E-Paper

সিরাজ যে ভাবে কলঙ্কমুক্ত হলেন

ইতিহাসকেই দু’মলাটে আবদ্ধ করেছেন বারিদবরণ ঘোষ। সময়সারণি ধরে একেবারে গোড়া থেকে অন্ধকূপ কাণ্ড-চর্চার লেখাগুলিকে সঙ্কলিত করেছেন। প্রথম লেখাটি রামগতি ন্যায়রত্নের।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:২১
An image of the book

অন্ধকূপ হত্যা (বাঙালির দৃষ্টিতে)। —ফাইল চিত্র।

অন্ধকূপ হত্যা (বাঙালির দৃষ্টিতে)

সঙ্কলন ও সম্পা: বারিদবরণ ঘোষ

৫৮০.০০

কারিগর

ভারতে নিজেদের শাসনকে ‘বৈধতা’ দিতে সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক ইতিহাস রচনা শুরু হয়েছিল। সেই রচনার অন্যতম আদি হাতিয়ার ছিল ‘অন্ধকূপ হত্যা’। কলকাতার ব্রিটিশ দুর্গ আক্রমণ করে ১৭৫৬ সালের ২০ জুন সিরাজদৌল্লা নাকি ১৪৬ জন ব্রিটিশকে দুর্গের এক ফালি ঘরে বন্দি করে, নিষ্ঠুর ভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। সেই ঘটনার একমাত্র বর্ণনা দিয়েছিলেন দুর্গের কর্তা হলওয়েল। সেই বর্ণনাকেই আশ্রয় করে বছরের পর বছর ধরে ‘নিষ্ঠুর’ সিরাজের ছবি আঁকা হয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি অন্ধকূপ হত্যা ঘটেছিল? একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে হলওয়েলের বর্ণনার যুক্তিহীনতা ফাঁস করা সহজ। কিন্তু কী ভাবে বাঙালি মনন তার শেষ স্বাধীন নবাবকে অন্ধকূপ থেকে বার করে এনেছিল, তাও তো এক ইতিহাস! ইতিহাসচর্চার ইতিহাস।

সেই ইতিহাসকেই দু’মলাটে আবদ্ধ করেছেন বারিদবরণ ঘোষ। সময়সারণি ধরে একেবারে গোড়া থেকে অন্ধকূপ কাণ্ড-চর্চার লেখাগুলিকে সঙ্কলিত করেছেন। প্রথম লেখাটি রামগতি ন্যায়রত্নের। হলওয়েলের ইংরেজি লেখার অনুবাদ করেছিলেন সাহিত্যের পণ্ডিত রামগতি, তাই ছত্রে-ছত্রে সিরাজ-বিদ্বেষ স্পষ্ট। বইয়ের বাকি প্রবন্ধগুলি অবশ্য হলওয়েল-বর্ণিত ঘটনার সারবত্তা খারিজ করে। অন্ধকূপ হত্যার তত্ত্বের প্রথম বিরোধিতা এসেছিল বিহারীলাল সরকারের রচনায়। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদদের স্বীকৃত তিনটি আকর গ্রন্থ বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন যে, তার কোনওটিতেই এই হত্যার কথা নেই। পলাশির যুদ্ধের আগে ব্রিটিশ কর্তা ওয়াটসন বা ক্লাইভের চিঠিতেও অন্ধকূপ প্রসঙ্গ নেই। হলওয়েলের বর্ণনা উদ্ধৃত করেই অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় দেখিয়েছিলেন যে, সিরাজের নির্দেশে হত্যা, এই তত্ত্ব নেহাতই অনুমান। তথ্যের আরও নিখুঁত বিশ্লেষণে অন্ধকূপ হত্যার সারবত্তাকে জোরালো আক্রমণ উঠে আসে মুজিবর রহমানের লেখাতেও। অন্ধকূপ হত্যার ‘প্রত্যক্ষদর্শী’ হলওয়েলের সাক্ষ্য যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম ছিল, সেই বিশ্লেষণ আছে রেজাউল করিমের প্রবন্ধে। ত্রিদিবনাথ রায়ের প্রবন্ধে শুধু ব্রিটিশ তথ্যের পরস্পরবিরোধিতা নয়, ‘অন্ধকূপ’ প্রসঙ্গে ফরাসি, আর্মেনিয়ানদের রচিত সূত্রগুলিও পরীক্ষা করা হয়েছে। তাঁর সিদ্ধান্ত, অন্ধকূপ হত্যা ভুয়ো না হলেও তা সিরাজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

বইটির সংযোজিত অংশে ১৯৪৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের রচনা মূলত ‘অন্ধকূপ হত্যা’-র স্মৃতিস্তম্ভ ও তা অপসারণের ইতিহাস তুলে ধরে। তবে প্রবন্ধের গোড়াতেই উল্লেখ মেলে ভোলানাথ চন্দ্রের মতামত। পাটিগণিত ও জ্যামিতির হিসাবে ভোলানাথ দেখিয়েছিলেন, ১৮ ফুট লম্বা ও ১৮ ফুট চওড়া ঘরে ১৪৬ জনের ঠাঁই হওয়া সম্ভব নয়। বইটির শেষে আছে অমলেন্দু দে-র একটি ছোট রচনা, যেখানে সামগ্রিক ভাবে অন্ধকূপ তত্ত্বের সারবত্তা কী ভাবে খণ্ডিত হয়েছে তা স্বল্প পরিসরে বলা হয়েছে।

দু’মলাটের ভিতরে এই কয়েকটি প্রবন্ধ শুধু অতীতে প্রকাশিত রচনার চর্বিতচর্বণ নয়। বরং এগুলি ইতিহাস গবেষকের কাছে আকর হিসাবেই চিহ্নিত হবে। লেখাগুলিকে সময়ানুক্রমে সাজালে কী ভাবে ব্রিটিশ ‘ন্যারেটিভ’-এর বিরুদ্ধস্বর তৈরি হয়েছিল, তারও সন্ধান মেলে। সেই বিরুদ্ধস্বর অবশ্যই তথ্য ও যুক্তিনিষ্ঠ। এই বইয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলির লেখকেরা অধিকাংশই জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদ। কিন্তু তাঁদের রচনায় স্পষ্ট, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সঙ্কীর্ণ ধর্ম, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়, বরং বহু ক্ষেত্রেই তথ্যনিষ্ঠ আবেগের প্রকাশ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Baridbaran Ghosh

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy