Advertisement
E-Paper

রবীন্দ্র-মনীষার বহুমাত্রিক পরিচয়

রবীন্দ্রনাথই নাম দিয়েছিলেন ‘সাহিত্যিকা’, তাঁরই একটি বাক্য ছিল সংস্থাটির চালিকাশক্তি: ‘বিচিত্র বৃহৎ লীলার জগৎ সাহিত্যে’। প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে নির্ভেজাল সাহিত্যচর্চার জন্যই ১৯৩৭-এ শান্তিনিকেতনে গড়ে উঠেছিল এ সংস্থা। পত্রিকা প্রকাশ ও সাহিত্যসভা দিয়ে শুরু, পরে নাটক ও সঙ্গীত-সহ বহুমুখী সৃজনে এর অগ্রগতি।

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:২৯

রবীন্দ্রনাথই নাম দিয়েছিলেন ‘সাহিত্যিকা’, তাঁরই একটি বাক্য ছিল সংস্থাটির চালিকাশক্তি: ‘বিচিত্র বৃহৎ লীলার জগৎ সাহিত্যে’। প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে নির্ভেজাল সাহিত্যচর্চার জন্যই ১৯৩৭-এ শান্তিনিকেতনে গড়ে উঠেছিল এ সংস্থা। পত্রিকা প্রকাশ ও সাহিত্যসভা দিয়ে শুরু, পরে নাটক ও সঙ্গীত-সহ বহুমুখী সৃজনে এর অগ্রগতি। সেই জন্মলগ্ন থেকে বর্তমান পর্যন্ত ‘সাহিত্যিকা’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের নির্বাচিত সংকলন বেরল: বিচিত্র বৃহৎ লীলার জগৎ সাহিত্যে/ সাহিত্যিকা/ নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন (১৯৩৭-২০২৫), কুন্তল রুদ্র অসীম চট্টরাজের সংকলন ও সম্পাদনায়়় (স্যাস, ৫০০.০০)। সাক্ষাৎকার, ক’টি মূল চিত্র, প্রচ্ছদ, সাহিত্যিকা প্রযোজিত নাটকের আলোকচিত্র, সংস্থার ইতিহাসও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘এই সবের সমন্বয়ে গ্রন্থটি শান্তিনিকেতনের আশ্রমজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হবার দাবি রাখে।’ মনে করেন সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যিকা-র সভাপতি। বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ থেকে নন্দলাল বসু বা সোমনাথ হোরের লেখা যেমন আছে, তেমনই আছে শান্তিদেব ঘোষ বা বিনয়গোপাল রায়ের লেখা। অশোক রুদ্র অশীন দাশগুপ্তের রচনার সঙ্গে ঠাঁই পেয়েছে সত্তর দশকে প্রকাশিত শচীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিক্ষা ও সাম্রাজ্যবাদ’ ও সিদ্ধার্থ রায়ের ‘রক্তকরবীর রঞ্জন ও নন্দিনী’, দুই লেখকই অকালপ্রয়াত। রয়েছে প্রভাস সেন সত্যজিৎ রায় মৃণাল সেন ও শঙ্খ ঘোষের সাক্ষাৎকার।

এই মুহূর্তে ভারতের যা পরিস্থিতি তাতে জাতীয়তাবাদ নিয়ে কতটা সপ্রশ্ন ও সংশয়ী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তা জেনে নেওয়াটা জরুরি। কবির সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবনার দিকটি, বিশেষত জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত দিকটি নিয়ে যে ভাবে সমকালীন চিন্তাবিদ্‌রা আলোচনা করছেন, তাঁদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করানোর লক্ষ্যেই দেবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ-বিরোধী স্বদেশপ্রেম (সেতু, ১২৫.০০)। এক-একটি প্রশ্নের ভিতর দিয়ে এগিয়েছেন লেখক, লিখছেন ‘রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ-বিরোধী ছিলেন বটে, কিন্তু দেশকে তিনি কারোর চেয়ে কম ভলোবাসতেন না।... রবীন্দ্রনাথ আসলে প্রশ্ন তুলছেন ভালোবাসার এই বিশেষ ধরনটি নিয়ে। জাতীয়তাবাদকে যখন তিনি মনে করছেন দেশবন্দনার এক বিকৃত রূপ তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে— দেশকে ভালোবাসার বিকল্প পথটি তবে কেমন?’ উত্তর খুঁজেছেন লেখক, ‘শেষজীবনে পরিণত রবীন্দ্রনাথ কি ইউরোপীয় আধুনিকতার বিকল্প হিসেবে এক দেশজ আধুনিকতার সন্ধান করছেন এবং ন্যাশনালিজমকে বর্জন ও নেশন-স্টেটের উপর নির্ভরতা হ্রাসই কি সেই বিকল্প আধুনিকতার পূর্বশর্ত হয়ে উঠছে?’

রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসে গৌণ বা পার্শ্ব নারী চরিত্রদের পাঠ রুশতী সেনের এলোমেলো পাঠে রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য-য় (অক্ষর, ১৫০.০০)। যেমন যোগাযোগ আলোচনার সূত্রে ‘নারীভাবনার ব্যাপারটাও’ রুশতী জানিয়েছেন ‘ইতিহাসের ধুলো-কাদা, রোদ-বৃষ্টি, শ্রম-ঘাম, বৈভব-বৈষম্য, প্রতিকূলতা-আনুকূল্য বাদ দিয়ে গাছের পাকা ফলটির মতো উপন্যাসের জমিতে পড়তে পারে না।... সে কথাটা রবীন্দ্রনাথ আজকের চিন্তকদের থেকে খুব কম বুঝতেন না বোধহয়। তাই প্রতিবাদের মুহূর্ত বশ্যতার প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে, অথচ মুহূর্তের প্রখরতা রেখে যাচ্ছে তার রেশ, এমন আয়োজন বারবার ঘটেছে তাঁর সৃজনে। একেবারে আটপৌরে অন্দরের অন্তরে এমন ভাবনা এসে পড়েছে, এমন সংলাপ এসে পড়েছে অন্দরের কণ্ঠে, যে-মনন, যে-স্বর সাবেকি চলনে, আনুষঙ্গিক সহনে-বহনে নিহিত আশ্চর্য অনুভবময়তার হদিস দেয়; চেতনার কিনারে দাঁড়িয়ে প্রখর শক্তির ইঙ্গিত নির্মাণ করে। কালপ্রবাহের তোড়ে সে শক্তি হয়তো সম্পূর্ণ কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে না। তবু সে না পারায় হারিয়ে যায় না মুহূর্তের জোরটুকু।’ একই ভাবে উঠে আসে শেষের কবিতা-র যোগমায়া-র কথাও: ‘অন্যের হাতে পুতুলের জীবন থেকে মুক্তি মানেই কিন্তু স্বাবলম্বন নয়। এক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে যদি সূচনা হয় কোনো মুক্তি-মুক্তি খেলার, তবে তার পরিণতি হওয়া সম্ভব অন্য কোনো বন্ধনে! সেই বন্ধনের স্বরূপ যোগমায়ার চৈতন্যে না থাকলেও, অনুভবে ছিল নিশ্চয়!... তবু তো শেষের কবিতা-র পাঠক পার্শ্বচরিত্রের আবরণ সরিয়ে আজও তেমন তাকিয়ে দেখেন না যোগমায়ার দিকে!’

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বাংলা সাহিত্য পত্রিকা-র (সম্পা: বিশ্বনাথ রায়। ৩০০.০০) ‘রবীন্দ্র-জন্মসার্ধশতবর্ষপূর্তি সংখ্যা’টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ‘১৯১৯ সালে প্রথম অধ্যক্ষ দীনেশচন্দ্র সেন কিংবা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোনো না কোনো সূত্রে বাংলা বিভাগে যাঁরা পাঠদান করেছেন এবং এখনও পাঠদান করে চলেছেন তাঁদের লেখা দিয়েই সজ্জিত’ এ-সংখ্যা, জানিয়েছেন সম্পাদক। পূর্বপক্ষ-এ প্রয়াতদের রচনা, উত্তরপক্ষ-এ বর্তমান শিক্ষকদের। এতে যেমন প্রাচীন বাংলা বিভাগের রবীন্দ্রচর্চার হদিশ পাবেন পাঠক, তেমনই পাবেন রবীন্দ্র-প্রতিভার বিচিত্র দিকনির্দেশ, তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিলেখ, তাঁর সাহিত্যভাবনা ও ভাষারূপের সমালোচনা বা তা নিয়ে তৎকালীন প্রতর্ক, তাঁর বই ও ছবির ‘রিভিউ’, মনীষীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের খতিয়ান ইত্যাদি সব মিলিয়ে রবীন্দ্র-মনীষার বহুমাত্রিক পরিচয়।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy