিয়মছুট ব্যাখ্যার সন্ধানেই মসিক্ষয় করছে অর্থনীতির একটি শাখা। ইদানীং কালে ‘বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স’ বা আচরণবাদী অর্থনীতি নামক সেই শাখাটির বাড়বাড়ন্তও হয়েছে দেখার মতো। সে বিষয়ে সহজবোধ্য বই ইংরেজিতে বেশ কয়েকটি থাকলেও বাংলায় এত কাল ছিল না। সেই অভাব মিটিয়ে দিয়েছে অমিতাভ গুপ্তের সাম্প্রতিক বইটি। বইটির নামের মতোই আকর্ষণীয় তার লিখনশৈলী। বৈঠকি চালে লেখা এই সঙ্কলনের ৩৩টি প্রবন্ধই আগে প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা-র উত্তর-সম্পাদকীয় বিভাগে। প্রতিটি লেখাই এক চায়ের দোকানের আড্ডার প্রতিলিপি। আড্ডার কেন্দ্রে অর্থনীতির অধ্যাপক-গবেষক শিবু সেন বা শিবুদা, শিক্ষিত বাঙালি— লেখকের ভাষায়, ‘যতখানি বাঙালি ততখানিই শিক্ষিত’।
বিদ্বেষদীর্ণ পৃথিবীতে শিবুদার রাজনীতি বিভাজন-বিরোধী। তাঁর তিন শাগরেদ— তপেশ, শিশির আর সূর্য। ফেলুদা, ঘনাদা এবং চাচা কাহিনী-র চাচার ‘সাইডকিক’দের নামে তাদের নাম। ঘনাদা, টেনিদা, তারিণীখুড়ো, জপেনদা— বাংলা সাহিত্যে আড্ডাবাজ দাদা বা খুড়ো আমরা অনেক দেখেছি। লেখক সেই দাদা-সংস্কৃতির রেশ ধরেই নির্মাণ করেছেন শিবুদার চরিত্রটি। এক-একটি প্রবন্ধে আধুনিক পৃথিবীর এক-একটি সমস্যা বা প্রশ্নের সমাধান খোঁজা হয়েছে আচরণবাদী অর্থনীতির যুক্তি ব্যবহার করে। সেই লক্ষ্যে লেখক নিঃসন্দেহে সফল। অমিতাভ তাঁর ভূমিকায় বলেছেন যে, তিনি সাহিত্যিক নন— কলমের জোরে উত্তর-সম্পাদকীয়ের সীমিত পরিসরে একেবারে নতুন চরিত্র সৃষ্টি করা তাঁর সাধ্যাতীত। তাই সিনেমা এবং সাহিত্যের চেনা চরিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য এবং মুদ্রাদোষ তিনি শিবুদার মধ্যে সচেতন ভাবেই ঢুকিয়ে দিয়েছেন। শিবুদার মধ্যে নায়ক সিনেমার অরিন্দম আছে, দেয়া নেয়া-র কমল মিত্তির আছেন, বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত দাদারা তো আছেনই। তবে, লেখকের এই স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও বলতে হয়, তাঁর অনেক লেখাই প্রসাদগুণে আধুনিক কালের বাজারচলতি সাহিত্যকে লজ্জায় ফেলে দিতে পারে। ‘পিসিমার বিষয় আশয়’ নামের রসসিক্ত প্রবন্ধটি যেমন। শিক্ষিত বাঙালির মিউচুয়াল ফান্ড এবং শেয়ার বাজারে আগ্রহ সম্পর্কে শিবুদা বলেন, “ভেবে দেখ, যে শেয়ার বাজারের কথা শুনলেই বাঙালির চোখের সামনে গন্ডেরিরাম বাটপারিয়ার ছবি ভেসে উঠত, তাকে খলে বেটে মধু দিয়ে মেড়ে তামা তুলসী ছুঁইয়ে পুরিয়া বানিয়ে ঘরে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া কি মুখের কথা? শুধু বাঙালি বলে তো নয়, দুনিয়ার সর্বত্র শেয়ার বাজারের সঙ্গে এক কালে যাদের ভাশুর-ভাদ্রবউ সম্পর্ক ছিল, সবাই এসআইপি করছে এখন।” বাংলা গদ্যশৈলীর উদাহরণ হিসাবে আমার তো এটা বেশ পছন্দই হল।
বিফলে মূল্য ফেরত
অমিতাভ গুপ্ত
৩২৫.০০
সৃষ্টিসুখ
প্রবন্ধগুলি বইয়ের আকারে সঙ্কলিত করার সময়ে বিস্তৃত তথ্যসূত্র দিয়েছেন লেখক, অনেক সময় কিউআর কোড সমেত। বাংলা প্রকাশনায় এই নিষ্ঠা ও সততা বিরল। সযত্নে চিহ্নিত এই তথ্যসূত্রে আচরণবাদী অর্থনীতির প্রথম সারির গবেষণার স্বাদ পাওয়া যায়। গভীর বিষয়জ্ঞান থাকায় লেখক অনায়াসে মিলিয়ে দেন সেই গবেষণার সঙ্গে সমসময়ের রাজনীতি এবং সমাজের নানা গুরত্বপূর্ণ বিষয়কে। আচরণবাদী অর্থনীতিতে যা ‘ডিকয় এফেক্ট’ তা-ই যে বাংলায় ‘ধোঁকার টাটি’, সে কথা বুঝিয়ে দিয়ে লেখক দেখান, মোদীর কেন যোগীকে চাই। ‘প্রাইস অ্যাঙ্কর’-এর ধারণার অবতারণা করে দেখান, বছরের পর বছর শ্যাম্পুর স্যাশে-র দাম এক টাকাতেই কেন আটকে থাকে। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতেই হয় বারো পাতার সুলিখিত ভূমিকাটির কথা। লেখক বুঝিয়ে দেন, মগজের কাজ অনুযায়ী তাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়— চটজলদি সিদ্ধান্ত বা ধারণার জন্য ‘সিস্টেম ওয়ান’। আর জটিল ভাবনাচিন্তার জন্য ‘সিস্টেম টু’। বইটি মূলত সিস্টেম ওয়ান-এর ভুলভ্রান্তির কথা বলে।
খবরের কাগজের লেখার ভবিতব্য যে ঠোঙা হওয়া, লেখক সে আক্ষেপ ভূমিকাতেই করেছেন। কিন্তু সমসময়ের কথা বলেও কোনও কোনও লেখা হয়ে ওঠে তাৎক্ষণিকতা-দোষমুক্ত। এই বইয়ের প্রবন্ধগুলিও ফিরে ফিরে পড়া যায়। শিবুদার আলোচনা একটি বিশেষ প্রেক্ষিত বুঝতে ভাবনার একটা কাঠামোর সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটায়। সেই সূত্র ধরে অন্য নানা প্রশ্নের উত্তর পাঠক নিজেই খুঁজে নিতে পারবেন। বইটির মুখবন্ধে অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু যথার্থই বলেছেন, এই বইয়ে “আচরণবাদী অর্থনীতির মূলে থাকা ধারণাগুলিকে সহজ বুদ্ধিদীপ্ত ভঙ্গিতে আলোচনা করা হয়েছে— সেই ধারণাগুলিকে গেঁথে দেওয়া হয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন অতিপরিচিত ঘটনার সঙ্গে।”
বইটির চমৎকার প্রবন্ধগুলির মধ্যে একটি আমার বিশেষ পছন্দের। প্রবন্ধটির নাম, ‘নিজের ক্ষমতায় উন্নতি’। বলিউডের ‘নেপোটিজ়ম’ প্রসঙ্গে শিবুদা তপেশ, শিশির আর সূর্যকে বুঝিয়ে দেন, আমরা প্রত্যেকেই সামাজিক মইয়ে আমাদের চেয়ে উপরে থাকা মানুষগুলোর ‘প্রিভিলেজ’ বা অনর্জিত সুবিধা দেখতে পাই। বর্ণহিন্দু উচ্চবিত্ত পুরুষ হিসাবে নিজেদের জন্মগত সুবিধাগুলো যে তপেশরা দেখতে পাচ্ছে না, শিবুদা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। তাতে যে তপেশদের অস্বস্তি হয়, শিবুদা তার কারণও ধরিয়ে দেন। জীবনে যা হয়েছে তার সবটুকুই কঠোর পরিশ্রমের ফলে নয়, বরং অনেকটাই অনর্জিত, জন্মগত সুবিধার ফলে, তা মেনে নিতে আমাদের আঁতে লাগে। নিজেকে সৎ এবং ন্যায্য লোক হিসেবে দেখতেই আমরা ভালবাসি।
পড়তে পড়তে ভাবি, কেমন হত যদি শিবুদার দলের সবাই উচ্চবর্ণ হিন্দু পুরুষ না হয়ে অন্তত এক জন মহিলা বা তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য থাকতেন। তা হলে কি শিশির একই ভাবে ‘ওয়াইফ-জোক’ বা ‘বৌ-ঠাট্টা’ করতে পারত? লেখকের দোষ নেই। পুরুষদের আড্ডার বাস্তবচিত্র তৈরি করতে হয়তো এমন রসিকতার অবতারণা করতেই হত। ‘মুখ দেখে লোক চেনেন?’ প্রবন্ধটিতে শ্রুতি নামের একটি কাল্পনিক মহিলা চরিত্রের কথা আছে, যার বয়স এখন ত্রিশ বছর। অর্থনীতির ছাত্রী ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সক্রিয় ভাবে বামপন্থী রাজনীতি করত, সমকামী অধিকারে বিশ্বাসী, হিন্দুত্ববাদ বিরোধী, কাশ্মীরে মিলিটারির দাপাদাপিতে প্রবল ক্ষুব্ধ, মুসলমান বয়ফ্রেন্ড ছিল। মনশ্চক্ষে দেখি, গোপালের দোকানের বাইরে শিবুদার থেকে সিগারেটের কাউন্টার চেয়ে দুটো পারফেক্ট রিং ছাড়ছে শ্রুতি।
শিবুদা তো বাংলা সাহিত্যের চেনা দাদাদের মতো নিছক পাড়ার দাদা নন। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করা নিয়ে তিনি গালগল্পও দেন না। তিনি সত্যিই বিশ্বের নামজাদা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফারেন্সে যান, বিশ্বের জ্ঞানী-গুণিজনদের সঙ্গে তাঁর নিত্যি ওঠাবসা। তাঁর বন্ধুবৃত্তে আর একটু বৈচিত্র আসুক, লেখকের কাছে এটুকু আর্জি রাখলাম। তবে এ নেহাত পাঠকের আবদার, আসল ‘পয়েন্ট’ থেকে সরে আসা। সমস্ত দিক বিচার করে বলতেই হয়, ঝকঝকে ছাপা, সম্পাদনার ভুল প্রায় নেই, ১৯৯ পাতার এই বইটি এক বার হাতে নিলে নামিয়ে রাখা মুশকিল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)