Advertisement
E-Paper

উল্লাস ও যন্ত্রণার তীব্র চিত্রনাট্য

চৌষট্টিটি রচনায় গ্রন্থিত এই বইটি, যার প্রতিটি রচনা, ক্বচিৎ একাধিক রচনা, এক-একটি বিচিত্র আর অনেক ক্ষেত্রে হিসাবহীন প্রতিভাকে, তাঁর যাপনের সমস্ত আর্তি আর দ্বন্দ্ব কুড়িয়ে নিয়ে, আমাদের সামনে এনে দাঁড় করাচ্ছে।

পবিত্র সরকার

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:১২
ঘুমের দরজা ঠেলে। চিন্ময় গুহ। সিগনেট প্রেস, ৩০০.০০

ঘুমের দরজা ঠেলে। চিন্ময় গুহ। সিগনেট প্রেস, ৩০০.০০

চৌষট্টিটি রচনায় গ্রন্থিত এই বইটি, যার প্রতিটি রচনা, ক্বচিৎ একাধিক রচনা, এক-একটি বিচিত্র আর অনেক ক্ষেত্রে হিসাবহীন প্রতিভাকে, তাঁর যাপনের সমস্ত আর্তি আর দ্বন্দ্ব কুড়িয়ে নিয়ে, আমাদের সামনে এনে দাঁড় করাচ্ছে। ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ নামটি সার্থক, কারণ প্রায় প্রতিটি রচনা শুরু হয়েছে রাত্রির আবহ নির্মাণ করে (২ “অনন্ত রাত্রির বুকে সমুদ্রে ভাসমান কয়েকটি কাগজের স্তূপে আগুন জ্বলছে”, ২১ “অক্ষরের স্তূপ পেরিয়ে, অন্ধকারের মরা খাত পেরিয়ে, তিনি হাঁটছেন রক্তপায়ে। ‘যদি দু’-একটা বীজ ভিজে ওঠে/ হাঃ হাঃ যদি দু’-একটা’”, ৪০ আমি এই মধ্যরাত্রে প্যারিসের ‘পের লাশেজ’ সমাধিক্ষেত্রে কী করছি?” ৫৮ “আমি এখনও সেই সমুদ্রসৈকতে শুয়ে।/ কয়েকটি কাঁকড়া হাঁটছে অনন্তের দিকে। দূরে বিন্দু বিন্দু আলো।”)। কেন? এমন ভাবা অনিবার্য হয়ে ওঠে যে, লেখক দিনের আলোর সাজানো কৃত্রিম গদ্যের রূঢ় স্পষ্টতাকে পরিহার করতে চেয়েছেন, গদ্যের যে প্রাচীন দাবি যুক্তিশৃঙ্খলা আর ভাবনার সুবিন্যস্ত অগ্রগতি—তা থেকে রেহাই খুঁজে নিয়েছেন, তাঁর নির্বাচিত ‘চরিত্র’গুলিকে— হ্যাঁ, ওই ষাটজনের মতো অমিত-প্রতিভাধরদের কেউ তাঁর কাছে ‘বিষয়’ নয়, ‘চরিত্র’— তাঁদের সম্বন্ধে তিনি বলার একটি নিজস্ব, অতিশয় ব্যক্তিগত ভঙ্গিমা বেছে নিয়েছেন। এ ভঙ্গিমাটি যেন সুররিয়ালিস্ট স্বপ্ন-সাক্ষাৎকারের। ওই মানুষগুলি যে দেশের যে সময়ের যে সংস্কৃতির হোন না কেন, চিন্ময় যেন ঘুমের মধ্যে দেখা নিজের একটি অসংলগ্ন অথচ সুবদ্ধ আচ্ছন্নতার পরিসর নির্মাণ করে, তাঁদের তাঁর নিজের অস্তিত্ব আর চেতনার মধ্যে, তাঁর নিজের বর্তমানে টেনে এনে, তাঁদের সঙ্গে সরাসরি মুখোমুখি হচ্ছেন। তাই এ লেখাগুলিতে নানা দৃশ্যপটে অন্যরা যেমন প্রবল ভাবে আছেন, তিনি নিজেও উপস্থিত আছেন তেমনই প্রবল ভাবে। দৃষ্টান্ত দেওয়ার লোভ সংবরণ করা কঠিন— “কেউ কোথাও নেই। এত রাতে জলের শব্দ? অশ্রুর মতো নিঃশব্দ সেই শব্দ মাঝরাতে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে। ছায়াবৃতা, কে তুমি বোদল্যের-এর স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে?/মৃত্যুপাথরের ফাঁক দিয়ে সে দ্রুত চলে যায়। দু’হাতে ক্রাচ।/ ক্রাচ? ওহ! জান দ্যুভাল। বোদল্যের-এর প্রেয়সী। তাঁর ‘কালো ভেনাস’! আমি পাগলের মতো ছুটি তাঁর পেছনে।”

কে নেই তাঁর এই নিজের নৈশ সমারোহে? শেক্‌স্পিয়ার, রবীন্দ্রনাথ (অন্তত দুটি রচনায়), ফিলিপ সিডনি, খ্রিস্টোফার মার্লো, ভিক্তর য়্যুগো, ভলতের, কোলরিজ, শেলি, বঙ্কিমচন্দ্র, এডগার অ্যালান পো, রম্যাঁ রলাঁ (চারটি রচনায়), লা রশফুকো (এঁর সুবচনগুলির অনুবাদের একটি বই আগে চিন্ময় আমাদের উপহার দিয়েছিলেন), বোদল্যের, কার্ল স্যান্ডবার্গ, তলস্তয়, লরেন্স স্টার্ন, নীট্‌শে (নামটা তো জার্মান, ‘নিট্‌শে’ হবে কি? আমাদের ‘নাৎসি’ও তো ঠিক নয়! জার্মানে দন্ত্য ত্‌ কোথায়? ‘ট্‌’ দিয়েই আমরা দন্তমূলীয় t বোঝাই তো। এই ফাঁকেই আর-একটা উচ্চারণ জিজ্ঞাসা গুঁজে দিই— চার্লস ল্যাম্ব হবে না ল্যাম্‌? নাকি আমাদের বাঙালিদের প্রতি করুণাবশত তিনি বানান-বদ্ধ উচ্চারণ লিখেছেন?), শোপেনহাওয়ার, মার্সেল প্রুস্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, মপাসাঁ, তরু দত্ত, মালার্মে, এলিয়ট, ইয়েট্‌স, এজরা পাউন্ড, অবনীন্দ্রনাথ, জাক প্রেভের, আপোলিনের, পল এল্যুয়ার (আবার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি, চিন্ময়ের কাছে কাঁচা শিক্ষানবিশ হিসেবে— আমরা তো ‘পোল’ জেনে এসেছি, বোদল্যের হচ্ছে যখন Baudelaire থেকে। তাই জঁ পোল্‌ সার্ত্রও তো হওয়ার কথা!) মায়াকভস্কি, ভার্জিনিয়া উল্‌ফ, সিলভিয়া প্লাথ, বেকেট, চ্যাপলিন, অন্নদাশঙ্কর রায় (দুটি রচনা), আঁরি মিশোঁ, অরুণ মিত্র, সত্যজিৎ রায়, শিলাদিত্য সেন উপস্থাপিত মৃণাল সেন, ফাদার দঁতিয়েন, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু যেমন আছেন, তেমনই আছেন (আমার কাছে) বেশ অচেনা নাম ফ্রাঁসিজ পঁজ, (ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়াঁ মিতেরঁ-র অবৈধ কন্যা?) মাজারিন, লুই সোজে, জান দুভাল, য়্যজেন গিল্‌ভিক্‌। আমার আরও ভাল লেগেছে কিছু কম আলোচিত অথচ অসামান্য গুণী মানুষকে চিন্ময় তাঁর আত্মবিস্তারের এই ইতিবৃত্তে তুলে এনেছেন বলে— তরু দত্ত, তাঁর শিক্ষক জ্যোতিভূষণ চাকী, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত যেমন।

যেমন বলেছি, এ লেখাগুলি এই সব মানুষগুলির সঙ্গে চিন্ময়ের ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, তাঁদের অন্তরবাহিরের সমস্ত নাটক ও কবিত্ব নিয়ে আমাদের সামনে হাজির। চিন্ময়ের কবিতা আমরা পড়েছি, এখন তিনি কবিতা লেখেন না তেমন, কিন্তু কবিত্ব তাঁকে ছেড়ে যায়নি, বরং এই গদ্যগুলিকে বিশেষ এক ব্যাকুলতা দিয়েছে, অথচ কোথাও কদর্থে ‘কাব্যিক’ করে তোলেনি। ঘুমের আচ্ছন্নতার, বা অন্ধকারের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন আবর্তছবির কথা বলেছি বলে যদি কেউ মনে করেন চিন্ময়ের মানুষগুলি সম্বন্ধে গোটা একটা ছবি ফুটে ওঠে না তা হলে ভুল করবেন। কারণ চিন্ময় প্রায় প্রত্যেকের জন্ম ও মৃত্যুর সাল সযত্নে জুড়ে দেন, গ্রন্থের তালিকা দেন কখনও-বা, না-বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে অনেকের সাংঘাতিক ভাবে বাঁচা জীবনের একটা গোটা ছবি আমাদের সামনে খুব অনায়াসে তৈরি করেন, ফলে এই মানুষগুলির কীর্তি, ব্যর্থতা, উল্লাস ও যন্ত্রণার তীব্র চিত্রনাট্য আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হতে থাকে। শুধু তাই নয়, কোনও রচনায় আসে ফরাসি নুভো রোমাঁ, অতিনিন্দিত অনুবাদকদের সশ্রদ্ধ বন্দনা, কবি ও রাত্রি কিংবা কবি ও সমুদ্রের, কিংবা স্রষ্টা ও মৃত্যুর নানা বিম্বনির্মাণের কথা, দাদাবাদ আর সুররিয়ালিজমের তত্ত্বসূত্র— সবই চমৎকার স্ফূর্তি পেয়ে যায় চিন্ময়ের হাতে। একজনের আলোচনাসূত্রে ঢেউয়ের দোলায় ভেসে এসেছে আরও কত নাম, শুধু দরজা নয়, অলিন্দ দিয়ে পৌঁছে গিয়েছে কত কত কথা— গ্রন্থের উপকারী নির্ঘণ্টটি দেখলেই পাঠক বুঝতে পারবেন।

এ বইয়ের আর-একটি আকর্ষণ হল আলোচিত কবিদের কবিতা— অন্নদাশঙ্কর আর জ্যোতিভূষণ চাকীর ক্ষেত্রে চমৎকার কিছু ছড়া চিন্ময় সংকলন করে দিয়েছেন। অ-ইংরেজ বিদেশিদের কবিতা কখনও নিজের অনুবাদে, কখনও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, পুষ্কর দাশগুপ্তের অনুবাদে। শেক্‌স্পিয়ার, মার্লো, কোলরিজ, শেলি, এলিয়ট, ইয়েট্‌স, কার্ল স্যান্ডবার্গের মতো ইংরেজিভাষী কবির কবিতা ইংরেজিতেই রেখেছেন, যেমন বাঙালি কবিদের কবিতা বাংলায়। এও এক মহাভোজের আয়োজন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে গদ্যসংলাপ, পাঠ, চিঠিপত্রও তুলে দিয়েছেন মানুষগুলিকে আরও কাছের থেকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য।

অল্প ছাপার ভুল আছে, সিগনেট প্রেসের বইয়ে তা না থাকলেই ভাল হত। আর চিন্ময় সংস্কৃত পণ্ডিতদের একটু জিজ্ঞেস করে জানবেন ‘রজদভ্র’ কথাটি (২৩৩ পৃ.) ‘রজত + অভ্র’ সন্ধি করে নির্মাণ অনুমোদনযোগ্য কি না। আমার একটু খটকা থেকে গেল। শুনতে অবশ্য ভালই লাগে। আগে উচ্চারণের কথা তুলেছি এই কারণে যে চিন্ময়ের কাছে আমরা উচ্চারণ শিখতে চাই।

আরও কত কী না চাই। বিশ্বসাহিত্যপাঠের এই আর্ত অভিযাত্রায় চিন্ময় যদি বার বার এ ভাবে আমাদের সঙ্গী করেন !

Book Chinmoy Guha
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy