বাংলা নাটক ও থিয়েটার নিয়ে যত বইপত্র প্রকাশ পেয়েছে, তাতে এখনও পর্যন্ত দু’টি ধারা লক্ষ করা যায়। এক: কিছুটা সালতারিখের ভিত্তিতে থিয়েটারের ইতিহাস-পরম্পরা পাঠককে ধরিয়ে দেওয়া, দুই: নাটক ও নাটককারকে তাঁদের সমাজ-রাজনৈতিক অবস্থান থেকে চিনিয়ে দেওয়া। কিন্তু কেন, কোন তাগিদ থেকে বিজন ভট্টাচার্য, বাদল সরকার, উৎপল দত্ত বা মোহিত চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্রের মতো নাটককাররা একের পর এক নাটক লিখেছেন, সেগুলি থিয়েটারে কোন ধাক্কা তৈরি করেছিল— সে দিক থেকে জটিল গবেষণার বাইরে আকর্ষণীয় আলোচনা তেমন হয়নি। হয়নি আরও অনেক কিছুই, যেমন অজিতকুমার ঘোষের বাংলা নাটকের ইতিহাস বইটি কেবল সংস্করণের পর সংস্করণ মুদ্রিত হয়েছে, কিন্তু যে পর্যন্ত ওই আলোচনা হয়েছিল তার থেকে আরও এগিয়ে কিছু লেখা হয়নি। শঙ্কর ভট্টাচার্যের পর ১৯১৯-পরবর্তী বাংলা রঙ্গালয়ের ইতিহাসের উপাদানও আর সঙ্কলিত হয়নি।
বরং আগে বলা কথা আবার বলা হয়েছে। বলেছেন এক-এক লেখক এক-এক অভিপ্রায়ে। যেমন অজিতকুমার ঘোষেরই ছাত্র ও পদাঙ্ক-অনুসারী দর্শন চৌধুরী। থিয়েটার বিষয়ে তাঁর আলোচনাগ্রন্থ সংখ্যায় অনেক হলেও গণনাট্য আন্দোলন, নবান্ন নাটক বিষয়ে তাঁর মূল্যবান গবেষণা ছাড়া অন্যান্য লেখায় তিনি প্রধানত পাঠককে, বা বলা যেতে পারে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস মাথায় রেখে রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস আলোচনা করেছেন। এক-এক জন নাট্যব্যক্তিত্বের কাজ নিয়েও এমন আলোচনা আছে তাঁর।
আলোচ্য বইটিও সেই গোত্রের। প্রসেনিয়াম-পর্বের ১৯টি (কেন জানি না গ্রন্থকার ১৩৫ পৃষ্ঠায় আলোচিত নাটকের সংখ্যা জানিয়েছেন ১৫টি), অ-প্রসেনিয়াম পর্বের ২৩টি এবং আরও কিছু নাটকের আলোচনা করেছেন তিনি। এই ভাবে সব নাটকের আলোচনা আগে পাওয়া যায়নি। অতিরিক্ত প্রাপ্তি: আলোচনার শুরুতে প্রতিটি নাটকের রচনা, প্রকাশ ও অভিনয়কাল-অভিনয়-সমবায়ের নাম; নাটকের মূল সূত্র কোনও চলচ্চিত্র হলে তারও উল্লেখ করেছেন লেখক।
নাট্যব্যক্তিত্ব বাদল সরকার
দর্শন চৌধুরী
৪৮০.০০
একুশ শতক
কোনও নাটকের অভিনয় যদি কোথাও দেখে থাকেন, তা-ও উল্লেখ করেছেন তিনি। তার পর সহজ ভাষায় নাটকের কাহিনি আলোচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর মডেল অজিতকুমার ঘোষের আলোচনা। এতে যে পাঠক (বা ছাত্র) বাদল সরকারের মূল নাটকটি পড়বেন না, তিনিও জেনে যাবেন নাটকটি আদতে কী। আলোচক নাটকের একাধিক সংলাপও দীর্ঘাকারে উদ্ধৃত করেছেন, নাটকটি নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন। সমস্যা এই, যত সহজ ভাবে তিনি নাটকগুলি পড়েছেন বা পড়িয়েছেন, তারা ঠিক ততটাই সহজ, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। লেখকের মতানুসারে প্রথম পর্বের হাস্যরসাত্মক নাটকগুলিকে শুধুই ‘মজাদার হালকা হাস্যরসের ‘সিচুয়েশনাল কমেডি’’ বলা যাবে কি না, তা ভাবার। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, অমৃতলাল প্রমুখের যে নির্মল কৌতুকনাট্য রচনার ধারা ছিল, বাদল সরকার তাঁর যাবতীয় আধুনিকতা নিয়ে সেই ধারাকে আরও অগ্রবর্তী করেছেন, তাকে জীবনের বিচিত্র রসে সিঞ্চিত করেছেন অত্যন্ত সুপরিকল্পিত নির্মিতিতে। তাঁর সৃষ্ট নাট্যমুহূর্তগুলি বস্তুত সে কাজেই নিযুক্ত, তাদের নিছক ‘সিচুয়েশন’ বলা যাবে কি না তা সংশয়াতীত নয়।
বাদল সরকার তাঁর নাটক লেখার বিষয়ে সাক্ষাৎকারে বা ডায়রিতে অনেক কথাই বলেছেন। সৃজনধর্মী লেখকের বলা কথার মধ্যে অনেক ফাঁকফোকর লুকিয়ে থাকে: সব কথাই যে তিনি বলে ফেলেন তা নয়, বরং আরও না-বলা কথা, আরও রহস্যাভাস তৈরি হয়ে উঠতে পারে তাঁর আলাপনে। গ্রন্থলেখক অনেক নাটকের ক্ষেত্রে মূল বিদেশি চলচ্চিত্রের নাম উল্লেখ করেছেন, যে উল্লেখ স্বয়ং বাদল সরকার করেননি, শুধু সূত্রটি বলেছেন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, মোহিত চট্টোপাধ্যায় কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, মূল সূত্রটা যেন একটা পিংপং বলের মতো তাঁর সামনে ড্রপ খেয়ে খেয়ে ঘোরে, আর তাঁকে ‘প্রোভোকেট’ করে চলে নতুন লেখায়। বাদল সরকারের প্রসেনিয়াম-পর্বের সব নাটকই বস্তুত তা-ই, সে জন্য তাঁর সব লেখাই মৌলিক বলে মনে করতে চাই আমরা। তবে ছাত্রদের জন্য যে তথ্য দেওয়া জরুরি, সে কথাও মনে রাখতে হবে।
আরও একটি কথা মনে রাখা দরকার। নাটককার বাদল সরকার প্রসেনিয়াম থেকে অন্য এক মানসে যখন সরে এক বিশেষ আঙ্গিকের নাটক নির্মাণে চলে গেলেন, পরবর্তী কালের নাটককারেরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন সমূহ। কারণ নাটক লেখার ‘ক্রাফ্ট’ শেখার শিক্ষককে তাঁরা হারালেন। প্রসেনিয়াম মঞ্চের প্রযোজিত নাটকগুলি অনেক সময়েই বাদলবাবুকে খুশি করেনি। সেই অতৃপ্তির সবটা তিনি ব্যক্ত করেননি। ‘বহুরূপী’ তাঁর দু’টি নাটকের অভিনয়ে তাঁর নির্দেশকে মান্যতা দেয়নি। বাকি ইতিহাস নাটকে দু’জন অভিনেতা-অভিনেত্রীই শরদিন্দু-বাসন্তী’সহ দুই সীতানাথ ও কণার অভিনয় করেছেন। নাটককার চেয়েছিলেন, এরা সবাই আলাদা হোক। আবার পাগলা ঘোড়া-য় নাটককার চেয়েছিলেন, একই মেয়ে সব ক’টি চরিত্র করুক, কেননা পাত্রগুলি বদলে গেলেও উপেক্ষিতারা তো কোথাও এক! প্রযোজনায় সব ক’টি নারীচরিত্রে একাধিক অভিনেত্রী অভিনয় করেছিলেন।
তুলনায় এই বইয়ে ‘থার্ড থিয়েটার পর্ব’টি মূল্যবান। তিনি বেঁচে থাকতেই এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, ‘অন্তরঙ্গ নাটক’, বিশেষত কোভিড-উত্তর পর্বে যা হচ্ছে, তা আদৌ থার্ড থিয়েটার নয়। তবু বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পঠনে এবং তাঁর শতবর্ষ উপলক্ষে থার্ড থিয়েটার নিয়ে প্রচুর চর্চা হচ্ছে, যার অধিকাংশই অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্তিময়। সে ক্ষেত্রে থার্ড থিয়েটারের যাবতীয় আলোচনা এবং এ ক্ষেত্রে বাদলবাবু কোথায় পৌঁছন, লেখক সবটা সবিস্তারে দেখিয়েছেন। বিশেষ করে ‘পরিশিষ্ট’ অংশটি যে পাঠকের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, সন্দেহ নেই।
শেখর সমাদ্দার
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)