গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বড় হওয়া রেডিয়োখোর পাঠক আমি। দারা শুকো, আওরঙ্গজেব ও শাহজাহানের উপরে বই পড়ব, আর কানের কাছে অহীন্দ্র চৌধুরীর গলায় শাহজাহানের সংলাপ আর সরযূবালার গলায় জাহানারার ডায়লগ বাজবে না, এমন হওয়াটা মুশকিল। মনে রেডিয়ো-নাটকের অনুষঙ্গটা এতই জোরদার, বলতে গেলে, গত দেড়শো বছর ধরে দারা আর আওরঙ্গজেবকে নিয়ে মুঘল দরবারের মারামারি ঘিরে স্মৃতির বিনিয়োগ কম হয়নি, এঁদের হাত ধরে নানা মুঘল চরিত্র গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নাটকে নানা রূপে ফিরে এসেছে। এমনকি সুপ্রিয়া গাঁধীর আলোচ্য বইটার চিন্তার বীজও তো দাস্তানগোই-এর একটা খসড়া পত্রে, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত কথকতার আদলে। ২০১৭-তে তানিয়া নন্দর ও শাহিদ নাদিম দারা আর আওরঙ্গজেবের দ্বন্দ্ব নিয়ে নাটক লিখেছেন, গোঁড়ামি স্বৈরাচারের দরবারে এক মুক্তমনা মানুষের বিচারই নাটকটার উপজীব্য। অন্য পক্ষে বাঙালি নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় মুঘল তখতের জন্য শাহজাদাদের সংঘর্ষকে যৌথ পরিবারের ভ্রাতৃকলহের নাটকে রূপান্তরিত করেন। নাটকে হতভাগ্য বাদশাহ পিতার হাহাকার শুনি, অনুতপ্ত পুত্র ক্ষমা ভিক্ষা চান।
দাস্তান আর নাটকের অঙ্গনই সব নয়। গত শতকের চিন্তাবিদদের আলোচনার বৃত্তে দারা ও আওরঙ্গজেব জায়গা পেয়েছিলেন, দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বে ছিল দুই বিপরীতমুখী আদর্শের বিরোধ। যেমন, কবি চিন্তাবিদ ইকবালের সমর্থন আওরঙ্গজেবের ইসলামি রাষ্ট্র ভাবনার পক্ষে। অন্য দিকে সুফি সাধক সরসদের উপর লেখা বিখ্যাত প্রবন্ধে যুবক মৌলানা আবুল কালাম আজাদ দারার সহিষ্ণু সমন্বয়ী চেতনার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। মুঘল-ই-আজ়মে দুই শাহজাদার বিরোধ বৃত্তান্তে অতীত যেন বর্তমানের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের দুই ভিন্নধর্মী সমাজসম্পর্ক ও রাষ্ট্র ভাবনার চিত্রকে তুলে ধরে।
দুই শাহজাদার জীবন পেশাদার ইতিহাসবিদদের গবেষণার অন্বিষ্ট হয়েছে। মুঘল সাম্রাজ্যের ট্রাজিক নায়ক আওরঙ্গজেবের উপর যদুনাথ সরকার পাঁচ খণ্ড বই লিখেছেন, সেই সূত্রে দারার ভাগ্যবিপর্যয়ও তাঁর নজর এড়ায়নি। মুঘল দরবারি রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আতহার আলি তখতের জন্য দুই শাহজাদার বিরোধের তৎকালীন ভাবনা ও নানা গোষ্ঠীর পারস্পরিক অবস্থানের তথ্যনির্ভর বর্ণনা দিয়েছেন।