Advertisement
E-Paper

সঞ্চালক শক্তি হতে ব্যর্থ বাম আন্দোলন

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শতাব্দীর সূচনালগ্নে যে দেশাত্মবোধ ও আত্মোপলব্ধির চেতনা সঞ্চার করেছিল, তার সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ছিল রাজনীতি, সমাজ ও সাহিত্যে। জাতীয়তাবাদী চেতনা জাতীয় স্বরূপ অনুধাবনে ও জাতিসত্তার বিকাশে যে কত বিরাট ভূমিকা পালন করে, সে কথা তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত আটশো পাতার গ্রন্থে আলোচনা করেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

আবুল হাসনাত

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১
জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি ১৯০৫-৪৭। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সংহতি, ১০০০.০০

জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি ১৯০৫-৪৭। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সংহতি, ১০০০.০০

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শতাব্দীর সূচনালগ্নে যে দেশাত্মবোধ ও আত্মোপলব্ধির চেতনা সঞ্চার করেছিল, তার সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ছিল রাজনীতি, সমাজ ও সাহিত্যে। জাতীয়তাবাদী চেতনা জাতীয় স্বরূপ অনুধাবনে ও জাতিসত্তার বিকাশে যে কত বিরাট ভূমিকা পালন করে, সে কথা তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত আটশো পাতার গ্রন্থে আলোচনা করেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এই বইতে লেখক (১৯০৫-৪৭ কালপর্বে) জাতীয়তাবাদী আন্দোলন উপমহাদেশে যে কত ভাবে তাৎপর্যময় হয়েও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি অনুসন্ধান করেছেন এই চেতনার স্বরূপ, অর্জন ও ব্যর্থতার দিকগুলো। বলেছেন, জাতীয়তাবাদ জনগণের সকল ধরনের মুক্তি আনয়নে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করে না। তার কারণও বিশ্লেষণ করেছেন তিনি।

বিশেষত ১৯০৫ সালের পর থেকে বাংলার রাজনীতি ও সমাজ-ভাবনা পরিবর্তনের সম্ভাবনা সূচনা করে উন্মুখ ও স্পন্দিত হয়েছিল। এই চেতনা প্রচণ্ড শক্তি সঞ্চয় করে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে হয়ে উঠেছিল চালিকাশক্তি। পরবর্তী কালে কী কারণে তা পথভ্রষ্ট হল এবং সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বোধ প্রধান বিষয় হয়ে উঠল, তা বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। অথচ এই আন্দোলন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে এক চরিত্র অর্জন করেছিল। এই আন্দোলন কেমন করে পঙ্কিলতার আবর্তে নিমজ্জিত হল, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিশ্লেষণে তা গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। এই বিষয়টি সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন সময়ে বিশ্লেষণ করলেও অনেকের কাছে এখনও নানা প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে। এ প্রশ্ন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও উত্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে চল্লিশের দশকের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মনোভঙ্গি লেখকের বিশ্লেষণে প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দল ও জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই সময় জনগণের মঙ্গল-আকাঙ্ক্ষাকে দলিত ও উপেক্ষা করে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। কখনও জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতাকে ধারণ করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, কখনও দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বহু শ্রমে ও ত্যাগে গড়ে ওঠা জাতীয় আন্দোলন বিপথগামী হয়েছে।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশে এবং আন্দোলনকে প্রবহমান রাখার জন্য (১৯০৫-৪৭ কালপর্বে) ক্ষুদ্র-বৃহৎ যে সব রাজনৈতিক দল সক্রিয় ছিল, তাদের ভূমিকা বিশ্লেষণের পাশাপাশি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অসংখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ভূমিকার কথাও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁদের আদর্শ কর্মপ্রবাহ উল্লেখের পাশাপাশি এই মানুষদের মতাদর্শ, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং পরস্পর-বিরোধিতা দেশের রাজনৈতিক আবহে বৃহত্তর বোধ ও সুদূরপ্রসারী চেতনায় পথ প্রদর্শন করতে পারেনি, এমনকী চল্লিশের বামপন্থী আন্দোলন মানুষের কল্যাণ ও শোষণ মুক্তিতে নতুন মাত্রা সঞ্চার করা সত্ত্বেও নানা কারণে মুখ্য সঞ্চালক শক্তিতে পরিণত হতে পারেনি। অসংখ্য রাজনৈতিক দল, রাজনীতিবিদ, সমাজসংস্কারক, চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিকের ভূমিকা উল্লেখ করে তিনি তাঁদের চিন্তা ও চেতনার সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেছেন। এই বিশ্লেষণে জনগণের অবস্থান কোথায় ছিল এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের চালিকা ও নিয়ন্তা হয়েও কেন জনগণের আকাঙ্ক্ষা ষড়যন্ত্রের চোরাবালিতে হারিয়ে গেল ও বিদেশি প্রভুর কূটচালে পরাস্ত হল, লেখক সেই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টির ওপরে আলোকপাত করেছেন। উল্লিখিত সময়খণ্ডে রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আন্দোলন কেন পথভ্রষ্ট হল এবং জনগণের মুক্তি-আকাঙ্ক্ষা ও বৈপ্লবিক চেতনা গুরুত্ববহ হয়ে উঠল না, তা গভীর ভাবে এ গ্রন্থে আলোচিত। লেখক যদিও ঐতিহাসিক নন, তবু ইতিহাসের উপাদানকে ধারণ করেই তিনি বিশ্লেষণে ব্রতী হয়েছেন। এই গ্রন্থ পাঠ করলে খুব সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, এই সময়ের রাজনীতিতে জনগণের মুক্তির স্বপ্ন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি, বরং উপর্যুপরি ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি, অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক কূটতর্ক, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, শ্রেণিস্বার্থে পরিচালিত প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অনড় অবস্থান দেশ বিভাজনকে অনিবার্য করে তুলল।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, শীর্ষ প্রাবন্ধিক। তাঁর যে-কোনও রচনায় মৌলিক ভাবনার প্রকাশ আমাদের চেতনাকে শাণিত করে। তাঁর বিশ্লেষণে বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য অর্জন করলেও, মৌলিক চিন্তা ও ধারণার বিচ্ছুরণে তা সমৃদ্ধ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এই গ্রন্থে বিস্তৃত পটভূমি ও পরিসরে রাজনৈতিক বিষয়াবলি প্রাধান্য পেলেও প্রকৃত অর্থে জনগণের মুক্তির পথ প্রসঙ্গটি বড় ভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে এত আগ্রহোদ্দীপক, জিজ্ঞাসা-জাগানিয়া গ্রন্থ এর আগে আমাদের চোখে পড়েনি। আগ্রহী পাঠক (১৯০৫-৪৭ কালপর্বের) রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সামাজিক ও সাহিত্যপ্রয়াসের নানা প্রবণতা সম্পর্কে জানতে পারবেন।

ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করে জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতা ও দেশভাগ নিয়ে নবীন আলোকদীপ্ত যে-সব গবেষণা হচ্ছে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এ গ্রন্থ সেক্ষেত্রে নবীন মাত্রা যুক্ত করবে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy