E-Paper

এ গানের বাণীতে ভারতের সব মানুষের কথা

সহজ আখ্যানের ভঙ্গিতে লেখা বইটি অনায়াসে জনগণমন-বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে ফেলে পাঠককে।

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:৪৪
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

একটি কথা খুব শোনা যায়— একই কবি বা সঙ্গীতরচয়িতার লেখা দু’টি গান দু’টি দেশের জাতীয় সঙ্গীত, এমন উদাহরণ আর নেই। তেমনই, একই দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে দু’টি গানের সমান্তরাল দাবি, কিংবা আবেদন, এমন উদাহরণও পৃথিবীতে বেশি আছে কি? ‘বন্দে মাতরম্’ বিতর্ক দেশময় আবার ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই ওঠে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটির কথাও, কেননা প্রথমটির প্রতি অন্যায় করা হয়েছে দ্বিতীয়টিকে জাতীয় সঙ্গীত করে, হিন্দুত্ববাদী এই অভিযোগ অনেক দশকের। আলোচ্য বইটি এ জন্যই জরুরি। বস্তুত, বন্দে মাতরম্ নিয়ে আগে প্রামাণ্য ইতিহাস প্রকাশিত হলেও জনগণমন অধিনায়ক নিয়ে আগে এমন বই লেখা হয়নি।

সহজ আখ্যানের ভঙ্গিতে লেখা বইটি অনায়াসে জনগণমন-বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে ফেলে পাঠককে। মনে করিয়ে দেয়, এই গান জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে মনোনীত হওয়ার পথটি ছিল বন্ধুর। জওহরলাল নেহরুকে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট যুক্তি ব্যয় করতে হয়েছিল। বলতে হয়েছিল, এই গানটি বিশ্বের নানা সভায় গাওয়ার উপযোগী বিশিষ্ট ও মর্যাদাময়, ‘ডিস্টিংটিভ অ্যান্ড ডিগনিফায়েড’, কিংবা অর্কেস্ট্রার সঙ্গে গাইবার মতো। বলতে হয়েছিল যে, ভারতের জাতীয় গান হিসাবে নেতাজির আজ়াদ হিন্দ ফৌজ বিদেশের মাটিতে ১৯৪২ সালে এটি গেয়েছিল— সুতরাং তখনই আট বছর হয়ে গিয়েছে জাতীয় গানটির আন্তর্জাতিক পরিচিতির। এও বলতে হয়েছিল যে শুধু সংবিধান-সভাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কোনটি জাতীয় সঙ্গীত হবে। তবে ১৯৫০ সালে ২৪ জানুয়ারি দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ নিজেই বলে দিলেন, জনগণমন জাতীয় সঙ্গীত, তবে জাতীয় সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত বন্দে মাতরম্ গানটিরও সমান সম্মান প্রাপ্য।

সং অব ইন্ডিয়া: আ স্টাডি অব দ্য ন্যাশনাল অ্যান্থেম

রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়

৩১০.০০

আলেফ

১৯১১ সালে লেখা জনগণমন নিয়ে অন্য বিতর্কটি ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’র অর্থ নিয়ে। কে এই ভাগ্যবিধাতা— সেই সময়ে ভারতে সফরে আসা ব্রিটিশ রাজা, না কি বৃহত্তর কোনও ভাগ্যনিয়ন্তা? রুদ্রাংশু দেখান, ভারতমাতা-র কল্পনাতেও যে জীবননিয়ন্তার বোধ, এখানেও তাই— পরিবার-পরিমণ্ডল সূত্রে যা রবীন্দ্রনাথ বহন করছিলেন। দাদা সত্যেন্দ্রনাথের ‘জয় ভারতের জয়, গাও ভারতের জয়’ কিংবা ভাগ্নি সরলা দেবীর ‘নমো হিন্দুস্তানি’র পরোক্ষ ধ্বনি বেজে ওঠে এই গানের মধ্যে। বেজে ওঠে এর আগের বছরই লেখা ‘ভারততীর্থ’ কবিতার অমোঘ ছত্র, ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’? ‘মহামানব’ তো কোনও মহান মানব নন, তা আসলে বৈচিত্রময় মানবতার ধারক-বাহক। ভারতভাগ্যবিধাতাও কোনও একক মানুষ বা শক্তি নন, জনগণমন-রই আর এক রূপ।

অসাধারণ ভাবে লেখক বইটির মূল বক্তব্যের সঙ্গে গেঁথে ফেলেন দীর্ঘ প্রাক্‌কথনকে, যেখানে রবীন্দ্রনাথের জীবনে ও জীবনদর্শনে সাধারণ মানুষের কেন্দ্রীয় ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। শিলাইদহের পদ্মাপারের গ্রামজীবন থেকে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর প্রত্যন্তের পল্লীসংস্কার, রবীন্দ্রনাথের চেতনাজগৎকে সমগ্রত ঘিরে লেখা এই অংশটি জনগণমন গানকে চেনায় নতুন আলোয়। এও বুঝিয়ে দেয়, কেন আর সব ছেড়ে এই গানটিকেই স্বাধীন বহুসংস্কৃতিময় বহুঐতিহ্যধন্য ভারতের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে হয়েছিল নেহরুর। আজকের ভ্রান্ত ও বিভ্রান্ত ইতিহাসচর্চার ভারতে আবশ্যিক পাঠ্য এই বই।

জওহরলাল

নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়

২৫০.০০

বিচিত্রপত্র গ্রন্থন বিভাগ

নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের নাম শুনলে সম্ভবত এখনও প্রৌঢ়দের মনে পড়ে যায় শৈশবের কথা— ‘গল্পদাদুর আসর’। শিশু-কিশোর মনের অন্দরে তাঁর একটা স্বচ্ছন্দ গতি ছিল। সম্ভবত সে কারণেই তাঁর লেখা বাংলায় প্রকাশিত জওহরলাল নেহরুর প্রথম জীবনীটির চলনও, কোনও স্পষ্ট উল্লেখ ছাড়াই, কিশোর মনের ছন্দ মেনে চলে।

এমনিতে ছোটদের জন্য নেহরুর জীবনী লেখা বেশ দুরূহ কাজ— কারণ, তাঁর জীবনে নাটকীয় মুহূর্তের কিঞ্চিৎ অভাব রয়েছে; তাঁর চিন্তাও অনেক বেশি জটিল এবং রাজনৈতিক। ছোটদের গল্পে যেমন নায়কের প্রয়োজন পড়ে, জওহরলাল তেমন নায়ক নন। এই বইটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব হল, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ এমন ভাবে নেহরুর জীবনের কাহিনি শুনিয়েছেন যে, সে কাহিনির নায়কের মহিমা সম্পূর্ণ না বুঝলেও তার রসাস্বাদনে অসুবিধা হয় না।

মূলত নেহরুর অ্যান অটোবায়োগ্রাফি-কে আশ্রয় করেই লেখা বইটি। এমন কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন লেখক, যা থেকে নেহরুর মানসিক গঠনটি চেনা যায়। প্রতাপগড় কৃষি বিক্ষোভ তাঁকে প্রথম চিনিয়েছিল প্রকৃত ভারতবর্ষকে— দরিদ্র, নিরক্ষর, কোনও ত্রাতার অপেক্ষায় থাকা ভারত। তখনও হিন্দুস্থানি ভাষায় বক্তৃতা করতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না নেহরু, তাঁর ভাষা ছিল ইংরেজি। সেই মানুষটিই কী ভাবে মিশে গেলেন দেশের আত্মায়, এই জীবনীতে তার আভাস আছে। তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা, সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস, অটল ধর্মনিরপেক্ষতার বহু উদাহরণ রয়েছে লেখায়। আজ যখন নেহরুর যে কোনও কৃতিত্বকে অস্বীকার করা একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক প্রকল্প, তখন এই ক্ষীণতনু জীবনীটি পড়ে ফেললে অন্তত একটা লাভ নিশ্চিত— জওহরলাল নেহরু বিষয়ে কে সত্য বলছেন আর কে মিথ্যা, এবং মিথ্যা বলার কারণটি কী, তা বুঝতে সুবিধা হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy