Advertisement
E-Paper

জীবিত ও মৃত

বহু দেশের মানুষ মনে করেন, বছরের এই সময়টাতেই ‘জীবিত ও মৃতের ভুবনের সীমারেখাটা ক্ষীণতম হয়ে ওঠে, বিদেহী আত্মারা এই সময় তাঁদের জীবিত স্বজনদের কাছে ফিরে আসেন।’ আমরাও ব্যতিক্রম নই।কা ল ২ নভেম্বর। মৃতেরা এই দিন দুনিয়া জুড়ে এক আশ্চর্য ঐক্য রচনা করে। খ্রিস্টানদের তো এটি ‘অল সোল্‌’স’ ডে’। এ দিন তাঁরা প্রয়াত স্বজনদের স্মরণ করেন, তাঁদের সমাধিতে ফুল রাখেন, দীপ জ্বালান, সমাধিক্ষেত্রগুলি আলোকয় আলোকময় হয়ে ওঠে।

জহর সরকার

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
অতীত? তো? ‘মৃতের দিন’, মেক্সিকো।

অতীত? তো? ‘মৃতের দিন’, মেক্সিকো।

কা ল ২ নভেম্বর। মৃতেরা এই দিন দুনিয়া জুড়ে এক আশ্চর্য ঐক্য রচনা করে। খ্রিস্টানদের তো এটি ‘অল সোল্‌’স’ ডে’। এ দিন তাঁরা প্রয়াত স্বজনদের স্মরণ করেন, তাঁদের সমাধিতে ফুল রাখেন, দীপ জ্বালান, সমাধিক্ষেত্রগুলি আলোকয় আলোকময় হয়ে ওঠে। আমরা খেয়াল করি না, পৃথিবীর বহু অঞ্চলের মানুষ মনে করেন, অক্টোবর-নভেম্বরের এই সময়টাতেই ‘জীবিত ও মৃতের ভুবনের মধ্যে সীমারেখাটা ক্ষীণতম হয়ে ওঠে, কারণ বিদেহী আত্মারা এই সময় তাঁদের জীবিত স্বজনদের কাছে ফিরে আসেন।’

বিশ্ব জুড়ে একটা ধারণা আছে যে, বছরের শেষ ফসল ওঠার পরে রিক্ত মাটির নীচে শয়ান আত্মাদের কাছে পৌঁছনোর পথ উন্মুক্ত হয়, তাই এই সময়েই ‘মৃতের দিন’ পালন করার প্রথা অতি প্রাচীন। দু’হাজার বছরের বেশি আগে রোমানরা ‘লেমুরিয়া’ উত্‌সব পালন করত, দুষ্ট আত্মাদের সন্তুষ্ট করতে বলি দেওয়া হত। তারা সমাধিস্থানে গিয়ে মৃতদের সঙ্গে কেক ও মদ ভাগ করে নিত। খ্রিস্টধর্ম পরে এই প্রাচীন ‘পেগান’ রীতিকে আত্মস্থ করে, জন্ম নেয় অল সোল্‌’স ডে।

পিতৃপক্ষ ও মহালয়ায় আমাদের পিতৃলোক তথা প্রেতলোকের সঙ্গে সংযোগ শুরু হয়, তার পর দেওয়ালির আলো দিয়ে দুষ্ট আত্মাদের বিতাড়ন চলে। ভূতচতুর্দশীর রাত্রে বাঙালি বাড়ির কোণে কোণে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রায় মশা তাড়ানোর মতো ভূত তাড়ায়। আর, কালীপুজোর সঙ্গে তো ভূতপ্রেত ও শ্মশানের আত্মিক সম্পর্ক। ভাইফোঁটায় যমের দুয়ারে কাঁটা পড়ে। আবার কার্তিক মাসে বাড়ির ছাদে লম্বা লাঠি বেঁধে আকাশপ্রদীপ জ্বালাই আমরা, প্রেতাত্মারা যাতে সেই আলোয় পথ চিনে যমলোকে ফিরতে পারেন। আকাশপ্রদীপের চল কমছে। কিছু প্রেতাত্মা হয়তো আকাশছোঁয়া ইমারতের জঙ্গলে ধাক্কা খেয়েছেন। কিংবা তাঁরা হয়তো এখন জিপিএস ব্যবহার করেন, বাড়ির পথ খুঁজে নিতে আকাশপ্রদীপের আর দরকার হয় না। উত্তরপ্রদেশের অনেক জায়গায় কার্তিক পূর্ণিমায় দেবদীপাবলি উত্‌সব হয়, বারাণসীতে আবার নভেম্বরের মাঝামাঝি গঙ্গার ঘাটগুলিতে হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা আছে।

স্বদেশি ভূতদের ছেড়ে মেক্সিকোয় চলুন। সেখানে ২ নভেম্বর ‘এল দিয়া দে লোস মুয়ের্তোস’, অর্থাত্‌ মৃতদের দিন। এটি শত শত বছরের পুরনো আজটেক সভ্যতার উত্‌সব। সমস্ত বিষাদ দূরে রাখতে ওঁরা এ দিন প্রচুর নাচগান করেন, কঙ্কাল এবং ভূতপ্রেত সেজে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় যোগ দেন। ভূতেরা তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে উত্‌সব করার পরে যাতে ক্রুদ্ধ বা ক্ষুধার্ত না হয়, সে জন্য বাড়ির সামনে খাবার, মিষ্টি, টেকিলা ইত্যাদি রেখে দেন, অনেকে বালিশ এবং কম্বলও রাখেন, যাতে ভূতেরা বিশ্রাম নিতে পারে।

পর্তুগাল, স্পেন, লাতিন আমেরিকার মানুষ মৃতদের উদ্দেশে ‘ওফ্রেন্দা’ বা অর্ঘ্য নিবেদন করেন। সমাধিতে ফুল রাখেন। দক্ষিণ আমেরিকার আন্ডিজ অঞ্চলের আদিবাসী মানুষ মৃত পূর্বপুরুষদের মাথার খুলি সংরক্ষণ করেন, বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে যা কাজে লাগে। ৯ নভেম্বর করোটিগুলিকে জামাকাপড় পরিয়ে দাঁতের ফাঁকে সিগারেট গুঁজে দেওয়া হয়, মদও দেওয়া হয়। ওঁরা মৃত পূর্বপুরুষদের দেহের হাড়ও রেখে দেন। ওঁদের বিশ্বাস, সেগুলি অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করে। ব্রাজিলে ২ নভেম্বর ‘মৃতের দিন’ উপলক্ষে জাতীয় ছুটি, ওঁরা বলেন ‘ফিনাদোস’। সে দেশের উৎসবে বিজিত আদিবাসীদের রীতির সঙ্গে মিশে গিয়েছে ক্রীতদাস হিসেবে আসা আফ্রিকার মানুষের নানা প্রথা। ইকোয়েডরের মানুষ এই সময় মিষ্টি পেয়ারার পুর দিয়ে তৈরি এক বিশেষ ধরনের রুটি পূর্বপুরুষদের নিবেদন করেন। গুয়াতেমালায় ঢাউস সব ঘুড়ি ওড়ানো হয়, সেগুলি মৃতদের কাছে পৌঁছবে।

পৃথিবীর অন্য প্রান্তে, ফিলিপিনসে ক্যাথলিকরা পূর্বপুরুষের সমাধিতে যান, অনেকে সেখানে রাত্রি যাপন করেন, তাস খেলেন, পানাহার করেন, এমনকী নাচগানও করেন। এর মাসখানেক আগে কাম্বোডিয়ায় মানুষ শ্বেতবস্ত্র পরিধান করে প্যাগোডায় জমায়েত হয়ে পক্ষকাল ধরে পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানান, উৎসব করেন। খ্‌মের ধর্মীয় ক্যালেন্ডারে এটি অন্যতম প্রধান উৎসব।

ইউরোপের সেলটিক সভ্যতার উত্তরাধিকারীরা আজও প্রাক্-খ্রিস্টীয় যুগের কিছু কিছু প্রথা ও উৎসব পালন করে চলেছেন, যেমন স্যামউইন। এটি হয় ১ অক্টোবর, আমাদের পিতৃপক্ষের সময় কিংবা তার কাছাকাছি। ওঁদের বিশ্বাস, পিতৃপুরুষ এই সময় ওঁদের কাছে ফিরে আসেন, খাবারদাবার ও অন্য সামগ্রী সংগ্রহ করে নিয়ে যান। স্কট ও আইরিশদের পুরনো বিশ্বাস: আত্মা বা অশুভ উপদেবতারা যাতে সন্তুষ্ট থাকেন ও শীতকালে মানুষ এবং তাদের প্রাণী-সম্পদকে রক্ষা করেন, সে জন্য এই সময় তাঁদের আরাধনা করা দরকার। ফসল ওঠার পরে, শীত পড়ার আগে তাঁরা বছরের শেষ ভোজের আয়োজন করতেন, সেখানে পূর্বপুরুষদের আহ্বান জানাতেন, একটি আলাদা টেবিলে তাঁদের জন্য খাদ্য ও পানীয় রাখা হত। অনেকে আবার ছদ্মবেশে বা জাঁকজমকের পোশাকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নানা গাথা বা পদ্য শুনিয়ে খাবার চাইতেন। এই থেকেই এল ‘হ্যালোউইন’-এর সময় মার্কিন শিশুদের ‘ট্রিক অর ট্রিট’। তারা বিচিত্র সাজপোশাকে বাড়ি বাড়ি যায়, তাদের নানা উপহার দিয়ে খুশি করতে হয়।

অন্যান্য সংস্কৃতির মানুষদের মধ্যেও একই রকম প্রথা চালু আছে। কারও কারও উদ্‌যাপনের সময়টা একটু আগে, যা ফসল ওঠার সময়ের ওপর নির্ভর করে। চিন ও সিঙ্গাপুরের বৌদ্ধ ও তাওবাদীরা পূর্বপুরুষকে সম্মান জানাতে অগস্ট মাসকে পালন করেন ‘ক্ষুধার্ত ভূতেদের মাস’ হিসেবে, তার শেষে বিরাট উৎসব হয়। লক্ষ লক্ষ বাতি জ্বালিয়ে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। জাপানের সুন্দর প্রদীপ জ্বালানোর উৎসব ‘ওবোন’-এ পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে নানা খাবার উৎসর্গ করা হয়। কোরিয়ায় সেপ্টেম্বরের ‘চুসেওক’ প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এক উৎসব। এই দিন কোরিয়ার মানুষ তাঁদের পূর্বপুরুষদের পুজো করেন, সমাধিক্ষেত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তোলেন। আরব দুনিয়ার মানুষজন শব-এ-বারাত-এর রাতে পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন।

পৃথিবী জুড়ে মৃতদের ব্যাপারে বেশ মিল পাওয়া যাচ্ছে। তা হলে আমরা মর্তের মানুষরা বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মেলবন্ধনের জন্য একটু চেষ্টা করতে পারি না? সত্যিকারের একটা আন্তর্জাতিক বহু-সাংস্কৃতিক উৎসব সৃষ্টি করতে পারি না? শান্তির উৎসব?

প্রসার ভারতী-র সিইও। মতামত ব্যক্তিগত

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy