E-Paper

পাণ্ডিত্য, ভাষাপ্রেমের সঙ্গে মিশেছিল সরস কথকতা

জ্যোতিভূষণ কবি, গীতিকার, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক ও অনন্য অনুবাদক। তাঁর এই সৃষ্টিজগতের ব্যাপ্তিকে তুলে আনা হয়েছে আন্তরিক সম্পাদনায়।

সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:০৩

“জ্যোতিভূষণ চাকীর শতবর্ষ পূর্ণ হল ২০২৫-এ। বিস্মৃতি থেকে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে এমন একটি সঙ্কলনের প্রয়োজন ছিল।” এ কথা গ্রন্থ-মলাটের প্রথম ফ্ল্যাপ-এ লেখা হয়েছে। আর শেষ মলাটে এই সঙ্কলনকে ‘তর্পণ গ্রন্থ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। প্রচারের আলো যেখানে উজ্জ্বল নয়, আমদের দৃষ্টি সেখানে কমজোরি। জ্যোতিভূষণ তাই কিছুটা ফাঁকে পড়ে থাকেন। আর তাই সঙ্কলন-সম্পাদকের দায়িত্ব বেড়ে যায়, কী ভাবে তাঁকে পরিচয় করাবেন সাধারণ পাঠকের সঙ্গে; তাঁর সত্তার সামগ্রিকতাকে কোন কোন ভাগে ভেঙে সমগ্র জ্যোতিভূষণ চাকীকে জারিয়ে দেবেন পাঠকের বোধে।

জ্যোতিভূষণের দু’টি স্পষ্ট সত্তার একটি হল আক্ষরিক অর্থেই শিক্ষকের ভূমিকা। যেখানে দেখা যাচ্ছে, জ্যোতিভূষণ বছর দুই পড়িয়েছিলেন পাবনার বিখ্যাত গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে যোগ দিলেন পার্ক সার্কাসের মডার্ন স্কুলে। আর ১৯৫৪ থেকে দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর দক্ষিণ কলকাতার ফার্ন রোডে জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে। মডার্ন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র অভিজিৎ সেন লিখেছেন, “স্কুলে ভর্তি হওয়ার দু-এক মাসের মধ্যেই জেনে বিস্মিত হয়েছিলাম যে আমাদের স্কুলে এমন একজন শিক্ষক আছেন যিনি আসলে বাংলা ভাষার শিক্ষক কিন্তু পণ্ডিতমশাই না এলে তিনিই সংস্কৃত পড়ান এবং মৌলবি স্যার না এলে উর্দু, আরবি তিনিই পড়ান। তারপরে যখন কিছুটা অন্তত হিন্দি পড়ানো বাধ্যতামূলক হল তখন যে শিক্ষক পড়াতে ক্লাসে এলেন তিনি আর কে হবেন, বহুভাষাবিদ্ জ্যোতিভূষণ চাকী।” মডার্ন স্কুল থেকে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শিক্ষকতা ছাড়তে বাধ্য হ‌ওয়া, এবং মাস্টারমশাইকে ভালবেসে স্কুলছাত্রদের ধর্মঘট ডাকার ঘটনাও জানিয়েছেন অভিজিৎ। জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে জ্যোতিভূষণের জীবনের বাকিটা কেটেছে। সেই স্কুলেও তাঁর ছাত্ররা নির্দ্বিধায় জানাবেন, সাহিত্যের হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসার পদ্ধতিটি তাঁদের মনে অনপনেয় ভঙ্গিতে এঁকে দিয়েছিলেন এই মাস্টারমশাই। প্রকৃত শিক্ষক ছাত্রের হাত ছাড়েন, আবার ধরেও থাকেন সব সময়।

জ্যোতিভূষণের দ্বিতীয় সত্তাটি সমুদ্রসম— সৃষ্টিশীলতার, এবং তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যের। ভাষাচর্চারও— যেখানে তিনিই ছাত্র, তিনিই শিক্ষক। তাঁর কথায়, “ইউ লাভ দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ, দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ উইল লাভ ইউ।” তিনি ভাষাপ্রেমিক, শুধু একের প্রতি নয়— একে একে আঠারোটি ভাষার প্রেমে পড়েছেন। বাংলা, উর্দু, সংস্কৃতে তাঁর চলাচল বেশি হলেও আরবি, ফারসি, ফরাসি থেকে এসপেরান্তো— সর্বত্রগামী তিনি।

জ্যোতিভূষণ চাকী শতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ

সম্পা: শুভাশিস চক্রবর্তী

৪০০.০০

বইওয়ালা বুক ক্যাফে

জ্যোতিভূষণ কবি, গীতিকার, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক ও অনন্য অনুবাদক। তাঁর এই সৃষ্টিজগতের ব্যাপ্তিকে তুলে আনা হয়েছে আন্তরিক সম্পাদনায়। তাঁর কিছু ছড়ার নমুনা পেশ করা হয়েছে; কিছু গানের, কিছু গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত প্রবন্ধের, কিছু সাহিত্য সমালোচনার। সেই সঙ্গে ‘সাহিত্যরথী জ্যোতিভূষণ’ শিরোনামে ছ’টি নিবন্ধ প্রকাশিত, তাঁর সাহিত্য প্রসঙ্গে। সুভাষ ভট্টাচার্য, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলেন চক্রবর্তী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, শাহনাজ নবি, সুব্রত দাস আলোচনা করেছেন জ্যোতিভূষণের সাহিত্যের এক-একটি দিক নিয়ে। তাঁর বত্রিশটি গ্রন্থ, এগারোটি প্রবন্ধ, সাতচল্লিশটি গ্রন্থ-সমালোচনা আর ছড়িয়ে থাকা অন্য নানা লেখা সঙ্কলনের গ্রন্থপঞ্জিতে জায়গা নিয়েছে। অনুবাদক হিসেবে তিনি যেমন কালিদাসের অনুবাদ করেন সংস্কৃত থেকে, রামচরিতমানস থেকে কৃষন চন্দর হিন্দি থেকে, গালিব, কাইফি আজ়মি উর্দু থেকে, আবার এক ঝাঁক গল্প-এ আরবি, ফারসি কাহিনিও। বাগর্থকৌতুকী গ্রন্থে শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে রসেবশে মোহিত করে রাখেন পাঠককে।

‘তর্পণ গ্রন্থ’ নাম সার্থক হয়ে উঠেছে দু’টি বিভাগে পরিবেশিত তর্পণমালায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, পবিত্র সরকার, আনন্দ ঘোষ হাজরা, রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী, প্রণব চট্টোপাধ্যায়, কিন্নর রায়, হর্ষ দত্তের মতো খ্যাতনামাদের আলোচনায় নানা দিক দিয়ে আলো পড়েছে জ্যোতিভূষণের প্রতিভা, পাণ্ডিত্য, রসিক কথকতায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “গবেষণায় থাকে একটা গোমড়ামুখো ভারিক্কি ভাব। জ্যোতিভূষণ তাঁর ত্রিসীমানায় হাঁটেননি। হালকা পায়ে গোরুখোঁজা করে খুঁজেছেন শব্দের মানে।” পবিত্র সরকার তাঁকে ‘রোল মডেল’ উল্লেখ করে বলেছেন, “তিনি একাধারে ভাষাবিদ এবং ভাষাতাত্ত্বিক।” তর্পণে বার বার উঠে এসেছে ভাষাকে বাহন করে তাঁর নানান রসিকতা। ‘পণ্ডিত’ শব্দের ব্যাসবাক্য নিয়েই রসিকতা করে বলতেন, ‘যিনি পণ্ড করেন’! মানবিক জ্যোতিভূষণকে ধরেছেন হর্ষ দত্ত, “এমন পণ্ডিত বিরল, এমন মানুষ তার চেয়েও বিরল, নিরভিমান, বিনয়ী, অনুচ্চবাক্।” অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির একটি লেখায় তাঁর জীবনপ্রবাহ, সহজিয়া জীবন দর্শন যেন প্রকাশ পায়, “এপার ওপার জানি না/ আমার মস্ত বড়ো আঙিনা।…”

দ্বিতীয় বিভাগে প্রকাশিত তিনটি প্রবন্ধ এবং প্রথম বিভাগের একটি ছাড়া বাকি রচনাগুলি পূর্বপ্রকাশিত ও সংগৃহীত। সুমিত মিত্র, পথিক চাকী, সন্দীপন নন্দী এবং সুব্রত দাস স্মারক সঙ্কলনের জন্য‌ই লিখেছেন। ঝকঝকে ছাপা, বিভিন্ন জায়গায় ‘সেপারেটর’ হিসেবে জ্যোতিবাবুর বিভিন্ন গ্রন্থের মলাটের ছবি, লেখকদের ওজস্বী লেখনী, সম্পাদনার পারিপাট্য— সর্বাঙ্গসুন্দর। একটা কথা না বললেই নয়, এই মানুষটির স্মারক গ্রন্থে মুদ্রণত্রুটি বা বানানের ভুল থাকা সমীচীন নয়। জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনকেই কোথাও ‘ইন্সটিটিউট’, কোথাও ‘ইন্সটিটিউশন’/‘ইনস্টিটিউশন’, এমনকি ‘ইউস্টিউশন’ও ছাপা হয়েছে। যদিও ব‌ইয়ের প্রথমেই প্রকাশিত জ্যোতিভূষণের “অ‘ভূত’পূর্ব বর্ণবিপর্যয়” নামে ছাপাখানার ভূত নিয়ে গল্পটাই সাত খুন করেছে মাপ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy