Advertisement
E-Paper

ইতিহাস হারানোর যন্ত্রণা

আমাদের কষ্টার্জিত আধুনিকতা আজ এক কানাগলির সামনে দাঁড়িয়ে। ফলে এই সংকটের সময় কী বই পড়ব সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আত্মতুষ্টির গা ঘিনঘিনে অনুভূতি থেকে নিষ্ক্রমণের অন্য কোনও রাস্তা নেই।

চিন্ময় গুহ

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৮ ০১:২১
শিক্ষাঙ্গন: একদা উপমহাদেশে স্বতন্ত্র দিশা দেখিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: রাজকুমার চক্রবর্তী

শিক্ষাঙ্গন: একদা উপমহাদেশে স্বতন্ত্র দিশা দেখিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: রাজকুমার চক্রবর্তী

পৃথিবীর পথে হেঁটে

লেখক: অলকনন্দা প্যাটেল

৬৫০.০০

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন (বাংলাদেশ)

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক অলকনন্দা পটেলের (১৯৩৭-) এই পুঙ্খানুপুঙ্খ আর সীমাহীন ঐশ্বর্যে ভরা স্মৃতিকথা আমায় বীণার তারের মতো বাজিয়ে দিল। যেন চারপাশের এই মৃত্যুগন্ধী পরিবেশে, যেখানে জ্ঞানচর্চা প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে পার্শ্বরেখায়িত হয়ে গিয়েছে, আমি রামপুর ঘরানার অঙ্গে একটি বন্দিশ শুনছি। আমাদের কষ্টার্জিত আধুনিকতা আজ এক কানাগলির সামনে দাঁড়িয়ে। ফলে এই সংকটের সময় কী বই পড়ব সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আত্মতুষ্টির গা ঘিনঘিনে অনুভূতি থেকে নিষ্ক্রমণের অন্য কোনও রাস্তা নেই।

ঢাকার গেন্ডারিয়ায়উমা কুটির’-এ এই বিদুষীর জন্ম, ইডেন স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু। পিতা যশস্বী অর্থনীতিবিদ, ১৯২৬-৪৬ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (পরে দীর্ঘদিন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ও পটনা) অধ্যাপক অমিয়কুমার দাশগুপ্ত, অশোক মিত্রের ভাষায় যাঁরপাণ্ডিত্যের গাম্ভীর্য এবং ছাত্রবৎসলতা প্রবাদে পরিণত হয়েছিল।অলকনন্দা পরে বেনারস ও হার্ভার্ডে শিক্ষাগ্রহণ করেন, দিল্লি ও লন্ডনে অধ্যাপনা করেছেন, ইতালিতে একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, কিন্তু ১৯৪৬-এর ২ অক্টোবর গেন্ডারিয়ার বাড়ি থেকে চিরদিনের মতো ঢাকা ছাড়লেও গৈলা, বরিশাল, ঢাকার স্মৃতি তাঁকে ছাড়েনি। পরবর্তী জীবনে বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে তির বেঁধার মতো যুক্ত হয়ে যায় ৫ নং পুরানা পল্টনে শৈশবের বিশদ, বিক্ষিপ্ত চিত্রমালা আর এই খণ্ডিত বাংলায় ইতিহাস হারানোর যন্ত্রণা।

এই আদ্যন্ত বাঙালি আত্মকথাটি পড়তে পড়তে স্মৃতিলিখনের কঠিন শিল্প সম্পর্কে স্যামুয়েল জনসনের কথা মনে পড়ল: ‘দ্য ট্রু আর্ট অব মেমরি ইজ দি আর্ট অব অ্যাটেনশন। শুরুতেই জীবনানন্দেররূপসী বাংলা’-র একটি কবিতাংশ: ‘খুঁজে তারে মর মিছেপাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;/... সেই সব ভিজে ধুলো, বেলকুঁড়ি-ছাওয়া পথ,— ধোঁয়া-ওঠা ভাত,/ কোথায় গিয়েছে সব?’ পরিব্যাপ্ত জীবনের হারিয়ে যাওয়া খুঁটিনাটিযা এক বিদগ্ধ পরিবারের বালিকার চোখে নীলক্ষেতের হাতছানির মতো সজীব ও বাঙ্ময়এই বইকে দিয়েছে তার অনুভূতি ও স্মৃতির কাঠামো।

কালি ও কলমপত্রিকায় প্রকাশিতঢাকার স্মৃতিপড়ে অশোক মিত্রই অলকনন্দাকে বলেনমনের আনাচে-কানাচে আরও খোঁজ নিয়েবইয়ের আকারে ঢাকারজীবনশৈলীলিখতে। তাঁকে সাহায্য করেছে মায়ের চিঠির ঝাঁপি আর ডায়েরি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা আর স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে বড় হওয়া অলকনন্দার ভাষায়, ‘আনন্দ-আতঙ্ক দুইই পাশাপাশি ছিল, আমরা ছোটরা কিন্তু আনন্দ নিয়েই থেকেছি, মন থেকে আতঙ্ক মুছে ফেলতে সময় লাগেনি।আতঙ্কের প্রতিরোধ হিসাবে আনন্দই এই গ্রন্থের নির্যাস।

বুদ্ধদেব বসুরআমার শৈশববাআমার যৌবন’-এ পুরনো ঢাকার স্বাদু স্মৃতি আছে। লেখিকা পরিমল রায়কে লেখা বুদ্ধদেবের চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন: ‘পল্টনের মাঠের মতো সুন্দর পৃথিবীর অন্য কোন মাঠ আমাদের চোখে লাগবে না।... মনে হয় অনেক কথাই বলা হয়নি, সেখানকার দিন, রাত্রি, বিকেল, সন্ধ্যা, স্তব্ধ মধ্যরাত্রির আশ্চর্য নীল সিনেমার মতো জোছনা, তার সুরটি স্পর্শটি আবার নতুন করে ধরতে ইচ্ছে করে।এই বই সেই সুরটির সাত রঙের বিস্তারকে ছুঁয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত পরিবেশের ছবি বিন্দু বিন্দু তুলিস্পর্শে ফুটে উঠেছে ৫ নং পুরানা পল্টনের দোলনচাঁপা, মাধবীলতা, চন্দ্রমল্লিকা, জুঁইকাঞ্চনকে ঘিরে। ঘরের স্থাপত্য, কাঠের ব্যাঙ দিয়ে বন্ধ করা দরজা-জানালা; গোছানো, পরিচ্ছন্ন ঘর, সাজানোর জন্য শখের জিনিস বিশেষ ছিল না, বড়জোর হাতের কাজ বা লেসে তৈরি টেবিলের কভার।মধ্যবিত্ত পরিবারের ভূষণ ছিল বইআলমারি ভরা বই।যা আজ ছদ্ম-বিশ্বায়িত বাঙালির ঘরে ভীতিপ্রদ ভাবে কমে আসছে।

খুঁটিনাটির বর্ণনা নকশি কাঁথার মতো। চেজারে পাভেসে লিখেছেন, ‘আমাদের স্মৃতি তো কোনও দিনের নয়, মুহূর্তের।কুয়ো থেকে জল তোলা, কয়লা ভাঙা, গুল দেওয়া, দুই কাঁধে বাঁশে ঝোলানো হাঁড়িতে দুধ, ঘি, গুড় ফেরিওলা; পায়ে চটি, সাদা শাড়ি ও চশমা পরাগ্র্যাজুয়েটভিখারিনি, উঠোনে পুরনো ধুতি গায়ে জড়িয়ে বাবার চুল কাটা, ঝামা দিয়ে পা পরিষ্কার করে আলতা পরা, লেখিকার বিনুনি, মায়ের খোঁপা, সাপলুডোয় নরকে নেমে যাওয়ার ভয়; লালপাড় শাড়ি, চুড়ি, কঙ্কণ, আর্মলেট, গলায় চিক ও একাধিক চেন, কানে ঝুমকো সেজমা, প্রতিমা বরণেরকরিয়ালশাড়ি।

মা-মাসিদের সহজে কাপড় দিয়ে দুদিক ধরে ঢাকনি একটু খুলে ভাতের ফেন বার করা থেকে রান্নাঘরের অধুনালুপ্তমিটসেফ’, অসুখের সময় আদা-তুলসী শিউলি পাতার রস, দুধ-সাবু, বার্লির জল, ডায়মন্ডের মতো কাগজ কেটে মিক্সচারের শিশির দাগ, অসুখ শেষে ফুরফুরেকালিজিরাচালের ভাত। পরে একদিন বস্টন শহরে বাংলাদেশি দোকানেকালিজিরা চালদেখে তাঁর পুরনো স্মৃতি মনে পড়েছে। গয়নাগাঁটি, রান্না ভাঁড়ারের বিবরণ পড়ে অনেকের কল্যাণী দত্তের থোড় বড়ি খাড়া-র কথা মনে পড়বে। কিন্তু এ বইয়ের পরিসর দেশ কাল ছুঁয়ে ইতিহাসকে ধারণ করে আছে।

জীবন ছিল সাদামাটা। খেলনা, সাজগোজ, বইপত্র কিছুরই প্রাচুর্য ছিল না। ফলে সাধারণ পোশাক-আশাক, খাদ্যবস্তু, এমনকী ট্যালকম পাউডার (যার কৌটোর ফুটো ফুটো মুখ এক দিকে প্যাঁচ দিলে খোলে!) জীবনে সুগন্ধ এনে দিত। সেই যুগে বইখাতার ভার, টিউশন ছিল না, সহজ শিক্ষা। লেখিকা গ্লোব দেখে পড়াশোনা করার সময় দাদা অমর্ত্য সেনও তাঁকে ভয় পেতেন, কারণটিম্বাকটু’ চিনবার খেলায় তিনি তাঁকে হারিয়ে দিতেন!

বইটির সম্পদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণনা। যেমন ধরা যাক, পরিমল রায়ের উদ্ধৃতি: ‘সেকালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রমনার সাত সমুদ্র ছড়াইয়া ছিল।... আমরা নতুন আগন্তুকেরা দিশাহারা আত্মহারা হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। যাহা দেখি, তাহাতেই মুগ্ধ হইয়া যাই।... উনি কে? সত্যেন বসু।... উনি? ডা জ্ঞান ঘোষ। ইনি? ডা রমেশ মজুমদার। আর উনি? ডা সুশীল দে, ইংরাজি ও সংস্কৃতের প্রতিভা। বিদ্যার বিপণিতে যেন হালখাতার উৎসব। চতুর্দিকে একটা নেশাধরা আমন্ত্রণ।সত্যেন বসু, আব্দুর রাজ্জাক, জসীমউদ্‌দীন, মোহিতলাল, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখের বিশ্ববিদ্যালয় উপমহাদেশে যে স্বতন্ত্র দিশা দেখিয়েছিলআমিত্ববর্জন ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। বুদ্ধদেব বসু, অশোক মিত্র, ভবতোষ দত্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্তান।

পিতা ও অন্যদেরক্ষুব্ধ ও নিরাশভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার বিবরণ আছে। সাম্প্রদায়িকতার অনিষ্টকর, মনগড়া বিধান নিয়েও ছোট মেয়েটির চিন্তার অন্ত ছিল না। রাজনীতিকে সে এড়িয়ে যায়নি। সুস্থ শিক্ষিত মনের এই বিকাশ এক অপূর্ব লাবণ্য ও সুষমার জন্ম দিয়েছে।

ঢাকা ছাড়ার পর ভারতবর্ষে ও বহির্বিশ্বে শিকড় খুঁজে পেয়েছেন। বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিয়েছেন রামপুর ঘরানায়, রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন শৈলজানন্দ মজুমদারের কাছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, বাস্তুহারা মানুষের ছায়া খানিকটা সরে গিয়েছে। পুরনো ঢাকার অনেক বদল হয়েছে।সেই ঢাকাআর নেই। কিন্তু লেখিকার মনে সুরের রেশ অব্যাহত আছে।

অলকনন্দা যখন তাঁর স্মৃতি পুনর্নির্মাণের শেষে লেখেন, ‘আমি ভারতীয়, আমি বাঙালি, আমি দুই বাংলার বাঙালি, গৈলা আমার দেশ, ঢাকা আমার বাড়ি...। তবু মনে হয়, বারবার মনে হয়, এই ভাগ-বাটোয়ারা, এই সীমান্তরেখা না হলেও তো পারত।’ বইয়ের স্নায়ু থেকে একটি রক্তরেখা চুঁইয়ে পড়ে।

Book Review পৃথিবীর পথে হেঁটে
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy