Advertisement
E-Paper

সত্যি কি তত বিরোধ ছিল তাঁর জীবনে

আমাদের সকলেরই মনের মধ্যে একটা জায়গা আছে, যেখানে আমরা একান্ত নিঃসঙ্গ। এই বাক্যটি লিখে শুরু করেছেন শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘আজীবন দীর্ঘ পরবাস’ রচনাটি। সামাজিক সাংসারিক দৈনন্দিনতায় ব্যস্ত থাকতে-থাকতে অধিকাংশ সময়ই তো আমরা ভুলে থাকি আমাদের সঙ্গহীনতার চেতনাকে।

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৪ ০০:০১

আমাদের সকলেরই মনের মধ্যে একটা জায়গা আছে, যেখানে আমরা একান্ত নিঃসঙ্গ। এই বাক্যটি লিখে শুরু করেছেন শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘আজীবন দীর্ঘ পরবাস’ রচনাটি। সামাজিক সাংসারিক দৈনন্দিনতায় ব্যস্ত থাকতে-থাকতে অধিকাংশ সময়ই তো আমরা ভুলে থাকি আমাদের সঙ্গহীনতার চেতনাকে। কিন্তু নিজের মুখোমুখি বসার সময় এমন কিছু মুহূর্ত হয়তো তৈরি হয় যখন নিঃসীম একাকিত্ব ঘিরে ধরে আমাদের। ঠিক তখনই প্রশ্ন জাগে: আমার ‘আমি’টা ঠিক কী? এই প্রশ্ন থেকেই ‘স্বভাবের সত্যের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তের চলার একটা সংঘাত হতে থাকে কেবলই।’ রচনার ক্রমলিখনে মন্তব্য করেন শঙ্খ ঘোষ।

রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ উপন্যাসে কুমু-র কথা তোলেন তিনি, “শিল্পসুষমার সঙ্গে প্রাকৃতিকতার সঙ্গে মেলানো যে জীবনকল্পনা ছিল কুমুর মনে, যে-পথে এগোলে ‘স্বভাব’কে পাবে বলে মনে হয়েছিল তার, সে-পথে সে-কল্পনায় পাঁচিল তুলে দিল তার বিবাহোত্তর বাস্তব... ওই রূঢ়তা থেকে অপমান থেকে নিজেকে উত্তীর্ণ করবার জন্য কখনো কখনো তার সম্বল হয়ে ওঠে গান, গানই যেন বাঁচায় তাকে।’

এই গানের সূত্রে, রবীন্দ্রনাথের গানের সূত্রে চলে আসেন তিনি সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির লাবণ্যের ‘এ পরবাসে রবে কে হায়!’ গানটির কথায়: “আত্মসমর্পণের লাঞ্ছনায় নয়, লাবণ্যের মনে সে-গান কাজ করেছিল চকিত এক আত্ম-উদ্বোধনে।... বাইরের থেকে সরে এসে ভিতরের দিকে পৌঁছে, গানের সুরের মধ্য দিয়ে, পরবাসকে হয়তো এই নিজবাসের দিকেই এগিয়ে নিচ্ছিল লাবণ্য, যখন স্মিতহাস তার দাদার স্বর সে শুনতে পায় হঠাৎ: ‘তুই কতদিন পর গান গাইলি বল্ তো?’ কতদিন পর! কতদিন পর! কতদিন লাবণ্য ভুলে ছিল যে সে গান গায়। কতদিন সেই তার গানের অস্তিত্বের কথা জানেনি বা জানতে চায়নি তার পরিবার-প্রতিবেশ, কতদিন সে তার আপন এই প্রকাশস্বভাবকে পেষণ করে গেছে, থেকে গেছে নিজের সত্তার থেকে দূরে।”

তাঁর আর-একটি রচনা ‘শিল্প থেকে জীবন’। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর রবীন্দ্রগানের ব্যাখ্যা নিয়ে যার শুরু। ১৮৯০-এ ‘য়ুরোপযাত্রীর ডায়ারি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে তাঁর বিশ্বাস ইংরেজ মেয়েদের মতো সুন্দরী পৃথিবীতে নেই, এই বিশ্বাস থেকেই নাকি ১৮৯৫-এ কবির সেই গানটি লেখা: ‘আমি আকাশে পাতিয়া কান/ শুনেছি শুনেছি তোমারি গান’। শঙ্খ ঘোষ লিখছেন ‘গানটির ব্যাখ্যা নিয়ে অবশ্য আমাদের সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, গানটির সঙ্গে যেভাবে লেখকজীবনের কোনো ঘটনাকে যুক্ত করে দেখা অনিবার্য বোধ হলো এখানে, তার যথাযোগ্যতা কতটা।... শিল্পসৃষ্টির এমন অনেক মুহূর্ত আমরা পেতে পারি, যার উৎসে আছে অনেক জটিল ঢেউ, লোক-লোকাত্তরের নানা মিশ্র অভিজ্ঞতা, একাধিক মানসিক স্তরের বুনন। তখন, সেইরকমের কোনো রচনা থেকে রচনাকালীন প্রত্যক্ষ জীবনটাকে ছুঁতে পারা হয়তো একটু শক্তই হয়ে পড়ে।’

এই সরলার্থ তৈরির বিপদের দিকটা যদি খেয়াল না রাখি আমরা তা হলে কোনও কবির মানসিক জীবন নিয়ে ভুল ধারণা তৈরি হয়ে যেতে বাধ্য, যেমনটা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে। তাঁর সারাটা জীবনকে যতটা স্ববিরোধী কল্পনা করি আমরা, সত্যি কি তত বিরোধ ছিল তাঁর জীবনে? প্রশ্ন তুলেছেন শঙ্খ ঘোষ, ‘একদিকে আত্মিকজীবন আর অন্যদিকে এই সমাজজীবনের মধ্যে যাওয়া-আসারও একটা ভিতরের পথ কি নেই কোথাও একটা? লক্ষ করলে হয়তো দেখব, যাকে আমরা রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্ম-ভাবনা বলে ভাবি, তার আছে একটা সামাজিক ভিত; আর তাঁর সমাজভাবনার শক্তি হিসেবে আছে একটা আত্মিক প্রবণতা। আর, এরই ফলে এই দুয়ের মধ্যে, বস্তুত রবীন্দ্রনাথের সমস্ত জীবনযাপনের মধ্যেই, তৈরি হতে থাকে এক সামঞ্জস্যসূত্র, আপাতবিরোধী বিচিত্র দিক একত্রে এসে মিলতে পারে সেখানে।

কলকাতার নয়া উদ্যোগ-এর পরিবেশনায় এই প্রবন্ধাদি ফের হাতে এল ঢাকার ‘কথাপ্রকাশ’ থেকে বেরনো শঙ্খ ঘোষের নির্বাচিত প্রবন্ধ/ রবীন্দ্রনাথ-এ (৩০০.০০)। তাঁর রবীন্দ্রান্বেষণের প্রবন্ধগুলির মধ্যে এতে ঠাঁই পেয়েছে ‘মর্ত্য কাছে স্বর্গ যা চায়’, ‘এ আমির আবরণ’, ‘দামিনীর গান’, ‘কবির অভিপ্রায়’ ‘বিজয়ার অলিন্দে’, ‘তিন চণ্ডালী’, ‘নাট্যমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘কালের মাত্রা’, ‘সময়ের দেশ’, ‘ঋতুমণ্ডল ও রক্তকরবী’, বা এ রকমই আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনা। সংগ্রহটি ‘আমার রবীন্দ্রনাথ-সংক্রান্ত লেখাগুলি থেকে নেওয়া। নির্বাচন অবশ্য আমারই...’, সূচনাকথা-য় জানিয়েছেন লেখক।

একই প্রকাশনা থেকে একই সঙ্গে বেরিয়েছে তাঁর নির্বাচিত প্রবন্ধ/ নানাপ্রসঙ্গ-ও (৩০০.০০)। ‘দ্বিতীয়টিতে রইল নানা বিষয়ের ভাবনা। কবিতা নিয়ে নাটক নিয়ে দেশবিদেশের লেখকদের নিয়ে যেসব লেখা তৈরি হয়ে উঠেছিল ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, তারই থেকে কয়েকটি। সমাজ-রাজনীতি নিয়েও দু-এক টুকরো রইল সেইসঙ্গে।’ সূচনাকথা-য় মন্তব্য শঙ্খ ঘোষের। সংগ্রহটিতে বিয়াল্লিশ বছর আগে সত্তর দশকে লেখা ‘শব্দ আর সত্য’ রচনাটি নতুন শতকে যেন আরও অমোঘ, আরও প্রাসঙ্গিক: ‘আমাদের প্রধান পাঠকজনতা বস্তুত এক মধ্যবিত্ত জনসংঘ, স্বরচিত কিছু সংস্কার এবং মুখোশমালায় নিজেকে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করছে যে মধ্যবিত্ত জনতা। সে কেন সহ্য করবে তার মুখোশ ছিঁড়বার আয়োজন? সে কেন সহ্য করবে তার তৈরি-করা নিজস্ব মূল্যবোধের বিপর্যয়? তাই সত্যসন্ধানী লেখা তার কাছে ঘৃণা বা উপেক্ষার যোগ্য মনে হয়, নিজেকে দেখে ফেলবার ভয়ে সে ছুটে পালায়, সত্যের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয় তার বানিয়ে-তোলা চটককে।’

book review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy