Advertisement
৩০ নভেম্বর ২০২৩
প্রবন্ধ

তিনি ক্লাসে এলেন, আমার জগৎটা পালটে গেল

‘এর আগে আমাকে কেউ এ ভাবে ভালবাসেনি। কেউ আমার মতো একটা খারাপ ছেলের কাহিনিকে রূপকথায় পরিণত করেনি।’ এক শিক্ষকের প্রতি তাঁর ছাত্রের সম্ভাষণ। জহর সরকারসেটা ১৯৬৭ সাল। আমি দশম শ্রেণিতে উঠেছি। হিউম্যানিটিজ নিয়ে পড়ব। ক্লাস সিক্স থেকে নাইন অবধি আমার রেজাল্ট তো সাংঘাতিক— হয় লাস্ট, না-হয় বড় জোর লাস্টের ঠিক আগে। তবে আমার নক্ষত্রখচিত মুহূর্তটি ছিল, যে বছর আমি ক্লাস এইট পাশ করতে পারলাম না। পরের বছর, এবং তার পরের বছরেও, কোনও মতে কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেলাম। ক্লাস নাইনে আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছিলাম, যে পড়া পড়তে গেলে সারা ক্ষণ যুদ্ধ করে যেতে হয়।

শিল্পী: সুমিত্র বসাক।

শিল্পী: সুমিত্র বসাক।

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

সেটা ১৯৬৭ সাল। আমি দশম শ্রেণিতে উঠেছি। হিউম্যানিটিজ নিয়ে পড়ব। ক্লাস সিক্স থেকে নাইন অবধি আমার রেজাল্ট তো সাংঘাতিক— হয় লাস্ট, না-হয় বড় জোর লাস্টের ঠিক আগে। তবে আমার নক্ষত্রখচিত মুহূর্তটি ছিল, যে বছর আমি ক্লাস এইট পাশ করতে পারলাম না। পরের বছর, এবং তার পরের বছরেও, কোনও মতে কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেলাম। ক্লাস নাইনে আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছিলাম, যে পড়া পড়তে গেলে সারা ক্ষণ যুদ্ধ করে যেতে হয়। আর, শুধু রেজাল্টই তো নয়, আমার টুপিতে অন্য অনেকগুলো পালকও গোঁজা হয়েছিল— আমার নানান দুষ্টুমি আর বেয়াড়াপনার কারণে বিস্তর বকুনি শুনে এসেছিলাম আমি। অর্থাৎ, একটি মার্কামারা বাজে ছেলে হিসেবে চিহ্নিত হয়ে দুরুদুরু বক্ষে আমি নতুন ক্লাসে ঢুকলাম।

সব কিছুই নতুন ঠেকল। ক্লাস রুম, ছেলেরা, পড়ার বিষয়— ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অঙ্ক নেই, তার বদলে রয়েছে ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্যের মতো বোকা-বোকা সব বিষয়। তবে সব চেয়ে আশ্চর্যের লাগল আমাদের ক্লাস টিচার ফাদার পি ওয়াই গিলসন-কে। এই অদ্ভুত পাদরিকে এত দিন স্কুল করিডরে দেখতাম। চিবুক প্রায় নেই বললেই চলে, বিচিত্র ফরাসি-ঘেঁষা উচ্চারণ— অবাক হয়ে ভাবতাম, বেলজিয়ামের এই শান্তশিষ্ট মিশনারি কী করে এই অসম্ভব গরম আর চরম বেয়াড়া ছাত্রদের উৎপাত সহ্য করতেন। খুব গর্ব হয়েছিল এই ভেবে যে, আদর্শ বেয়াড়া ছাত্র হিসেবে আমার নামটা ফাদার নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন।

শুনে থাকলেও, মোটেই পাত্তা দিয়েছেন বলে মনে হল না। আমার দিক থেকে নিজমূর্তি ধারণের ব্যাপারে কোনও ত্রুটি হয়নি, প্রথম দিনেই এক বিশালদেহী পারসি ছেলের সঙ্গে এমন মারামারি করেছিলাম যে আমার জামা ছিঁড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা দেখেও তিনি মোটেই বিচলিত হলেন না, উল্টে আমাকে অবাক করে দিয়ে ফার্স্ট বেঞ্চে এসে বসতে বললেন। এবং সরাসরি পড়াতে শুরু করে দিলেন। যেহেতু ক্লাস নাইনে এই বিষয়গুলি পড়িনি, তাই প্রায় কিছুই ধরতে পারছিলাম না, কিন্তু তিনি সেটা খেয়াল করলেন বলে মনে হল না। আর দেখতে দেখতে আমি নিজের অজান্তেই গল্পগুলোর মধ্যে ডুবে গেলাম। কে-ই বা ফাদারের অদ্ভুত উচ্চারণ আর আশ্চর্য কণ্ঠস্বর দিয়ে বোনা একটা ভাল গল্পের আকর্ষণ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে? তাঁর গল্পগুলো এমন জীবন্ত ছিল যে আমি বাক্রহিত হয়ে শুনতে থাকলাম আর কেমন করে যেন একটা ম্যাজিক কার্পেটে উঠে পড়লাম, যেটা আমাকে নিয়ে গেল রূপকথার দেশে। তাঁর ছোট ছোট তীক্ষ্ণ মন্তব্যের মধ্যে একটা ফরাসি রসবোধ লুকিয়ে ছিল। সেই বোধ হয় জীবনে প্রথম বার আমার ক্লাসে একঘেয়ে লাগল না। যখন ক্লাস শেষ হল, আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম যে, সত্যি সত্যিই সাহিত্য আমার এতটা ভাল লেগেছে।

এর পর আরও অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটবে, কারণ এই জাদুকরের টুপি থেকে আরও অনেক গল্প বেরিয়ে আসবে। সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আমি ওঁর ক্লাস করার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। ফাদার গিলসন সবচেয়ে বড় যে বদলটি আমার মধ্যে ঘটিয়েছিলেন, তা হল, তিনি কেবল সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগ তৈরি করলেন না, পড়াশোনাকে ভালবাসতে শেখালেন। এবং সেই শুরু। আমার পড়াশোনায় যাতে উন্নতি হয়, ক্লাস টিচার হিসেবে সেটা দেখা তাঁর দায়িত্ব ছিল। কখনও দুটো ক্লাসের মাঝে, কখনও বা ক্লাসের শেষে তিনি বাড়তি সময় নিয়ে আমায় পড়াতেন। যেহেতু ক্লাস নাইনে আমার এই সাবজেক্টগুলো ছিল না, তাই তিনি আমাকে সেই পড়াগুলো পড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। আমার প্রতি তাঁর এই বিশেষ যত্ন কেবল যে পড়াশোনাকে ভালবাসতে শিখিয়েছিল তা-ই নয়, পৃথিবীটাকেই একটা অন্য চোখে দেখতে শিখিয়েছিল। আমার কাছে এত দিন পড়াশোনার জগৎটা ছিল একটা বিপদসংকুল অরণ্যের মতো, যেখানে কেবল বইপোকারা মাথা গুঁজে পড়ে আর যারা ক্লাসে ফার্স্ট হয় তারা তো পুরুষজাতির কলঙ্ক! সেই জগৎটাই পালটে গেল।

কিন্তু অচিরেই আমার দিবাস্বপ্ন ভেঙে গেল, যখন কঠোর বাস্তব পরীক্ষার রূপ ধারণ করে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। এমনিতেই পরীক্ষা ছিল আমার কাছে এক ভয়ঙ্কর ‘ইনকুইজিশন’, তার ওপর আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে আমি ফের ক্লাসে লাস্ট হব, আর সেই জন্যে আমার আরও ভয় করতে লাগল। যদিও নতুন ক্লাসে পড়াশোনার সঙ্গে আমার অল্প দিনের একটা ভালবাসা হয়েছিল, কিন্তু সেটা কোনও মতেই আমার পেট-মোচড়ানো ভয়কে দমিয়ে রাখতে পারল না। প্রথম পরীক্ষা ছিল ‘ইংলিশ এসে’-র। এবং আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি বুজে যাওয়া গলায় কেমন করে ফাদার গিলসনকে বলেছিলাম, আমি কখনও ভাল ফল করতে পারিনি, আর আমার ঠিক সময়ে ঠিক শব্দটা কিছুতেই মনে পড়ে না। তিনি আমাকে অনেক ভরসা দিলেন, কিন্তু সে-সব ভরসার কথা আমাকে পরীক্ষার হলে ঘেমে নেয়ে ওঠা থেকে বাঁচাতে পারল না, আমি ঠিক শব্দ আর ঠিক ভাব প্রকাশের খোঁজে যথারীতি হাতড়ে মরলাম।

রেজাল্ট বেরোল, আমি অবাক। ক্লাসে ফোর্থ হয়েছি! মা-বাবা খুব খুশি, বন্ধুরা খুব খেপাল। কেউ আন্দাজও করতে পারেনি, এই রেজাল্ট আমার আত্মবিশ্বাস কতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। এর পরের অবাক-করা রেজাল্টটা হল যখন অঙ্কে আমি প্রথম হলাম। বিজ্ঞান থেকে কলা বিভাগে পড়তে এসেছিলাম বলে হয়তো অঙ্কে ভাল নম্বর পাওয়াটা তত কঠিন ছিল না। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, আসলে আমি তখন স্বপ্ন দেখতে শিখে গিয়েছি। ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়গুলোতেও ভাল নম্বর পেতে শুরু করলাম। সবচেয়ে বড় কথা, ফার্স্ট হওয়াটা দারুণ লাগতে শুরু করেছে। একটা সাফল্যের পায়ে পায়ে আর একটা সাফল্য, চলতেই থাকল। খুব খেটেছিলামও, ফাদারের— আমার প্রিয় ফাদারের— তত্ত্বাবধানে।

কিছু দিন পরেই শুনলাম, ফাদার অন্য স্কুলে চলে যাচ্ছেন। সত্যিই চলে গেলেনও। আমি সবার সামনেই কেঁদে ফেললাম। এর আগে আমাকে কেউ এ ভাবে ভালবাসেনি। কেউ আমার মতো একটা খারাপ ছেলের কাহিনিকে রূপকথায় পরিণত করেনি। কোনও সন্দেহ নেই, আজ আমি যেখানে পৌঁছেছি, সে কেবল তাঁরই জন্য।

বছর দশেক পর, আমি তখন দুর্গাপুর-আসানসোল এলাকার অতিরিক্তি জেলাশাসক। এক বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম, ফাদার গিলসন দুর্গাপুর সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য একটা সময় চেয়ে নিলাম। ফাদারের সঙ্গে দেখা হবে, ভেবেই আমার একটা আশ্চর্য অনুভূতি হচ্ছিল। তাঁকে যা যা বলতে চাই, কী করে বলব আমি? এই শিক্ষক আমার জীবনটা আমূল বদলে দিয়েছিলেন। এত দিন প্রশাসক হিসেবে যখন যেখানে কাজ করেছি, প্রতিটি শিক্ষক দিবসের বক্তৃতায় তাঁকে স্মরণ করেছি। নানা স্কুল বা কলেজ কমিটিতে পদাধিকারের কল্যাণে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভাষণ দিতে গিয়ে তাঁর কথা বলেছি। তিনি আমায় চিনতে পারবেন তো? আমার আর তর সইছিল না।

অবশেষে দেখা করার দিনটা এল। লালবাতি লাগানো অফিসের গাড়ি আর সরকারি বড় চাকরির নাছোড় নানা আড়ম্বর সহ স্কুলের চত্বরে ঢুকলাম যখন, আশ্চর্য এক নস্টালজিয়া আমায় জড়িয়ে ধরল। ফাদারের ঘরে ঢোকামাত্র একটা পরিচিত সুগন্ধ স্বাগত জানাল। তিনি তখন ঘরে ছিলেন না, এক জন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে একটি ক্লাস নিচ্ছিলেন। একটু পরেই তিনি এলেন। খুব উষ্ণতায় হাত মেলালেন। বললেন, ‘আমি তোমার জন্য সত্যিই গর্বিত।’ তিনি একেবারে একই রকম আছেন, কেবল একটু বয়স হয়েছে। কিন্তু আমি তখন বদলে গিয়েছি, আত্মবিশ্বাসী সরকারি আমলা থেকে হয়ে গিয়েছি নার্ভাস, ভয় পাওয়া একটা ছাত্র যে কিনা ঠিক শব্দটা হাতড়ে বেড়ায়।

আমি ঠিক করে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উঠতে পারার আগেই বেল পড়ল। ফাদার তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, ‘ওহ্ মাই গড, আর একটা ক্লাস নিতে হবে আমায়। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেরা অপেক্ষা করছে। ছটফটে, দুষ্টু, ঠিক তোমার মতো। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। ভাল থেকো। কিন্তু এখন আমায় ক্লাসে যেতে হবে।’

সেই মহাপ্রাণ জেসুইটকে আমি আর কোনও দিন দেখতে পাব না। আমার কৃতজ্ঞতা আর প্রশস্তি শোনার সময় তাঁর হাতে ছিল না। তাঁকে তখন অন্য সব বেয়াড়া শিশুদের সামলাতে হবে, বদলাতে হবে, মানুষ করতে হবে।

প্রসার ভারতী-র কর্ণধার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement

Share this article

CLOSE