E-Paper

নিতান্ত শান্ত স্বরে করা অতি বিপজ্জনক কয়েকটি প্রশ্ন

তারা চুরি করে খায়, চেয়ে খায়; অধিকারে পুরুষের সমান হওয়া তাদের হয় না, এমনকি লেখক-কল্পনাতেও।

প্রমিত রহমান

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৩৩
কর্মরতা: মহানগর ছবিতে মাধবী মুখোপাধ্যায়।

কর্মরতা: মহানগর ছবিতে মাধবী মুখোপাধ্যায়।

খবরের কাগজের লেখা, দুপুর পেরোলেই ঠোঙা— এই প্রচলকথা মিথ্যা প্রমাণ করতে হলে তাতে যে সব উপাদান থাকা প্রয়োজন, এই বইয়ের প্রতিটি নিবন্ধেরই সে গুণ আছে। সংবাদের তাৎক্ষণিকতা থেকে যদি বা লেখার সূত্রপাত ঘটেও, কোনও লেখাই শেষ অবধি সে পরিসরে আটকে থাকে না, ছুঁয়ে ফেলে আরও বড়, গভীর কিছু। লেখক দেখিয়ে দেন বিবিধ অসঙ্গতি, যেগুলো ‘স্বাভাবিক’ ধরে নিয়েই দিব্য টিকে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। ‘দিতেছ কতই যন্ত্রণা’ শীর্ষক নিবন্ধটি শুরু ব্যক্তিগত এক মুহূর্ত দিয়ে, শিশুকন্যাকে লুডো খেলা শেখাচ্ছেন লেখক। মেয়ের কিছুতেই পুট পড়ে না, ফলে তার ঘুঁটিও ঘর থেকে বেরোয় না। মায়ের পুট পড়ল, তিনি ঘুঁটি বার করতেই মেয়ে বলল, “মা কি বেবিকে রেখে একা একা বেরিয়ে যাবে নাকি?” শিশুর এক কথায় খুলে গেল পরিবার-কাঠামোর একটা না-বলা দিক: মা হলে বাচ্চার দায়িত্ব কার্যত তাঁকে একাই বহন করতে হবে; তাঁর যাওয়া-আসা, কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হবে পরিবারের কথা মাথায় রেখে। বাবাদের সে দায় নেই। অথচ, মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলেই কি সবাই এ দায়িত্ব স্বীকার করে বাঁচতে চায়? সমাজ, পরিবার তাকে ‘মা দুর্গা’ হিসাবে দেখিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে নিতে চায় বলেই কি সে-ও রাজি সেই ছকে পা ফেলতে? সীমন্তিনী লেখেন, “যে মেয়েটি যুদ্ধ চায় না, যে মেয়েটি সম্পত্তির অধিকার বুঝে নিতে চায়, যে মেয়েটি সন্তানের জন্ম দিতে চায় না... তাকে এক বার জিজ্ঞাসা করে দেখুন, সে ‘মা দুর্গা’ হতে চায় কি না।”

সাহিত্যের আনাচকানাচ থেকে উদাহরণ টেনে আনা লেখকের প্রিয় অভ্যাস। ‘খাওয়া না-খাওয়ার পালা’ নিবন্ধে এক আমেরিকান সাংবাদিকের নিবন্ধের সূত্র ধরে সীমন্তিনী বাংলা সাহিত্যের অন্দর থেকে মেয়েদের রান্না করা-না করা, খাওয়া-না খাওয়ার গল্প ছেঁচে দেখতে চেয়েছেন, তাতে মহিলাদের জীবনের ওঠাপড়া ধরা পড়ে কি না। শরৎচন্দ্রের আখ্যানে খাবারের সঙ্গে মহিলাদের সম্পর্ক ছকে বাঁধা: “তারা নির্লোভ, ত্যাগী, উপবাসে অভ্যস্ত এবং কৃচ্ছ্রসাধনে দড়।” অন্য দিকে, “বিভূতিভূষণের মেয়েরা বরং এ দিক থেকে মাটির অনেক কাছাকাছি। তারা অন্যের বাগান থেকে শাকসবজি চুরি করে আনে, রোদে দেওয়া আমসত্ত্বের কোনা ছিঁড়ে খায়, নারকোল কোরানোর সময়ে খানিকটা চেয়ে নিয়ে খেয়ে স্বর্গসুখ অনুভব করে, পৌষ সংক্রান্তির দিন কম করেও আঠারো-উনিশটা পিঠে খেয়ে ফেলে।” মেয়েদের খিদে আর খাওয়াকে কোন লেখক কী ভাবে দেখছেন ও দেখাচ্ছেন, তাতে তাঁর মন ধরা পড়ে অনেকখানি। সমাজের মনটাও অগোচর থাকে না— মেয়েদের খাওয়ার ব্যাপারে ‘মাটির কাছাকাছি’ থাকা বিভূতিভূষণের লেখাতেও কিন্তু খাওয়ার প্রশ্নে মেয়েরা প্রান্তিকই। তারা চুরি করে খায়, চেয়ে খায়; অধিকারে পুরুষের সমান হওয়া তাদের হয় না, এমনকি লেখক-কল্পনাতেও।

আনন্দের প্রশ্নেও কি মেয়েরা আলাদা নয়? ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’ নিবন্ধে উদ্ধৃতি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ছড়ার, “দিদি আসুন, ময়দা ঠাসুন, আজকে রবিবার/ মোহনভোগের সঙ্গে লুচি জমবে চমৎকার।” ছুটির দিন সকালের জলখাবারের পারিবারিক আনন্দটি যে দাঁড়িয়ে বাড়ির মেয়েদের বাধ্যতামূলক শ্রমের উপরে, সে কথা মনে করান লেখক। তাঁদের ‘ছুটির দিন’ নেই। আর শিক্ষিত, প্রগতিশীল বাঙালির নস্টালজিয়া? মায়ের হাতে তৈরি পিঠে, শিলনোড়ায় এক ঘণ্টা ধরে বাটা কোনও পদ বা যৌথ পরিবারের হেঁশেলে উনুনের সামনে মা-কাকিমাদের ঘর্মাক্ত মুখের সব আনন্দস্মৃতিই ‘স্বাভাবিক’ করে তুলতে চায় পরিবারের অভ্যন্তরে কায়েম পুরুষতন্ত্রের কাঠামোকে, সেখানে আনন্দের প্রধান জ্বালানি মেয়েদের কায়িক শ্রম। কেন মেয়েদেরই গায়েগতরে খেটে হাসি ফোটাতে হবে সবার মুখে, এই বিপজ্জনক প্রশ্ন করামাত্র হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে চায় সুখী সংসারের ধারণা। কাজেই, সে সব গোলমেলে প্রশ্ন এড়িয়ে চলেন সবাই।

আমার হাসি পাচ্ছে না

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়

৩০০.০০

হাতেখড়ি

সীমন্তিনীর নিবন্ধগুলির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য, তিনি প্রবল বিপজ্জনক প্রশ্ন করে চলেছেন একের পর এক লেখায়, কিন্তু বিন্দুমাত্র রাগ না করে। তাঁর লেখায় ঝগড়া করার চেষ্টা নেই, শান্ত ভঙ্গিতে তিনি দেখিয়ে চলেছেন একের পর এক গোলমাল। ফলে, ‘নারীবাদী’ লেখা শুনলেই যাঁরা পালাতে চান, তাঁরাও এই বই উল্টেপাল্টে দেখতে পারেন, হয়তো চিন্তায় স্বচ্ছতা আসবে। হয়তো বুঝতে পারবেন, এত দিন যা নিতান্ত স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলেন, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রবল অস্বাভাবিকতা। তা দেখার জন্য শুধু চেনা ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করার অভ্যাসটি গড়ে তুলতে হয় সযত্নে।

যেমন, মেয়েদের রসবোধ নেই, এই পরিচিত কথাটার মধ্যে যে কোনও গোলমাল থাকতে পারে, তা সচরাচর মনেও পড়ে না। অনেক মেয়েও এ নিয়ে এমন সচেতন থাকেন যে অপমানজনক ‘জোক’-এও তাঁরা হেসে গড়িয়ে পড়েন, হাসি না পেলেও— নয়তো, ‘বাকিদের কাছে রসবোধহীন, ভোঁপসামুখো ভ্যাঁপাটে প্রতিপন্ন হওয়ার একটা ঝুঁকি থাকে’। যৌনগন্ধী, অশালীন কথা বলার পরও পুরুষ সহকর্মী যখন বলেন, ‘আমি তো ইয়ার্কি মারছিলাম’, তখন ফিকে হেসে তা ‘ইয়ার্কি’ মেনে নেওয়াই অনেক মেয়ের বাধ্যতামূলক ‘সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি’। তবুও তো তাঁরা চাকরি করেন। বাইরে কর্মরত নন, রোজগার করেন না, এমন কোনও মহিলার পক্ষে ‘আমার হাসি পাচ্ছে না’ বলার মতো জোর অর্জন করা যে আরও কত বড় যুদ্ধ, ‘নেহাত রসিকতা’ করার আগে তা মাঝে মাঝে ভেবে দেখার অভ্যাস করা ভাল।

তবে, দু’-একটা প্রশ্নের অবকাশও থেকে যায়। নিবন্ধগুলি শেষ অবধি আবদ্ধ থাকে ‘পিপল লাইক আস’-এর গণ্ডিতে, অর্থাৎ লেখকের আর্থ-সামাজিক পরিসরের আশেপাশেই। বিশেষত, এ বইয়ের লেখাগুলিতে সংখ্যালঘু মেয়েদের কথা প্রায় অনুপস্থিত; তথাকথিত নিম্নবর্ণের মেয়েরাও নিজেদের জাতিগত পরিচিতি নিয়ে তেমন ভাবে নেই। পুরুষ-নারীর বাইনারির বাইরে থাকা মানুষদের কথাও এই সঙ্কলনে ঠাঁই পায়নি। অবশ্য, একই বইয়ে সব কথা থাকতেই হবে, এমন দাবি করা চলে না। এবং, যা নেই, তা কোনও মতেই যা আছে তার গুরুত্বকে খর্ব করে না। আর, গবেষক বা মরমি প্রাবন্ধিকের পক্ষেও কি সমাজের সব অংশকে একই রকম কাছ থেকে দেখা সম্ভব?

সীমন্তিনী অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপক, তাঁর বিশেষ আগ্রহের বিষয় ‘জেন্ডার’। এই লেখাগুলিতে প্রত্যক্ষ ভাবে অর্থশাস্ত্রের আলোচনা তেমন আসেনি, কিন্তু সে বিষয়ের বোধ কী ভাবে সমাজ-সাহিত্যকে দেখতে-পড়তে সাহায্য করেছে, তা স্পষ্ট। বাংলা নিবন্ধসাহিত্যের উজ্জ্বল ভান্ডারেও এমন লেখা সুলভ নয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy