এই আপাত-তুচ্ছ কথোপকথনটির মাধ্যমে তাঁর সুবৃহৎ গ্রন্থ শুরু করেছেন দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর ডাকাবুকো যুদ্ধ-সংবাদদাতা ক্রেগ হুইটলক। কেন এই ঘটনাটিকে মুখবন্ধের মতো সামনে নিয়ে এলেন তিনি? কারণ, এই ছোট্ট ঘটনাটির আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে এক দীর্ঘ মিথ্যার অবয়ব। ভিয়েতনামের মতোই আফগানিস্তান যুদ্ধেও আমেরিকা তার দেশবাসী তথা গোটা বিশ্বকে দশকের পর দশক ধরে যে মিথ্যার পাঁচন গিলিয়ে এসেছে, এই গ্রন্থে অজস্র গোপন জবানবন্দি, নথি ও তথ্যের বাতি জ্বেলে তার উপর আলো ফেলেছেন সাংবাদিক হুইটলক। আর তাই তিনি বলেন, “এই বইটি আফগানিস্তানে আমেরিকার যুদ্ধাভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ খতিয়ান নয়। সামরিক পরাক্রমের ইতিহাসও নয়। বরং এই বইটিতে বলা হয়েছে কোথায় গলদ ছিল, যে কারণে পর পর তিন জন প্রেসিডেন্ট এবং তাঁদের প্রশাসন সত্যিটা বলে উঠতে পারেননি।”
দি আফগানিস্তান পেপার্স-এর প্রতিটি ইট গাঁথা হয়েছে এক হাজারেরও বেশি সেনার গোপন জবানবন্দির কয়েক হাজার পাতার নথি-নির্যাস থেকে, যে সেনা সরাসরি যুদ্ধে জড়িত ছিল। যারা জানত, সরকারি ভাবে দেশের মানুষকে যা জানানো হচ্ছে তা অনেকটাই মিথ্যা, তাতে আমেরিকার জাতীয় আবেগের ঠুলি পরানো। এই অসম্পাদিত বিপুল নথি সংগ্রহ করতে বহু পথ হাঁটতে হয়েছে হুইটলককে।
২০১৬ সালের গ্রীষ্মে হুইটলক খবর পেলেন যে, পেন্টাগনের কাবুল সংক্রান্ত প্রায় তামাদি হয়ে যাওয়া একটি সংস্থা ‘সিগার’ (অফিস অব দ্য স্পেশাল ইনস্পেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশন)-কে আবার জাগিয়ে তোলা হয়েছে। তারা বিধ্বস্ত, হতাশ, সর্বস্ব খোয়ানো আফগানিস্তান-ফেরত সেনাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে, খুব গোপনে। এ-ও জানা গেল, গোটা প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘লেসন্স লার্নড’। উদ্দেশ্য, আফগানিস্তান যুদ্ধে আমেরিকার নীতির ব্যর্থতাগুলিকে চিহ্নিত করা, যাতে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, চোখে ঠুলি বাঁধা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা পনেরো বছর চালিয়ে যাওয়ার পর কিছুটা হলেও টনক নড়েছে ওয়াশিংটনের। তা-ও পুরোপুরি ভাবে তো নয়ই। দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরে আমেরিকা ‘লেসন্স লার্নড’ রিপোর্ট আকারে প্রকাশ করে ঠিকই, কিন্তু তা ছিল দেখনাই। সেখানে গোপন করা হয় সরকারবিরোধী যাবতীয় সমালোচনা ও ভাষ্য। ছাড়ার পাত্র ছিলেন না হুইটলক। তথ্যের অধিকার সংক্রান্তে আইনের আওতায় তিনি আদালতে মামলা দায়ের করেন। সঙ্গে আর্জি জানান, ‘লেসন্স লার্নড’-এর যাবতীয় অডিয়ো ও ভিডিয়ো টেপ, ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশ্যে আনতে হবে। মানুষের অধিকার রয়েছে এই যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে সেনাদের সমালোচনা শোনার, করদাতাদের বিপুল অর্থ এই যুদ্ধের সঙ্গে যে হেতু সরাসরি যুক্ত।
যথারীতি সিগার তথা আমেরিকার সরকার গড়িমসি শুরু করে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর পক্ষ থেকে পর পর দু’টি ফেডারাল ল-সুট করা হয় ওই নথি প্রকাশের জন্য। তিন বছর চলে আইনি যুদ্ধ। তার পর দু’হাজার পৃষ্ঠার কিছু বেশি নথি প্রকাশ করে সিগার, যেখানে যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত সেনার সাক্ষাৎকার রয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ প্রবীণ সামরিক অফিসার সরাসরি বলছেন, যুদ্ধের নামে যা ঘটে চলেছে তা দেশের পক্ষে এক বিপুল বিপর্যয়। পেন্টাগন, বিদেশ সচিবালয় এবং হোয়াইট হাউস থেকে নিয়মিত যে আশাব্যঞ্জক মদগর্বী বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে, তা ডাহা মিথ্যা।
এই বইয়ে মিথ্যার ভাঁজ পরতে পরতে খুলেছেন হুইটলক। ২০০১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত কুড়ি বছর ধরে চলা পৌনে আট লক্ষ আমেরিকান সেনার এই দীর্ঘ যুদ্ধে একুশ হাজার সেনা ফিরেছেন মারাত্মক জখম হয়ে, প্রাণ হারিয়েছেন ২,৩০০ জন। সরকার এই যুদ্ধের পিছনে খরচ করেছে এক লক্ষ কোটি ডলার। যুদ্ধের সময়কে এই বইটিতে ছ’টি পর্বে ভেঙেছেন লেখক— প্রত্যেকটি পর্বের নামকরণ যেন এক-একটি দরজার মতো, যা আমেরিকার প্রোপাগান্ডার সুড়ঙ্গ খুলতে খুলতে এগিয়েছে। প্রথম পর্ব একদম গোড়ার, অর্থাৎ ২০০১-০২। নাম দেওয়া হয়েছে, ‘বিজয়ের এক মিথ্যা খতিয়ান’। দুই, ২০০৩-০৫, যে পর্বের নাম ‘এক নিদারুণ বিভ্রান্তি’। ২০০৬-০৮’এর পর্বের নাম ‘তালিবানের ফিরে আসা’। ২০০৯-১০, ‘ওবামার অতিরিক্ত সংযোগের চেষ্টা’। ২০১১-১৬, ‘যখন সব ভেঙে পড়ল’। শেষ, অর্থাৎ ২০১৭-২১’এর নাম ‘অচলাবস্থা’।