বইটি কী নয়, গোড়াতেই সেই উত্তর দিয়ে রেখেছেন লেখক— এটি তাঁর স্মৃতিকথা নয়, পাঠকের হাতেকলমে সহায়তা করার কোনও বইও নয়। তবে, বইটি স্মৃতিকথাও বটে, আবার পাঠকের কাছে শিক্ষণীয়ও বটে। স্মৃতিকথা, কারণ স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠ অসমাপ্ত রেখেই সরকারি দফতরের কনিষ্ঠ কেরানির চাকরিতে যোগ দেওয়া থেকে শুরু করে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের অন্যতম উদ্যোগপতি হয়ে ওঠা। এই যাত্রাপথের শেষে তিনি ফিরে এসেছেন নিজের রাজ্যে, যোগ দিয়েছেন দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পে; এই শেষ পর্যায়ের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে এই বইয়ের বিভিন্ন লেখায়। আবার এ বই শিক্ষণীয়, কারণ যে মানুষগুলির কথা সুব্রত বাগচি বলেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই আসলে সামান্য থেকে অসামান্য হয়ে ওঠার উদাহরণ। তাঁদের থেকে শেখা যায়, অন্তত অনুপ্রাণিত হওয়া যায়।
ওড়িশায় দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজ্যের আইটিআইগুলি ঘুরে দেখতে শুরু করেন লেখক। তিনি চালু করেছিলেন একটি নতুন নিয়ম— প্রতিটি আইটিআই-এর কাছে তিনি জানতে চাইতেন এমন দশ জন প্রাক্তনীর নাম, যাঁদের নিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান গর্ব বোধ করে; এমন ছ’জন প্রাক্তনীর নাম, যাঁরা রাজ্যের বাইরে গিয়ে কোনও না কোনও পেশায় সফল হয়েছেন; অন্তত চার জন প্রাক্তন ছাত্রীর নাম; এবং এমন দু’জনের নাম, যাঁরা আইটিআই-এর পাঠ শেষ করে চাকরি খোঁজেননি, নিজের মতো করে অন্তত ছোট মাপের হলেও কোনও ব্যবসা আরম্ভ করেছেন। এমন খোঁজ কেন, তার কারণও জানিয়েছেন লেখক। প্রতিষ্ঠান যাঁদের নিয়ে গর্বিত, তাঁদের কথা জানতে চাওয়ার কারণ আলাদা করে ব্যাখ্যা না করলেও চলে। রাজ্যের বাইরে গিয়ে যাঁরা সফল হন, তাঁদের— বিশেষত, সমাজের খানিক পিছিয়ে থাকা অংশ থেকে আসা মানুষের— সেই সাফল্য সম্পূর্ণত স্বোপার্জিত। হাতে-কলমে কাজ শিখে যাঁরা চাকরি না খুঁজে নিজস্ব ব্যবসার পথে হাঁটেন, তাঁদের ভিতরকার উদ্যোগপতি সত্তাকে চিহ্নিত করাও তো ‘স্কিল ডেভলপমেন্ট’-এরই অঙ্গ।
দ্য ডে দ্য চ্যারিয়ট মুভড: হাউ ইন্ডিয়া গ্রোজ় অ্যাট দ্য গ্রাসরুটস
সুব্রত বাগচি
৬৯৯.০০
পেঙ্গুইন বিজ়নেস
এই ভাবেই খোঁজ পাওয়া গেল মুনি টিগ্গার। ছোটখাটো চেহারার মেয়েটি পেশায় লোকো-ড্রাইভার, অর্থাৎ রেলচালক। ভুবনেশ্বরে তাঁর পোস্টিং। ৬১২৫ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন, ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারা ট্রেন বশ মানে তাঁর হাতে। সাধারণ মেয়ের এই অসাধারণ হয়ে ওঠা, এবং তাঁর নিজস্ব পরিচিতি তৈরি হওয়া, এটাই কি দক্ষতা উন্নয়নের মূল কথা নয়? তাঁকে নিয়ে লেখা ছোট্ট অধ্যায়টির শেষ বাক্যটি লেখেন সুব্রত: “আ গার্ল স্কিলড ইজ় পাওয়ার ডেলিভারড টু দি ইউনিভার্স।”
এ ভাবেই খোঁজ পাওয়া গেল বারিপদার বুদ্ধদেব ভঞ্জেরও। আইটিআই থেকে পাশ করার পর তিনি লাখ টাকা খরচ করে একটা ওয়েল্ডিং কিট কিনেছিলেন। কিন্তু, নিতান্ত অনভিজ্ঞ একটা ছেলেকে কাজ দেবে কে? কেউ তাঁর কাছে কাজ নিয়ে আসবে, সেই অপেক্ষায় না থেকে বরং সাইকেল নিয়ে নিজেই পথে নামলেন বুদ্ধদেব। অল্প পুঁজিতে যাঁরা নিজেদের বাড়ি তৈরি করছেন, তাঁদের কাছে গিয়ে গিয়ে বললেন, ছাদ ঢালাই হলে খবর দেবেন, আপনার বাড়ির জানালা আমি লাগাব। এ ভাবেই গ্রাহকের সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকল তাঁর।
দক্ষতা উন্নয়নের গল্প আসলে তো এই রকমই। দুনিয়া পাল্টে দেওয়ার বড় মাপের আখ্যান নয় তারা— বরং ছোট ছোট পদক্ষেপে নিজের, এবং চার পাশের আরও অনেকের জীবন পাল্টে দিতে শেখার, পাল্টে দিতে পারার গল্প।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)