Advertisement
E-Paper

নতুন পাঠের পথ দেখালেন

শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় সেই আদি পর্ব শুরু করেছেন ভীষ্ম পর্ব থেকে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সবে শুরু হবে। সেই ভোরে অস্থির ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে শুধু সঞ্জয়। হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে ঝড়ের মতো ঢুকে ব্যাস তাঁরই সন্তান জন্মান্ধ কৌরবকুলপতিকে নিজের চোখেই যুদ্ধ দেখার বর দিতে চেয়েছিলেন।

অলখ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
প্রস্তুতি: সমরাঙ্গনে উপস্থিত কুরু-পাণ্ডব সেনাবাহিনী। গ্রাফিক নভেলের প্রথম দৃশ্য

প্রস্তুতি: সমরাঙ্গনে উপস্থিত কুরু-পাণ্ডব সেনাবাহিনী। গ্রাফিক নভেলের প্রথম দৃশ্য

ব্যাস/ দ্য বিগিনিং

লেখক: শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়

শিল্পী: শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায়

৫৯৯.০০

পেঙ্গুইন বুকস

রামায়ণে কাহিনি যত এগিয়েছে, চরিত্র বেড়েছে। সংকট তৈরি হয়েছে। তার মোকাবিলা করতে হয়েছে। আর মহাভারতে বিপরীত। চরিত্র কমেছে। নানা সংকটও যেন আস্তে আস্তে গুটিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে। যে সব সংকট, অনিশ্চয়তা, প্রশ্নের সূচনা প্রধানত আদি পর্বেই।

শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় সেই আদি পর্ব শুরু করেছেন ভীষ্ম পর্ব থেকে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সবে শুরু হবে। সেই ভোরে অস্থির ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে শুধু সঞ্জয়। হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে ঝড়ের মতো ঢুকে ব্যাস তাঁরই সন্তান জন্মান্ধ কৌরবকুলপতিকে নিজের চোখেই যুদ্ধ দেখার বর দিতে চেয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র শুধু শুনতে চাইলেন। তাই দিব্যদৃষ্টি পেলেন সঞ্জয়। তার পরেই ব্যাস ঘোষণা করেছিলেন, এই সংঘাতের কাহিনি অমর করে দিতে তিনি একটি কাব্য রচনা করবেন। ছেড়ে চলে গেলেন হস্তিনাপুর। এর ঠিক পরেই ব্যাস/ দ্য বিগিনিং গ্রাফিক নভেলের দৃশ্যটিতে শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায় আঁকছেন পাতা জোড়া একটি বিরাট রাজসভা। সেখানে শুধু অন্ধ শ্রোতা ও দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন কথক। ধৃতরাষ্ট্র ও সঞ্জয়। তাঁরা নিশ্চিত জানেন, কী হতে চলেছে।

মহাভারতকে যদি এই ভাবে পড়া হয়, তা হলে পাঠককেও মাথা নিচু করে বইয়ের পাতায় চোখ ডুবিয়ে দিতে হয়। প্রথম দশ পাতাতেই ইঙ্গিত থাকে, নতুন পাঠের রাস্তা তিনি খুলে দিচ্ছেন। সত্যি বলতে, এই ‘প্রোলোগ’ অংশটি শেষ না হলে বোঝাই যায় না, মহাভারতের কাহিনি বলতে গিয়ে তিনি কেন বিভিন্ন অধ্যায়ের নাম দেন— ‘দ্য নিউজ স্প্রেডস’, ‘আ উওম্যান’, ‘মাদার্স অ্যান্ড সন্স’, ‘এনট্যাঙ্গলমেন্টস’, ‘কার্স অ্যান্ড বুন্‌স’ এবং ‘স্টেজ রিহার্সাল’।

‘দ্য নিউজ স্প্রেডস’-এ শিবাজী এ বার সত্যিকারের আদি পর্বে ফিরে যান। এই আদি পর্ব কিন্তু এই অঞ্চলের ইতিহাসেরও আদি পর্ব। গণেশ নেই। এখানে রয়েছেন এমন বিদ্বজ্জনেরা, যাঁরা তখনও মহাভারত শোনেননি। কিন্তু দর্শনের নানা মত তত দিনে তৈরি হচ্ছে। তর্কও শুরু হয়েছে। শিবাজী তাঁর কাহিনিতে সৌতিকে নৈমিষারণ্যে এমনই চার তার্কিকের সামনে নিয়ে গিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ, এ বার তিনি জানাচ্ছেন, কথক দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন নন, শ্রোতাও অন্ধ নন। শঙ্খের ছবিতে আমরা ততক্ষণে দেখে নিয়েছি, বিশাল নগর তৈরি হয়ে গিয়েছে। হাতি প্রতাপের প্রতীক হয়ে উঠেছে। মাথায় টোকা পরে কৃষকেরা শালি ধান চাষ শুরু করেছেন। হস্তিনাপুরের বাজারে পাহাড়ি উপজাতীয়রা আসছেন, পাহাড়ের ও পারের বণিকদেরও দেখা মিলছে।

কৃষ্ণ অনুপস্থিত। তাঁর প্রবেশের ঠিক মুখে শিবাজী কাহিনিকে সরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু চমৎকার চাতুর্যে সৌতি কৃষ্ণের মতো সাজ ধরেন, তবে পোশাক পীত নয়। এখানে বলে রাখা ভাল, শিবাজী মহাভারতের ভাণ্ডারকর সংস্করণ অনুসরণ করেছেন বলে জানালেও, এটি একটি উপন্যাসই। তাই শিবাজী কী কী বলবেন, কতটুকু বলবেন, তা বেছে নিচ্ছেন। তাঁর পছন্দ পরাশর, সত্যবতী প্রসঙ্গ। যযাতি। ইলা। পুরুরবা। ঊর্বশীর কথা নেই কিন্তু পুরুরবার কথায় সেই সব প্রশ্ন ও অনিশ্চয়তা রয়েছে, যা মনে করিয়ে দেয় নাসদীয় সূক্তের সংশয় ও প্রশ্নকে। অর্থাৎ, এই ভাবে কাহিনির কালসীমার একটি ইঙ্গিতও শিবাজী দিয়ে দেন। কাহিনির এখানে দু’টি স্তর। একটি ছবিতে ইতিহাস নির্ভর। অন্যটি, বৌদ্ধিক অনুশীলনের পরম্পরা। উপন্যাস বলেই সে দু’টি সর্বদা সমানুপাতিক নয়।

তাই তাঁর সৌতিও একটি চরিত্র হয়ে ওঠে। বিদ্বজ্জনেরা তাঁকে খাবার ও বিশ্রাম দিয়ে তা স্বীকারও করে নিচ্ছেন। তারপরে তার্কিকেরা সৌতিকে প্রশ্ন করছেন। ব্যাসের কাহিনি যদি সৌতি মুখস্থ বলে দিতেন, তা হলে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হত না। সৌতিকেই তার্কিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে এগোতে হচ্ছে। সৌতি ধৈর্যও হারাচ্ছেন। চিৎকার করে বলছেন, আর সব কাহিনিকে এই কাহিনির দাসত্ব করতে হবে। সৌতির সে কথায়, কাহিনি তখনই প্রতিষ্ঠার প্রতাপ দেখাতে শুরু করছে, যখন তা কেবলই তৈরি হওয়ার পথে।

সত্যি সত্যি মহাভারত এমন প্রশ্ন-উত্তরের সংঘাতের মধ্যে দিয়েও গড়ে উঠেছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু সেই পাঠপথে এগোলে মহাভারতের প্রাচীন কাহিনি অংশ ‘জয়’ চলে আসত সামনে। তারপরে তার গায়ে আরও কাহিনিস্রোতের পরত পড়তে পড়তে শেষ পর্যন্ত মহাভারত। শিবাজী সেই পথ নেননি। যে পুরো মহাভারত আমরা জানি, তিনি তারই কাহিনি বলেছেন মহাভারত গড়ে ওঠার ভঙ্গিটুকুকে স্বীকার করে নিয়ে। আর তা করতে গিয়ে দুষ্যন্তের রাজসভায় খোঁজ মিলেছে ভাঁড়ের। যেমন, হস্তিনাপুরের বাজারে এ বার এমন মাটির জালা দেখা গেল, যার গায়ে হরপ্পার সিলের খুব কাছাকাছি ছবি আঁকা। সিংহাসনে সিংহমূর্তি এল। কাহিনিতেও প্রতিষ্ঠার প্রতাপ যে বাড়ছে, তারও প্রমাণ মেলে পরক্ষণেই। যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত ভীষ্মকে দেখে কাশীর পণ্ডিতেরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন।

কিন্তু তর্ক যে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবেই মহাভারতের অংশ বলে বিবেচিত হবে, তা বোঝা যায়, পাণ্ডুর মৃত্যুর পরে যখন শিবাজীর ওই চার তার্কিকের এক জন প্রশ্ন করেন, ‘কেন বিদুরকে রাজার পদে ভাবা হল না?’ মুহূর্তটি শঙ্খ এঁকেছেন সযত্নে। তাঁর বলিষ্ঠ রেখা আর আলোছায়া মাখা দৃশ্যগুলো প্রশ্নার্ত উপন্যাসটিকে জড়িয়ে রেখেছে সাদরে। আর ধন্যবাদ পেঙ্গুইন বুকসকে, তুলনামূলক ভাবে সস্তায় এই ছবিতে উপন্যাস প্রকাশের জন্য।

Book Review Vyasa: The Beginning
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy