E-Paper

তর্কের সম্ভাবনা তুলে ধরে

ছয়টি অধ্যায়ে বিস্তৃত এই বইয়ের যুক্তিপ্রস্থান। প্রথম দু’টি অধ্যায়ে দু’টি তত্ত্বচর্চার ‘ক্যাটেগরি’ ধরে আলোচনার বিস্তার করেছেন লেখক।

সুমিত চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:১৬

শুরুতেই বলে নেওয়া ভাল— রোসিঙ্কা চৌধুরীর এই সাম্প্রতিক গবেষণা-সন্দর্ভটি বিবিধ কারণে গুরুত্ব আর আলোচনার দাবি রাখে। উনিশ শতকের বাংলা ও বাঙালি বিষয়ে ইতিহাস চর্চার যেমন ‘লোকাল’ আর ‘গ্লোবাল’ নিরিখ দুই-ই রয়েছে, তেমনই রয়েছে এর বিষয়ের এবং তর্কের ব্যাপ্তি। তামাম বিশ্বের তাবড় সব ইতিহাসবিদ, সংস্কৃতিবিশারদ, সমাজতাত্ত্বিক, অর্থনীতির গবেষক উনিশ শতকের ‘বঙ্গাল’ নিয়ে তাঁদের তর্ক আর তত্ত্বের হট্টগোলে এই স্থানিক ও কালিক বীক্ষণের জটিলতাকে সজীব রেখেছেন— এবং বলা চলে, আজও এই কলরব বর্ধমান। রোসিঙ্কার বইটি যে শুধুমাত্র এই বৃহৎ বঙ্গবিদ্যার সুপারমার্কেটে নবতম সদস্য হওয়ার দাবি জানাল তা-ই নয়, তার অন্দরের অধুনা প্রতিষ্ঠিত বেশ কিছু তত্ত্বপ্রস্থানের সঙ্গে সপাট তর্কের সম্ভাবনারও জানান দিয়ে রাখল।

শিরোনাম থেকেই মালুম হয় যে, এই বইয়ের উপজীব্য ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে পরিচিত ডিরোজ়িয়োর ভক্তকুল। ইতিহাসের সন্দর্ভ হিসেবেই গণ্য হবে নিশ্চিত, তবু সাহিত্যের ছাত্র রোসিঙ্কা একটা অন্যতর ভাঁজ দিয়ে তাঁর আলোচনার প্রতিপাদ্যকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন সাহিত্যতত্ত্বের যুক্তিকে আশ্রয় করে। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘মিস্টার বেনেট অ্যান্ড মিসেস ব্রাউন’ প্রবন্ধে ভার্জিনিয়া উল্‌ফ লিখেছিলেন, “অন অর অ্যাবাউট ডিসেম্বর নাইন্টিন হানড্রেড টেন, হিউম্যান ক্যারেক্টার চেঞ্জড।” সমাসন্ন বিশ্বযুদ্ধের নিরিখে সমগ্র ইউরোপের মানুষের আধুনিকতার বোধ আর ভিত্তি যে ভিন্নতর এক ‘ডিসকোর্স’-এর সূচনালগ্নে স্তম্ভিত কলেবরে অপেক্ষমাণ তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন ভার্জিনিয়া তাঁর এই বাক্যবন্ধে। প্রবন্ধের এই বাক্যের ভিতরে যে সম্যক ‘সাবভারশন’-এর একটা প্রতীতি রয়েছে, সেই চিন্তাসূত্রই ধার করে রোসিঙ্কা ইয়ং বেঙ্গল সম্বন্ধে লিখলেন, “অন অর অ্যাবাউট এপ্রিল এইট্টিন থার্টিওয়ান ইন ক্যালকাটা, হিউম্যান ক্যারেক্টার চেঞ্জড।” প্রথাগত অর্থে পপুলার প্রেস থেকে প্রকাশিত এই বই। তথাকথিত বিদ্যায়তনিক পরিসরের বাইরে বিস্তৃত পাঠকসমাজের কাছে পৌঁছতে হলে যে আকস্মিক ধাক্কা দেওয়া জরুরি, সেই কাজ যেমন সাধিত হল এই যুক্তির অবতারণায়, তেমনই, উনিশ শতকের বাংলার ইতিহাস রচনার যে প্রতিষ্ঠিত আর চলমান ধারা, তাকেও যেন খানিক চমকে দিতে পারলেন লেখক। ইয়ং বেঙ্গল যে উনিশ শতকের বাঙালির ইতিহাস রচনার প্রকল্পের প্রান্তিক সমস্যা হিসেবেই চিহ্নিত, বলা যায় প্রায় যতিচিহ্নের মতো তাঁদের অবস্থান, এবং তাঁদের প্রতি যে আরও মনোযোগ দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন, এই তুলনায় সে কথাই স্পষ্ট করে দাগিয়ে দিলেন রোসিঙ্কা।

ছয়টি অধ্যায়ে বিস্তৃত এই বইয়ের যুক্তিপ্রস্থান। প্রথম দু’টি অধ্যায়ে দু’টি তত্ত্বচর্চার ‘ক্যাটেগরি’ ধরে আলোচনার বিস্তার করেছেন লেখক। একটা ‘জমি’, আর একটা ‘জনগণ’। এই জমির অধিকার অথবা কৃষকের দুর্দশা বা দাবির বিষয়ে বিবিধ সমকালীন পত্রপত্রিকায় অথবা বক্তৃতায় রসিককৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় কিংবা প্যারীচাঁদ মিত্ররা কী আলোচনা করছেন, তা বিস্তারে উল্লেখ করেছেন লেখক। আবার, পরের অধ্যায়ে ১৮৪৩ সালে ভারতে আগত দাসপ্রথা-বিরোধী বুদ্ধিজীবী জর্জ টমসনের সঙ্গে ইয়ং বেঙ্গলের মোলাকাত আর আলোচনা থেকে কী ভাবে ‘পিপল অব ইন্ডিয়া’ ক্যাটেগরির ক্রমাগত উত্থান ঘটছে তাঁদের লেখালিখির মধ্যে, সেই দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন রোসিঙ্কা। আবার এই ‘জনগণ’-এর আলোচনার প্রসঙ্গে কী ভাবে ম্যানচেস্টার স্কুলের সামাজিক নৃতত্ত্বের ‘লিবারাল’ ধারণার সঙ্গে ইয়ং বেঙ্গলের জনগণের অধিকার আর সুশাসনের দাবির ধারণার একটা চলাচল সূচিত হচ্ছে, সে দিকেও ইঙ্গিত করেছেন তিনি।

১৮৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘সোসাইটি ফর দি অ্যাকুইজ়িশন অব জেনারেল নলেজ’ সভার বিবিধ কাজের বিস্তারে বিবরণ এবং তার গুরুত্বের আলোচনা করেছেন রোসিঙ্কা বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে। লিখেছেন কী ভাবে এই আপাত-শহুরে, হিন্দু কলেজ-শিক্ষিত, ইংরেজি বুলি কপচানো যুবকের দল যেমন ইতিহাসের গুরুত্ব, অথবা বাংলা ভাষার চর্চা, কিংবা ‘পলিটিক্যাল লিবার্টি’র প্রসঙ্গে ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ আলোচনা করছেন, তেমনই প্রান্তিক জেলার প্রশাসনিক অবস্থা, সেখানকার প্রজাদের খেদ বা নালিশ বিষয়েও গম্ভীর সন্দর্ভ লিখছেন। লেখক আমাদের ধরিয়ে দিচ্ছেন যে, ইতিহাসবেত্তা পণ্ডিতেরা উনিশ শতকের বাংলার প্রজাদের নিয়ে বহু আলোচনা করলেও, ইয়ং বেঙ্গলের এই অবদান বিষয়ে তাঁরা আশ্চর্য নিশ্চুপ।

চতুর্থ, পঞ্চম আর ষষ্ঠ অধ্যায়ে রোসিঙ্কা ফরাসি বিপ্লবের তিনটি মান্য সূচককে (অর্থাৎ লিবার্টি, ইকোয়ালিটি ও ফ্রেটারনিটি) ভিত্তি করে তাঁর আলোচনা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। চতুর্থ অধ্যায়ে, ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ বা লব্‌জের অধিকার নিয়ে ইয়ং বেঙ্গলের অবস্থান; পঞ্চম অধ্যায়ে বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে চর্চা; আর ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিধবাবিবাহ, নারীমুক্তি, জাতপাত আর ব্রাহ্মণ্যবাদ বিষয়ে তাঁদের বিবিধ তর্ক আর ধারণার বিস্তারে আলোচনা রয়েছে। গোটা বইতেই রোসিঙ্কা ‘ক্লোজ় রিডিং’ আর ‘ডিসকোর্স অ্যানালিসিস’-এর উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। এই স্বল্প পরিসরে অধ্যায় ধরে আলোচনার অবশ্য অবকাশ নেই।

ইন্ডিয়া’জ় ফার্স্ট র‌্যাডিক্যালস: ইয়ং বেঙ্গল অ্যান্ড দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার

রোসিঙ্কা চৌধুরী

৮৯৯.০০

পেঙ্গুইন ভাইকিং

তাঁর এই সন্দর্ভ রচনা কেন একই সঙ্গে জরুরি আর শ্রমসাধ্য, সে কথা লেখক নিজেই আমাদের ধরিয়ে দিচ্ছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস চর্চার ধারা নির্দিষ্ট কিছু বিদ্যায়তনিক আখ্যান মেনে পরিচালিত হয়েছে। কৃষকের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ‘ওরালিটি’ বা বাচনিক ইতিহাস; জাতিসত্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘নেশন’ অথবা ‘ন্যাশনালিজ়ম’-এর আখ্যান; আর এই আখ্যানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে পরবর্তী কালের জাতপাতের ইতিহাসের জরুরি নির্মাণ। কিন্তু এর কোনও ধারাতেই, দীনেশ সেন যাঁদের ‘ডি-ন্যাশনালাইজ়ড’ বলে দেগে দিয়েছিলেন সেই ইয়ং বেঙ্গলের স্থান হয়নি। তাই লেখক এই ‘ইন্ডিয়া’জ় ফার্স্ট র‌্যাডিক্যালস’-এর ইতিহাস রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। আধুনিক ভারত বলে যাকে আমরা চিনি, তার কাঠামোর প্রাথমিক ভিত নির্মাণে এঁদের অবদান যে নজরের বাইরে রাখা চলে না, এই কথাই বার বার দাগিয়ে দিয়েছেন রোসিঙ্কা: “...ওয়ান অব দ্য ক্রুসিবলস ইন হুইচ ইটস (মডার্ন ইন্ডিয়া) আইডিয়াজ় অ্যান্ড ভ্যালুজ় ওয়্যার ফর্মড ওয়াজ় কনস্টিটিউটেড অব আ পলিটিক্যালি অ্যাক্টিভ অ্যান্ড সোশ্যালি রেস্টিভ গ্রুপ কলড ইয়ং বেঙ্গল, পার্ট অব আ জেনারেশন ইন ক্যালকাটা ইন দি এইট্টিন থার্টিজ় অ্যান্ড এইট্টিন ফর্টিজ় হু থট অ্যান্ড স্পোক ইন টার্মস দ্যাট স্টিল স্ট্রাকচার সাম অব দ্য ডিসকোর্স টুডে।”

দীপেশ চক্রবর্তীর প্রভিনশিয়ালাইজ়িং ইউরোপ অথবা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ডেরিভেটিভ ডিসকোর্স-এর ধারণা, এই দুইয়ের বিপ্রতীপে তাঁর কাহিনির কুশীলবদের দাঁড় করাতে চাইছেন রোসিঙ্কা। ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যদের যে উপরেরদুটো কাঠামোতেই অনায়াসে বসিয়ে দেওয়া চলে, এই ধারণাকেই প্রশ্ন করছেন লেখক। আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের চলনে, বলনে, মননে ইউরোপীয় সভ্যতার খুব কাছাকাছি অবস্থান বলেই এঁরা স্পষ্ট বুঝেছিলেন “দি ইম্পসিবিলিটি অব ‘বিকামিং ইউরোপিয়ান’”। বরং একাধারে ব্রিটিশ শাসক আর অপর দিকে পৌত্তলিক হিন্দুবাদীদের ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে, সচেতন ভাবে তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করে এঁরা নিজেদের ‘আধুনিক ভারতীয়’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন— এ কথাই এই বইয়ে লেখকের মূল তর্ক।

‘জার্গন’ক্লিষ্ট, জটিল অ্যাকাডেমিক গদ্যে লেখা নয় এই বই। তরতরিয়ে পড়া চলে, তাত্ত্বিক হোঁচটে কেটে-ছড়ে যাওয়ার বিপদ নেই। বিদ্যায়তনিক পরিসরের বাইরে সাধারণ শিক্ষিত ‘রিডিং পাবলিক’ অনায়াসে উল্টেপাল্টে দেখতে পারেন, এমন গদ্যে লেখা। আজকের ভারতে এ-হেন পরিশ্রমসাধ্য গবেষণা পপুলার ইতিহাসের আঙ্গিকে উপস্থাপিত হওয়া জরুরিও বটে। সন্দেহ নেই, এমন বই আম-পাঠককে ইতিহাসের তথ্যনিষ্ঠতা ও সবিচার চিন্তাপ্রণালীর প্রতি আকৃষ্ট করে। রোসিঙ্কার এই বই জনমানসে দাগ কাটবে, নিশ্চিত ভাবে। ইতিহাসের পেশাদার কারবারিরাও ইয়ং বেঙ্গলকে অন্য ভাবে ফিরে পড়বেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy