সেটা ১৯৬৭ সাল। আমি দশম শ্রেণিতে উঠেছি। হিউম্যানিটিজ নিয়ে পড়ব। ক্লাস সিক্স থেকে নাইন অবধি আমার রেজাল্ট তো সাংঘাতিক— হয় লাস্ট, না-হয় বড় জোর লাস্টের ঠিক আগে। তবে আমার নক্ষত্রখচিত মুহূর্তটি ছিল, যে বছর আমি ক্লাস এইট পাশ করতে পারলাম না। পরের বছর, এবং তার পরের বছরেও, কোনও মতে কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেলাম। ক্লাস নাইনে আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছিলাম, যে পড়া পড়তে গেলে সারা ক্ষণ যুদ্ধ করে যেতে হয়। আর, শুধু রেজাল্টই তো নয়, আমার টুপিতে অন্য অনেকগুলো পালকও গোঁজা হয়েছিল— আমার নানান দুষ্টুমি আর বেয়াড়াপনার কারণে বিস্তর বকুনি শুনে এসেছিলাম আমি। অর্থাৎ, একটি মার্কামারা বাজে ছেলে হিসেবে চিহ্নিত হয়ে দুরুদুরু বক্ষে আমি নতুন ক্লাসে ঢুকলাম।
সব কিছুই নতুন ঠেকল। ক্লাস রুম, ছেলেরা, পড়ার বিষয়— ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অঙ্ক নেই, তার বদলে রয়েছে ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্যের মতো বোকা-বোকা সব বিষয়। তবে সব চেয়ে আশ্চর্যের লাগল আমাদের ক্লাস টিচার ফাদার পি ওয়াই গিলসন-কে। এই অদ্ভুত পাদরিকে এত দিন স্কুল করিডরে দেখতাম। চিবুক প্রায় নেই বললেই চলে, বিচিত্র ফরাসি-ঘেঁষা উচ্চারণ— অবাক হয়ে ভাবতাম, বেলজিয়ামের এই শান্তশিষ্ট মিশনারি কী করে এই অসম্ভব গরম আর চরম বেয়াড়া ছাত্রদের উৎপাত সহ্য করতেন। খুব গর্ব হয়েছিল এই ভেবে যে, আদর্শ বেয়াড়া ছাত্র হিসেবে আমার নামটা ফাদার নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন।
শুনে থাকলেও, মোটেই পাত্তা দিয়েছেন বলে মনে হল না। আমার দিক থেকে নিজমূর্তি ধারণের ব্যাপারে কোনও ত্রুটি হয়নি, প্রথম দিনেই এক বিশালদেহী পারসি ছেলের সঙ্গে এমন মারামারি করেছিলাম যে আমার জামা ছিঁড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা দেখেও তিনি মোটেই বিচলিত হলেন না, উল্টে আমাকে অবাক করে দিয়ে ফার্স্ট বেঞ্চে এসে বসতে বললেন। এবং সরাসরি পড়াতে শুরু করে দিলেন। যেহেতু ক্লাস নাইনে এই বিষয়গুলি পড়িনি, তাই প্রায় কিছুই ধরতে পারছিলাম না, কিন্তু তিনি সেটা খেয়াল করলেন বলে মনে হল না। আর দেখতে দেখতে আমি নিজের অজান্তেই গল্পগুলোর মধ্যে ডুবে গেলাম। কে-ই বা ফাদারের অদ্ভুত উচ্চারণ আর আশ্চর্য কণ্ঠস্বর দিয়ে বোনা একটা ভাল গল্পের আকর্ষণ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে? তাঁর গল্পগুলো এমন জীবন্ত ছিল যে আমি বাক্রহিত হয়ে শুনতে থাকলাম আর কেমন করে যেন একটা ম্যাজিক কার্পেটে উঠে পড়লাম, যেটা আমাকে নিয়ে গেল রূপকথার দেশে। তাঁর ছোট ছোট তীক্ষ্ণ মন্তব্যের মধ্যে একটা ফরাসি রসবোধ লুকিয়ে ছিল। সেই বোধ হয় জীবনে প্রথম বার আমার ক্লাসে একঘেয়ে লাগল না। যখন ক্লাস শেষ হল, আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম যে, সত্যি সত্যিই সাহিত্য আমার এতটা ভাল লেগেছে।