Advertisement
E-Paper

স্থায়ী উত্তরাধিকার তৈরি করতে পারেনি

প্রগতি-সংস্কৃতির তিনটি উপাদান নিয়ে আলোচনা করেছেন অনুরাধা— নাটক/নাট্য, গান, আর আঁকা ছবি। তাঁর আক্ষেপ, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ, অনেক প্রতিশ্রুতি, অনেক সম্ভাবনার জন্ম দিয়েও এই তিন ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাব বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে তৈরি করেনি কোনও স্থায়ী উত্তরাধিকার।

সোমেশ্বর ভৌমিক

শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০১
কালচারাল কমিউনিজম ইন বেঙ্গল ১৯৩৬-১৯৫২, অনুরাধা রায়। প্রাইমাস বুকস, ১৫৯৫.০০

কালচারাল কমিউনিজম ইন বেঙ্গল ১৯৩৬-১৯৫২, অনুরাধা রায়। প্রাইমাস বুকস, ১৫৯৫.০০

অনুরাধা রায়ের বই পড়তে পড়তে ফিরে যাচ্ছিলাম নিজের কলেজজীবনে। সমমনস্ক বন্ধুগোষ্ঠীতে প্রগতিসাহিত্য, গণসংগীত, গণনাট্য, তেরোশো পঞ্চাশ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষ-কেন্দ্রিক উডকাট-লিনোকাট নিয়ে প্রবল আলোচনা হচ্ছে। ফ্যাসিবিরোধী লেখক সংঘ, প্রগতিশীল লেখক-শিল্পী সংঘ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের কর্মকাণ্ডে যুক্ত প্রবীণ মানুষদের কাছে শুনছি তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। বইপত্র, রেকর্ড, টেপ, ক্যাসেট, ছবির প্রিন্ট, নাটকের পত্রিকা ইত্যাদি জুটিয়ে পাঠচক্রে চর্চাও হচ্ছে। মন জারিত হচ্ছে শিল্পসংস্কৃতির এই বিশেষ ধারার অনুপ্রেরণা যে কমিউনিস্ট মতাদর্শ, তার রসে। গানে-গল্পে-তর্কে-সমালোচনায়-কিংবদন্তিতে ভরপুর ছিল জীবন-মনন।

পাশাপাশি কিছু প্রশ্নও কিন্তু ছিল আমাদের। লক্ষ করতাম, সমস্ত উত্তেজনা-উদ্দীপনার কেন্দ্রবিন্দু বা সম্বল দুই-তিন-চার দশক আগেকার পুরনো সৃষ্টিগুলো। আলাপ-আলোচনায়-অনুষ্ঠানে সেগুলোই ঘুরেফিরে আসত। স্বাভাবিক ভাবেই এমন অতীতনির্ভরতা খুব ভাল লক্ষণ বলে মনে হয়নি। ছিল অস্বস্তি— মতান্তর থেকে মনান্তর, বিবাদ, বিচ্ছেদ, গুজব, কুৎসা, এই সব নিয়ে। আমাদের দৌড় ওইটুকুই।

আর অনুরাধা তিন দশক আগে এ বিষয়ে পুরোদস্তুর এক গবেষণার কাজেই নেমে পড়েছিলেন নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন নিয়ে— কী ছিল এই আন্দোলনের লক্ষ্য? সাধারণ মানুষের সঙ্গে কতটা যোগ ছিল তার? কেন তা বিফল হল? সংস্কৃতির ইতিহাস-নির্মাণ এমনিতেই শক্ত কাজ, তার ওপর কমিউনিজমের মতাদর্শ জড়িয়ে অনুরাধার বিষয়নির্বাচনটিও ঝুঁকিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে লেখক-পাঠক উভয়পক্ষেই আবেগের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তাঁর বিচার-বিশ্লেষণের সঙ্গে যে সকলে একমত হবেন না সে কথাও অনুরাধা জানেন। এরকম একটি বিষয় নিয়ে কাজ করার সাহস দেখানোর জন্যেই তাঁর সাধুবাদ প্রাপ্য। এতদিন পরে ডক্টরেট উপাধি পাওয়ার জন্যে তৈরি সন্দর্ভটিকেই সামান্য পরিমার্জন করে প্রকাশের জন্যে দিয়েছেন অনুরাধা। তাঁর বিশ্লেষণ আর সমালোচনার ধার এবং তির্যক ভঙ্গি পাঠকের চোখ এড়াবে না। বাম জমানায় তাঁর মনে হয়েছিল, সরকারি বামপন্থীরা এসব মানতে পারবেন না। এখন তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ লাগছে তাঁর।

সময়ের ব্যবধান সত্ত্বেও পুরনো সন্দর্ভের কাঠামোয়, বক্তব্যে এমনকি তথ্যসংগঠনেও বিশেষ পরিবর্তন করা হয়নি। নতুন কিছু তথ্য সংযোজিত হয়েছে, কিন্তু তারও পরিমাণ খুব বেশি নয়। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে সরলরৈখিক বয়ানবদ্ধ এক ইতিহাস— কালানুক্রম মেনে ঘটনা আর চরিত্রের মিছিল। অনুরাধা বলেছেন, এই আখ্যাননির্ভর শৈলী বায়বীয় তত্ত্বনির্ভর বিশ্লেষণের চেয়ে বেশি কার্যকর। এখানে ঘাম-রক্তমাখা আকাঁড়া বাস্তবের স্পর্শ মেলে। একথাও বলেছেন, নতুন করে সন্দর্ভটি লিখতে হলে এরকম আখ্যাননির্ভর শৈলীর সাহায্য উনি নিতেন না।

নিজের কাজকে বিনয় করে তথ্যভারাক্রান্ত বললেও, যে বিপুল তথ্যভাণ্ডার অনুরাধা পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন, তার গুরুত্ব অপরিসীম। পুরনো তথ্য ব্যবহারের পাশাপাশি বেশ কিছু নতুন তথ্যের সাহায্যে কমিউনিস্ট সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অনেক অজানা অলিন্দে আলো ফেলেছেন উনি। বিপুল তথ্যভাণ্ডারকে ধৈর্য আর নিষ্ঠাসহকারে বিন্যস্ত করেছেন। আন্দোলনের যে আখ্যান তৈরি হয়েছে তাঁর হাতে, সেই আখ্যানে ঘটনা আর চরিত্রই শুধু নেই, আছে তাদের পরিবেশ-পরিপার্শ্ব, আছে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় রাজনীতির মুহুর্মুহু রঙবদল আর পালাবদলের খতিয়ান।

অনুরাধার আলোচিত সময়টা বিশ শতকের ইতিহাস-সরণির এক গুরুত্বপূর্ণ জলবিভাজিকা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরপর এসেছে ফ্যাসিবাদ বনাম গণতন্ত্রের বৈরিতামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আর বিশ্বজুড়ে প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদের অবসান। ভারতবর্ষের জাতীয় রাজনীতি ক্রমান্বয়ে দেখেছে উপনিবেশবাদী শাসনের অবক্ষয়, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের তীব্রতা এবং বৈচিত্রবৃদ্ধি, সাম্রাজ্যবাদী কূটনীতির পরিণতিতে দাঙ্গা, মন্বন্তর আর বিভাজনের মধ্যে দিয়ে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম। কিন্তু বড় ইতিহাসের মধ্যেও থাকে ছোট ইতিহাস। অনুরাধা বড় ইতিহাসের রাজপথকে মনে রেখেও পা ফেলেছেন স্থানীয় ক্ষেত্রের গলিপথে— যার সীমানা আদতে ছিল ভারতবর্ষের একটি প্রদেশ (বাংলা), পরে খণ্ডিত হয়ে পরিণত হল ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে (পশ্চিমবঙ্গ)। বড় ইতিহাসের ভার বেশি, যে ভারের মাসুল দিতে দিতে ছোট ইতিহাস হয়ে ওঠে অনাবশ্যক জটিল। সেই জটিলতার খোঁজ পাওয়ার চেষ্টা দেখা যায় এই বইতে।

প্রগতি-সংস্কৃতির তিনটি উপাদান নিয়ে আলোচনা করেছেন অনুরাধা— নাটক/নাট্য, গান, আর আঁকা ছবি। তাঁর আক্ষেপ, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ, অনেক প্রতিশ্রুতি, অনেক সম্ভাবনার জন্ম দিয়েও এই তিন ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাব বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে তৈরি করেনি কোনও স্থায়ী উত্তরাধিকার। সাহিত্যজগৎকে সচেতন ভাবেই নিজের গবেষণার বাইরে রেখেছেন তিনি। তাঁর কথায়, এই আন্দোলনভিত্তিক সাহিত্য আলোচিত তিন ক্ষেত্রের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ, আর তা নিয়ে গবেষণাও যথেষ্ট হয়েছে। অনুরাধা ঠিকই লক্ষ করেছেন, একই আন্দোলনের শরিক হলেও তাঁর আলোচিত তিনটি ক্ষেত্র তুলনায় উপেক্ষিত, আর ব্যাপ্তি এবং কার্যকারিতার বিচারে তাদের মধ্যেও প্রভেদ ছিল। তিনি বলেছেন, একমাত্র সংগীতের জগতে সামাজিক বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন, দমনের বিরুদ্ধে বামপন্থী চেতনা থেকে উঠে আসা গণসংগীতকে কেন্দ্র করে যে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল তা প্রায় গণআন্দোলনের চেহারা নিয়েছিল। কিন্তু তাতেও সমসাময়িক সংগীতক্ষেত্রে সার্বিক কোনও পরিবর্তন আসেনি। সার্বিক পরিবর্তন বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তা অবশ্য পরিষ্কার হল না। অনুরাধার আক্ষেপ, গণনাট্যের জগতে কিছু যুগান্তকারী কাজ সত্ত্বেও এখানে গণআন্দোলনের কোনও লক্ষণ চোখে পড়ে না; অথচ শিল্পগত পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্রে নাট্যকর্মীরাই সবচেয়ে বেশি সাহস দেখিয়েছেন। এক ধরনের পেশাদারি দক্ষতা আয়ত্ব করেছেন তাঁরা। এর ফলে বাংলায় থিয়েটার চর্চার পরিবেশটাই আমূল বদলে গিয়েছে বলে মনে হয়েছে অনুরাধার। চিত্র চর্চার ক্ষেত্রটি তুলনায় অখ্যাত হয়েও অল্প কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীর কাজের সূত্রে এক ধরনের সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল। আর অন্তত কিছুকালের জন্যে হলেও চিত্র-অনুশীলনের জগৎটি রাজনীতির জগতের কাছাকাছি এসে পড়েছিল। এর কৃতিত্ব শিল্পীদের নিশ্চয়ই। কিন্তু যে সব সংবেদনশীল সংগঠক তাঁদের উৎসাহ দিয়েছিলেন, তাঁদের দূরদৃষ্টিরও প্রশংসা করা দরকার। এই প্রসঙ্গে অনুরাধা একটি জরুরি কথা লিখেছেন— চিত্রকলার ওপরেই কমিউনিস্ট পার্টির খবরদারি সবচেয়ে কম ছিল। নাটক আর গানের ক্ষেত্রে এতখানি স্বাধীনতা পার্টির সদস্য, সহযাত্রী বা অনুগামী শিল্পীরা পাননি। কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্মের সার্বিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করেছেন অনুরাধা। বহু সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক ঘটনা, আর পালাবদলের বিশদ বিবরণ আছে তাঁর লেখায়। বোঝা যায়, কী ভাবে রাজনৈতিক জটিলতার চাপে, অর্থাৎ ঘন ঘন রণনীতি আর রণকৌশল বদলানোর বাধ্যবাধকতায় এবং রাষ্ট্রশক্তির পীড়নে, সংগঠনের কাজের ধারা বদলেছে, এবং শিল্পীদের মন বিক্ষিপ্ত হয়েছে, কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনটি মূল পরিচ্ছেদের নাম বেশ তাৎপর্যবাহী— ‘রাজনীতির সংগীত এবং সংগীতের রাজনীতি’, ‘রাজনীতির নাটক এবং নাটকের রাজনীতি’, আর ‘চিত্রশিল্পের রাজনৈতিক উপাদান এবং রাজনীতিতে চিত্রশিল্প’।

এক যাত্রায় পৃথক ফলের এই খতিয়ানে একটি বিবেচনা বোধহয় জরুরি ছিল। পাশ্চাত্য মিশ্রণ অথবা প্রভাব সত্ত্বেও গণসংগীত তার আঙ্গিকের আপাত-সারল্য নিয়ে যে ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছে, গণনাট্য বা প্রগতিপন্থী চিত্রকলা তা পারেনি। দুটি ক্ষেত্রেই আঙ্গিকের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ নিয়ে সমস্যা ছিল। বৈভবহীন হয়েও গণনাট্য মূলত পাশ্চাত্যের প্রসেনিয়াম মঞ্চের আদর্শ মেনে চলেছে বলে তাতে মাটির ছাপ বা গন্ধ ছিল সীমিত। প্রগতিপন্থী চিত্রকলার পুরোটাই তো পাশ্চাত্য আঙ্গিক-নির্ভর। সে বিষয়ে ধারণা সাধারণ মানুষের ছিল না। ফলে এই দুটি ক্ষেত্র যে যথেষ্ট ব্যাপ্ত অথবা কার্যকর হবে না, এটা যেন ছিল প্রায় পূর্বনির্ধারিত।

এত গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের দুটি শব্দবন্ধ নিয়ে অবশ্য ধন্দ থেকে গেল— কালচারাল কমিউনিজম, আর বেঙ্গলি (বেঙ্গল) কমিউনিজম। এগুলো কি প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানতাত্ত্বিক বর্গ? দ্বিতীয়টি মনে হয় নিছক প্রয়োজনের তাগিদে বানানো। তবে প্রথমটি নিয়ে গোল বাধতে পারে। নিজের মতো একটি ব্যাখ্যা অনুরাধা দিয়েছেন, মুখবন্ধে। কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীর অবদানকে হেয় করার জন্যেই যে আমেরিকার দক্ষিণপন্থীরা শব্দবন্ধটির ব্যবহার চালু করেছিলেন এই শতকের শুরুতে, সেই ইতিহাসও উনি জানেন আশা করি। মজার কথা, ওই দক্ষিণপন্থীরা ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীকে যে ভাবে আক্রমণ করেন, অনুরাধা কিন্তু বাঙালি কমিউনিস্টদের ঠিক সে ভাবে সমালোচনা করেননি। তা হলে কেন তিনি বইয়ের প্রচ্ছদেই ‘কালচারাল কমিউনিজম’ শব্দবন্ধটি রাখলেন?

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy