Advertisement
E-Paper

Book review: বড় রকমের কিছু ফাঁক থেকে গেল

মিলন দত্তের বইটি, কিছু শৈলীগত বিচ্যুতি সত্ত্বেও, কেবল মুসলমান সমাজকে জানার জন্যই নয়, বাংলাভাষী পাঠকের আত্মোপলব্ধির জন্যও জরুরি।

কুমার রাণা

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২১ ০৪:৫৩

কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান
মিলন দত্ত
২৫০.০০
প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

হাইস্কুলে ‘নামকরণের সার্থকতা’ বিষয়ে একটা প্রশ্ন আসত। মিলন দত্তের বইটি নিয়ে তেমন প্রশ্ন এলে লিখতাম, নামকরণ সুচিন্তিত এবং সম্পূর্ণ সার্থক। শিরোনামেই পাঠক জেনে যাচ্ছেন, আলোচনাটি পশ্চিমবঙ্গের ধর্মপরিচয়ে মুসলমানদের নিয়ে— বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে নয়। পার্থক্যটা খুব জরুরি— পশ্চিমবঙ্গে বাস করাটাই বাঙালি হওয়ার একমাত্র শর্ত নয়, তার আরও অনেক দাবি আছে, যেমন ভাষা ও সংস্কৃতির সংযোগ। এ রাজ্যে বসবাসকারী সব হিন্দু, খ্রিস্টান, জৈন, শিখ এবং নাস্তিকের ভাষা যেমন বাংলা নয়, তেমনই সব মুসলমানই বাংলা ভাষায় কথা বলেন না। তাঁদের মধ্যে একটা ছোট, কিন্তু ভৌগোলিক-রাজনৈতিক কারণে তুলনামূলক ভাবে ক্ষমতাবান অংশের ভাষা বাংলা নয়। বইটির বিশ্লেষণগত সার্থকতা এখানেই যে, লেখক এ রাজ্যের মুসলমানদের বিভিন্নতাপূর্ণ সমাজ সংগঠনের দিকটিকে স্পষ্ট ভাবে পাঠকের অবধানে নিয়ে এসেছেন। এর একটা দিক হল, রাজ্যের প্রায় নব্বই ভাগের উপর মুসলমান বাংলাভাষী হলেও, ‘বামফ্রন্ট আমলেও যেমন, তৃণমূল সরকারের সময়েও প্রশাসন মুসলমান বুদ্ধিজীবী বা সমাজের মাথা বলতে গুটিকয় উর্দুভাষী মৌলানাকে বোঝে।’ সরকারের এই বোঝাটার সঙ্গে আবার অ-মুসলমান, বিশেষত বাঙালি হিন্দুর বোঝার পারস্পরিকতা আছে— “প্রতিবেশী হিন্দুরা ধরেই নিয়েছে, মুসলমান একটা ‘মোনোলিথিক’ সমাজ। সেখানে ভিন্ন স্বরের অস্তিত্ব নেই। থাকলেও তা উচ্চারণ করা নিষেধ।” আদ্যন্ত বাঙালি কোনও মুসলমানকেও শুনতে হয়: ‘আপনি চমৎকার বাংলা বলেন তো!’ মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু পড়ে বঙ্কিমের যে অ-প্রতীতি জন্মায়, এ রচনা মুসলমানের বলে মনে হয় না, সেই অবিশ্বাস দুর্বল হওয়া দূর, শ্রুতি-পরম্পরায় বলবতী হয়েছে।

ফল হয়েছে মারাত্মক। প্রতিবেশী মুসলমানকে চেনার, জানার, এই সহনাগরিকদের অধিকার সুনিশ্চিত করে সমাজের বিকাশে সমান হিস্যাদার করে তোলার যে দায়িত্ব ক্ষমতাগুরু বাঙালির স্বাভাবিক কর্তব্য ছিল, তা পালনে বড় রকমের ফাঁক থেকে গেল। বহু সাক্ষ্যপ্রমাণ তুলে ধরে লেখক চোখে আঙুল দিয়ে নানাবিধ বঞ্চনা দেখিয়ে দিচ্ছেন। এ বঞ্চনার শিকার কি কেবল মুসলমান? গোটা পশ্চিমবঙ্গও কি নয়? সমাজের এক-চতুর্থাংশ মানুষকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখার ধারায়, মুসলমানের সঙ্গে রাজ্যের গড় উন্নতিও কি রুদ্ধ হয়ে গেল না? নিরক্ষরতা, অ-স্বাস্থ্য, কর্মহীনতা, দারিদ্রের মতো যে বৈশিষ্ট্য মুসলমান সমাজের পরিচয়, সেই ক্ষত পুরো রাজ্যের উন্নতিকে পিছনে টেনে রাখল।

অথচ, এই দুর্বলতাগুলি দূরীকরণের চেষ্টা না করে, সরকার ও শিক্ষিত সমাজ এর জন্য মুসলমানকেই দায়ী করে এসেছে। এবং, বঞ্চনা ও অপরিচয়ের দুর্যোগে প্রতিবেশীকে করে তোলা হয়েছে সন্দেহভাজন। মিলন লিখেছেন: যে প্রদেশে— ‘সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মাদ্রাসাশিক্ষার সূচনা কলকাতাতেই ১৭৮০ সালে’— সেখানেই, ‘আমেরিকার টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার আগে পর্যন্ত মাদ্রাসা নিয়ে সাধারণ বাঙালির আগ্রহ ছিল সামান্যই।’ তার পর, ‘সত্যমিথ্যা মিলিয়ে সংবাদপত্রে আজও লেখা হচ্ছে বিস্তর।’ এমনকি কর্তাব্যক্তিরাও কোনও তথ্যসূত্র ছাড়াই ‘মাদ্রাসা মানে জঙ্গি তৈরির আখড়া’ বলে প্রচার করতে দ্বিধা করলেন না। এই মূঢ় অজ্ঞানতা দূর না হলে বাংলার মুসলমানের যেমন উন্নতি নেই, তেমনই সামগ্রিক ভাবে বাংলার সমাজেরও অগ্রগতির নিশ্চয়তা নেই। মিলন দত্তের বইটি, কিছু শৈলীগত বিচ্যুতি সত্ত্বেও, কেবল মুসলমান সমাজকে জানার জন্যই নয়, বাংলাভাষী পাঠকের আত্মোপলব্ধির জন্যও জরুরি।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy