ছবি তোলার ১৭৫ বছরের ইতিহাসে কলকাতা শহর নানা ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরার সাক্ষী হয়ে থাকলেও সেখানকার ফোটোগ্রাফি চর্চা নিয়ে ছাব্বিশ বছর আগে প্রকাশিত সিদ্ধার্থ ঘোষের ছবি তোলা/ বাঙালির ফোটোগ্রাফি চর্চা আজও একমাত্র আকরসূত্র। কিন্তু গত এক দশকে ভারতে ফোটোগ্রাফি চর্চার আদি পর্ব নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। মূলত ‘দি আলকাজি ফাউন্ডেশন অব ফোটোগ্রাফি’-র উদ্যোগে একের পর এক প্রদর্শনী এবং তার ক্যাটালগ প্রকাশের ফলে যেমন বিপুল পরিমাণে দুর্লভ ছবি চোখের সামনে চলে এসেছে, তেমনই নানা আলোকচিত্রীর ছবি তোলার অন্তর্লীন নানা টানাপড়েনও স্পষ্ট হচ্ছে, তারই সূত্রে খুলে যাচ্ছে নতুন চিন্তার দরজা।
আলকাজি সংগ্রহের ভিত্তিতে সাম্প্রতিক এমনই দুটি প্রকাশনা ভারতে ফোটোগ্রাফি চর্চার দিগন্তকে আরও একটু প্রসারিত করল। আনভেলিং ইন্ডিয়া/ দি আর্লি লেন্সমেন ১৮৫০-১৯১০ (রাহাব আল্লানা ও ডেভি ডেপেলচিন, মাপিন/ আলকাজি ফাউন্ডেশন, ১৯৫০.০০) এবং অ্যালিগরি অ্যান্ড ইলিউশন/ আর্লি পোর্ট্রেট ফোটোগ্রাফি ফ্রম সাউথ এশিয়া (মাপিন/ আলকাজি ফাউন্ডেশন, ১৯৫০.০০): দুটি বইয়ের অভিমুখ শিরোনামেই স্পষ্ট। প্রথমটিতে জোর দেওয়া হয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের দুই পথিকৃতের উপর। দুজনেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসার। জন মারে (১৮০৯-১৮৯৮) আগ্রার সিভিল সার্জন নিযুক্ত হন ১৮৪৮-এ, দু’দশক তিনি সেখানেই ছিলেন। তার মধ্যে বছর দশেক টানা ছবি তুলেছেন মারে, তবে তাঁর নেশায় পরিণত হয় তাজমহল। যত রকম দৃষ্টিকোণ থেকে তাজকে দেখা যায়, সে সবই ছবিতে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। বিশেষ করে ড্যানিয়েলদের মতোই যমুনাতীরের অন্যান্য স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দিয়ে তাজকে দেখতে চেয়েছেন তিনি, যে সব স্থাপত্য আজ বিলুপ্ত। অন্য দিকে আলেকজান্ডার গ্রিনল’ ছিলেন মাদ্রাজ নেটিভ ইনফ্যানট্রির ক্যাপ্টেন, ১৮৫৩ থেকেই তিনি বিজয়নগর ও হাম্পি-র ধ্বংসাবশেষে আগ্রহী হন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি এই অঞ্চলে তাঁর তোলা শ’খানেক ছবি (পেপার নেগেটিভ) রক্ষা পেয়েছে আলকাজি সংগ্রহে। বিজয়নগর স্থাপত্যের যে পরিচয় সেখানে রয়ে গিয়েছে তা প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পরবর্তী পর্যায়ে আসছেন স্যামুয়েল বোর্ন (১৮৪৩-১৯১২) এবং রাজা দীন দয়াল (১৮৪৪-১৯০৫)। এঁরা দু’জনেই পেশাদার, বিভিন্ন ধরনের পৃষ্ঠপোষকের বিচিত্র চাহিদা মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও চেষ্টা করেছেন দেশবিদেশে ভারতের আলোকচিত্রের ‘চাহিদা’ তৈরি করতে। প্রাচীন স্থাপত্যের সঙ্গে নিসর্গদৃশ্য যেমন তাঁদের আকৃষ্ট করেছে, তেমনই ১৮৫৭-পরবর্তী ভারতে দ্রুত নগরায়ণের চালচিত্রও ধরা পড়েছে তাঁদের তোলা ছবিতে। এর পাশাপাশি আছে অনামা আলোকচিত্রীদের ছবিও। অজস্র দুর্লভ ছবি সহ এ বই ভারতে আলোকচিত্রের আদি পর্বের চমৎকার দলিল। দ্বিতীয় বই অ্যালিগরি অ্যান্ড ইলিউশন জোর দিয়েছে প্রতিকৃতি-আলোকচিত্রের উপর। ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ব্রহ্মদেশের (বর্তমান মায়ানমার) এই সব ছবি আসলে ‘এক জটিল অনুসন্ধানের সূচনাপর্ব’ বলে মন্তব্য করেছেন ক্রিস্টোফার পিনে। ক্যামেরার মুখোমুখি দক্ষিণ এশিয়ার এই মানুষেরা নিজেদের কী ভাবে দেখতে বা দেখাতে চেয়েছিলেন? মুঘল দরবারি চিত্রকলার অন্তিম পর্বের সঙ্গে গোড়ার দিকের প্রতিকৃতি-চিত্রের সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ? বিশেষ করে হাতে রঙ করা আলোকচিত্র তার প্রাথমিক মাধ্যমের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে যে অন্য মাত্রা সৃষ্টি করেছে সে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বেথ সিট্রন। আবার রাহাব আল্লানা একক প্রতিকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন ‘গ্রুপ’ ছবিকেও। উনিশ শতকের শেষে পিকচার পোস্টকার্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন আলোকচিত্র হাজার হাজার কপি মুদ্রিত হয়ে বিশ্বায়িত হল, দূর হয়ে উঠল নিকট। এ বইয়েরও পাতায় পাতায় আলকাজি সংগ্রহের অজস্র মণিমুক্তো।
মালবিকা কার্লেকর সংবাদপত্রের পাতায় ফোটোগ্রাফিকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন, এ বার তারই বত্রিশটি লেখা একত্র করে প্রকাশিত হল ভিসুয়াল হিস্টরিজ/ ফোটোগ্রাফি ইন দ্য পপুলার ইমাজিনেশন (অক্সফোর্ড, ৭৯৫.০০)। ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক দুটি পর্বের আলোকচিত্রের কথাই আছে এখানে। রাজা দীন দয়ালের মতো আলোকচিত্রীরা কী ভাবে কাজ করেছেন, নাম-না-জানা সহকারীরা কতখানি দায়িত্ব সামলাতেন, কেমন অ্যালবামে ছবি থাকত, পুরনো পারিবারিক অ্যালবামের গুরুত্ব কোথায়, লিনিয়াস ট্রাইপ, জেমস ওয়াটারহাউস, স্যামুয়েল বোর্ন, ফ্রেডরিক ফিবিগ, ফেলিস বিয়াটো, জন ট্রেসিডার— সে কালের আলোকচিত্রীরা কে কী ভাবে কাজ করেছেন তার খুঁটিনাটি কাহিনি আগ্রহী পাঠকের কাছে উনিশ ও বিশ শতকের গোড়ায় ভারতে আলোকচিত্রের জগৎকে স্পষ্ট তুলে ধরে। নানা দুর্লভ ছবির প্রসঙ্গে এসেছে বিচিত্র সব গল্প। ছবির মানুষদের পোশাক-পরিচ্ছদ, রবীন্দ্রনাথের চিত্রজীবনী থেকে আধুনিক পর্বে সুনীল জানা, কার্তিয়ে ব্রেসঁ কি উমরাও সিংহ শের-গিল-এর কথাও আলোচনা করেছেন মালবিকা। সিদ্ধার্থ ঘোষ তাঁর বইয়ে যাঁকে বিস্মৃতির আড়াল থেকে তুলে এনেছিলেন, সেই প্রথম পেশাদার মহিলা আলোকচিত্রী অন্নপূর্ণা গুপ্তের প্রসঙ্গে এসেছে অন্য মহিলা আলোকচিত্রীদের কথা। তথ্যে ভরা কিন্তু তরতর করে পড়ে যাওয়ার মতো বইটিতে একটি ভুল চোখে লাগে, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রসঙ্গে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ছবির ক্যাপশন কেন ‘ভিউ অব বুদ্ধ গয়া’ (পৃ ৪৭)?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy