শম্ভু মিত্র উৎপল দত্ত অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় পরবর্তী বঙ্গরঙ্গমঞ্চের পাঁচ জন নাট্যব্যক্তিত্বের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার সংবলিত বই বেরিয়েছে একটি। যে কথা বলোনি আগে/ এ বছর সেই কথা বলো (কালিন্দী ব্রাত্যজন, ২৫০.০০)। নতুন প্রজন্মের বিশিষ্ট নাট্যকার ও নির্দেশক ব্রাত্য বসুর সঙ্গে আন্তরিক কথোপকথন করেছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বিভাস চক্রবর্তী মনোজ মিত্র অরুণ মুখোপাধ্যায় অশোক মুখোপাধ্যায়। ভূমিকা-য় ব্রাত্য জানিয়েছেন ‘এই পাঁচজনের বহু কাজ দেখে প্রাণিত হয়েছি, লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, মনে হয়েছে এই পাঁচজনকে নিজের জানা এবং আর পাঁচজনকে বিস্তারিত ভাবে জানানো প্রয়োজন। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এই পাঁচজন ঠিক কোন্ অবস্থানে অ-মর হয়ে থাকবেন তার বৃত্তান্তের সুলুক সন্ধান করা উচিত।... আমি এঁদের তাই সময়ের নিরিখে খুঁড়তে চেয়েছিলাম। থিয়েটারের ইতিহাসের দিক থেকে যেমন, তেমনই ব্যক্তিগত দিক থেকেও। এঁদের জীবন ও থিয়েটারে এমন এক অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক ওতপ্রোত হয়ে আছে যে এছাড়া উপায় ছিল না।’
ব্রাত্যর কথার সঙ্গে, বিশেষত শেষ মন্তব্যটির সঙ্গে যদি এঁদের প্রত্যেকের কথাবার্তার কোনও-কোনও অংশ মিলিয়ে নেওয়া যায় তবে বইটির ধরন সম্পর্কে খানিকটা হদিশ পাওয়া যাবে। যেমন রুদ্রপ্রসাদ জানিয়েছেন ‘থিয়েটার করে ফেলেছি অ্যাক্সিডেন্টালি এবং করে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু থিয়েটার যে কী প্রচণ্ড দিয়েছে আমাকে ওরেব্বাপ রে বাপ!... থিয়েটার হ্যাজ গিভেন মি আ শেয়ার ইন ব্রিজ উইদ লাইফ।’ বিভাসের ইচ্ছা: ‘নিজের কতগুলো স্বপ্ন, থিয়েটার সম্পর্কে কিছু চিন্তাভাবনা, সেগুলো দেখে যেতে চাই, সেগুলো রূপ দিতে চাই। এগুলো যদি অ্যাম্বিশাস হয় তাহলে আমি অ্যাম্বিশাস। কিন্তু নিজেকে নিয়ে কোনো অ্যাম্বিশান নেই।’ মনোজের মনে হয়েছে ‘এই শহুরে জীবন সম্পর্কে আমার একটা মানসিক দূরত্ব আছে— আমার শহরভিত্তিক নাটক খুব কম আছে— এটাও ঠিক— আমি ফিরে গেছি গ্রামে, পুরাণে, ইতিহাসে— আসলে শহুরে জীবনে আমি হয়তো খুব একটা স্বস্তিবোধ করিনি।’ অরুণের সংকল্প: ‘থিয়েটারই করব। থিয়েটারে এখনও এত জিনিস রয়েছে— অনেক কিছুরই ধারে যেতে পারিনি। আমাদের বিজ্ঞানের জগতে গ্রহসন্ধান চলে না, থিয়েটারের জগতেও এরকম অনেক গ্রহ আছে— যার কিছুই জানি না আমি। থিয়েটার এত বড়ো আমার কাছে...’ এবং অশোকের স্বপ্ন: ‘নতুন নতুন পাড়ি দেওয়াই তো বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। নইলে চেনাপথে একটা নৌকোয় বারবার এপার-ওপার করা!... সত্তরের পর মনে হয় আর সময় নেই বোধহয়। এটার পরিণতি দেখার জন্যও তো আমায় তিন-চার বছরের একটা লড়াই করতে হবে। তখন আমার পালটা এ-ও মনে হয়, এই ভাঙা নৌকো নিয়েই পাড়ি দেওয়া, সে-ও তো একটা লড়াই।’
ব্রাত্যর স্বচ্ছন্দ সপ্রতিভ প্রশ্নাদির উত্তরে পাঁচজনের প্রত্যেকেই এত মসৃণ ভাবে কথা বলে গিয়েছেন যে পাঠক মাত্রেই উপভোগ করবেন। তার চেয়েও বড় কথা, বঙ্গরঙ্গমঞ্চ নিয়ে এঁদের ধারাবাহিক আলোচনায় জড়িয়ে গিয়েছে অবিভক্ত বাংলা ও দেশভাগের পরের পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আর সামাজিক ইতিহাস, এতে শিল্প-সময়-সমাজের আততি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংগ্রহে রাখার মতো বই।
একই প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে দেবাশিস রায় সম্পাদিত অনন্তের ভিতরে ঢেউ/ সমালোচনার নিরিখে বাংলা থিয়েটারের বিবর্তন (মুখ্য উপদেষ্টা: ব্রাত্য বসু। ৩৫০.০০)। নাট্যসমালোচনার ইতিহাস খুঁজবেন যাঁরা, তাঁদের কাজে আসবে বইটি। ‘নীলদর্পণ’ থেকে শুরু করে বাংলা থিয়েটারের আদিপর্বের নটনটীদের অভিনয় ও নির্দেশনার চিহ্ন, আবার ‘নবান্ন’ থেকে শুরু যে থিয়েটার তার উর্বরতার ছবি, এমনকী তারও পরবর্তী প্রজন্ম, বা একেবারে নতুন প্রজন্মের পরিচালকদের সৃষ্টির একটা ধারাবাহিক হদিশ এনে দেয় এ বই। বিভিন্ন প্রযোজনার সমালোচনার সঙ্গে রয়েছে সে-প্রযোজনার প্রথম অভিনয়ের তারিখ, চরিত্রলিপি, আলোকচিত্র ইত্যাদি। ‘থিয়েটারের যে সমগ্র ইতিহাস, তার টেক্সট, তার প্রযোজনা এই সবকে কেন্দ্র করে যে ক্রমাগত দিক্ বদল, সমগ্র যাত্রা পথে যে অজস্র বাঁক’— তাই তুলে আনার চেষ্টা করেছেন, জানিয়েছেন সম্পাদক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy