Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
গুজরাতে নির্ণায়ক হতে পারে গোটা চল্লিশ আসন

ক্ষোভ বনাম সংগঠন

সাবধানী মাথা তাই ভাবছিল, বিজেপির পক্ষে ১০৫-১১০টি আসন। সে ক্ষেত্রেও শাসক দল ও তার সর্বাধিনায়ক এবং তাঁর প্রধান সেনাপতির দারুণ চাপ!

শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:১১
Share: Save:

হয় ছক্কা, নয় ফক্কা! ‘হয় ৭৫-৮০, নয় ১৩৫-১৪০’, বলছিলেন আশিসরঞ্জন। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ এই তরুণ পাঁচ বছর ধরে দেশের রাজ্য পর্যায়ের প্রতিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রসমীক্ষা চালিয়েছেন, কয়েক মাস সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিতে পড়ে থেকে। এ বারও ভোটের আগে গুজরাতে আশিস। এ বার ওই রাজ্যের বহুচর্চিত নির্বাচনে বিজেপি কেমন করবে, এই প্রশ্নে আশিসের ওই উত্তর।

কিন্তু খুঁতখুঁতে মন এমন চরম বৈপরীত্যময় হিসেব মানতে চায় না। গত বারের ১২১ আসন থেকে এ বার বিজেপির ১০-১৫টি আসন কমে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনাই প্রবল মনে হচ্ছিল। সাবধানী মাথা তাই ভাবছিল, বিজেপির পক্ষে ১০৫-১১০টি আসন। সে ক্ষেত্রেও শাসক দল ও তার সর্বাধিনায়ক এবং তাঁর প্রধান সেনাপতির দারুণ চাপ! তবে কেন এমন চমকদার পূর্বানুমান? জানতে কথা বলেছিলাম, এম এস বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন শিক্ষক দিলীপ মোহিতে এবং ওই বিভাগেরই শিক্ষক ও গুজরাত রাজ্য রাজনীতির বিশ্লেষক, অমিত ঢোলাকিয়ার সঙ্গে। এই সব কথাবার্তা চালিয়ে ও মাসখানেকের রাজ্য রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লষণ করে মনে হল, সত্যিই গুজরাত ভোটের সম্ভাব্য পরিণাম আগাম আন্দাজ করার কাজটা অতি আত্মবিশ্বাসী ভোটবিজ্ঞানীর পক্ষেও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ, চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়, কংগ্রেসের সঙ্গে পাতিদার (পটেল) ও ক্ষত্রিয়–অনগ্রসর শ্রেণির তিন তরুণ তুরকি— হার্দিক পটেল, অল্পেশ ঠাকোর ও জিগ্নেশ মেবাণী হাত মেলানোয় এবং পাশাপাশি কৃষক ও ছোট থেকে মাঝারি ব্যবসায়ীদের মনে নানা ক্ষোভ জমে থাকায়, গুজরাত ভোট আর বিজেপির পক্ষে একপেশে হবে না; কিন্তু এটা জোর দিয়ে বলা যায় না যে, জাতপাত ও ক্ষোভের রসায়ন কাজে লাগিয়ে ঠিক ক’টি আসন বিরোধী পক্ষে যাবে। এর পিছনে দৃশ্যত কতিপয় উপাদান কাজ করছে।

উত্তর গুজরাত, পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র এবং মধ্য ও দক্ষিণ গুজরাত— মোটামুটি এই চারটি অঞ্চলে বিভক্ত রাজ্যে আর্থসামজিক অবস্থার যেমন তারতম্য আছে, রাজনীতিরও কিছু ভিন্নতা আছে। এর মধ্যে উত্তর গুজরাতে পাতিদারদের প্রাধান্য। এঁরা মূলত সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণি, বিজেপির সাবেক ভোট ব্যাংক। কিন্তু গত দশ-পনেরো বছর সামাজিক জনকল্যাণ ক্ষেত্রগুলি থেকে রাজ্য সরকার ক্রমশ হাত গুটিয়ে নেওয়ায় এঁরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রোজগার প্রভৃতি বিষয়ে খানিকটা পিছিয়ে পড়ছেন, অতএব, একদা সংরক্ষণের প্রবল বিরোধী এই পাতিদাররা এখন হার্দিক পটেলের নেতৃত্বে নিজেদের জন্যই সংরক্ষণ চাইছেন। এঁদের ভোটার প্রায় ১৫ শতাংশ। অন্য দিকে সারা রাজ্যেই রয়েছে ক্ষত্রিয়–অনগ্রসর শ্রেণির ২৪ শতাংশ প্রবল ভোট। ঠাকোর ও মেবাণী এই গোষ্ঠীর নেতা। লক্ষণীয়, অন্য রাজ্যগুলিতে না হলেও, গুজরাতে ক্ষত্রিয় তথা ঠাকুরদের একটা বড় অংশই অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত। আর্থ-রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় এখন বিজেপি-বিরোধী ছাতার তলায় থাকলেও, পাতিদার ও ক্ষত্রিয়–অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে কিন্তু স্বার্থের বিরোধ আছে।

সৌরাষ্ট্রসহ পশ্চিম গুজরাতে অবশ্য কৃষক ও ছোট ব্যবসায়ীদের তীব্র ক্ষোভ আছে। চাষিদের ক্ষোভের কারণ, প্রথমত, কৃষি ঘাটতির সরকারি সহায়ক মূল্য না-পাওয়া; দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনীয় কৃষি ঋণ না-পাওয়া। ক্ষোভের কথা টের পেয়ে রাজ্য সরকার শেষ বেলায় সহায়ক মূল্যের হার বাড়ালেও, তাতে চিঁড়ে খুব একটা ভিজবে না। অন্য দিকে, ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ মূলত নবাগত জিএসটি কর ও গত বছরের নোটবন্দি নিয়ে। সুরাত অঞ্চলের প্রচুর ছোট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি— যার মধ্যে হীরা ব্যবসায়ীরাও আছেন— এর শিকার। অনেকের ব্যবসা বন্ধও হয়েছে। উত্তর গুজরাত ও সৌরাষ্ট্রে সব মিলিয়ে ১০৭টি আসন। এখানেই বিজেপি-বিরোধিতার উত্তাপ বাড়ছে।

মধ্য ও বিশেষত দক্ষিণ গুজরাতে কিন্তু বিজেপির সমর্থনভিত্তি মোটের ওপর অক্ষুণ্ণ। তাদের আর একটি আশ্বাসস্থল হল শহরাঞ্চল, ২০০২-এর পরে যে শহরগুলির নাগরিক সমাজ সংঘ পরিবারের নানা সংগঠনের দৈনন্দিন কার্যক্রম ও সম্পর্কের আওতায় রয়েছে। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ দলীয় সংগঠন ও প্রশাসনের যে মসৃণ বোঝাপড়ায় বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছিল, গত প্রায় দু’দশকে গুজরাতে তা অনেকটাই ঘটেছে। কেবল বিকাশের গল্প নয়, তার সঙ্গে বিদ্বেষের মতাদর্শও মিলেমিশে এমন এক ককটেল তৈরি করেছে যে, শহুরে শ্রেণির বড় অংশ এখনও তাতে মজে আছে। গত কয়েক বছরে হুহু করে বেড়ে চলা নগরায়ণ রাজ্যের ৪৫ শতাংশ অঞ্চলকেই তার আওতায় এনেছে। এটা এখনও বিজেপিকে স্বস্তি দেবে। ফলত, বিরোধীদের সভা গ্রামাঞ্চলে যতটা সফল হচ্ছে, শহরে তার ধারেকাছেও নয়।

শাসকদের আর একটা স্বস্তির জায়গা আদিবাসীরা— ভোটের নিরিখে ১৫ শতাংশ। ১৯৮০-র দশক অবধি গুজরাতে কংগ্রেসের অপ্রতিম সফলতার পিছনে ‘খাম’ নামে পরিচিত ক্ষত্রিয়-হরিজন–আদিবাসী–মুসলিম যে সমীকরণ ছিল, তার অন্যতম ঘটক, আদিবাসীদের বেশির ভাগই আজ সংগঠন ও সরকারের তালমিলে চলা নানা ‘কল্যাণ’মূলক ও হিন্দুত্বে অন্তর্ভুক্তির কার্যক্রমে বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের পকেটে। বিজেপির আর একটি বাঁচোয়া, মানুষের নানা ক্ষোভ সরকারের বিরুদ্ধে ধাবিত হলেও, মোদীর জনপ্রিয়তা কিন্তু তেমন কমেনি। লোকেদের রাগ মুখ্যত রাজ্য সরকার ও রাজ্য বিজেপির ওপর— যতটা অমিত শাহের প্রতি, মোদীর প্রতি ততটা নয়। মোদীর এই জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখেই রাহুল গাঁধী থেকে হার্দিক পটেল কেউই জনসভায় মোদীকে সরাসরি আক্রমণ করছেন না।

এই কারণেই শেষ পর্যায়ে দল মোদীকে দিয়ে যত বেশি সম্ভব জনসভা করিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু সেই সব সভায় আগের তুলনায় ভিড় কম হচ্ছে, আর মোদীও মাঝে মাঝেই মেজাজ হারিয়ে বেশি আক্রমণাত্মক হচ্ছেন। এটা কিসের ইঙ্গিত? ভিড় কম দেখে বিজেপি সংগঠনকে আরও তৎপর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। দল, সমাজ, সরকার যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে নির্বাচনের দিনে বুথগুলি ‘ম্যানেজ’ করলেই ভোটে জেতা যায়, এ কথা পশ্চিমবঙ্গবাসীর থেকে বেশি কে জানে! গুজরাতে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের বুথগুলিতে, বাহুবলের চেয়ে অর্থবলের দাপটে বিপক্ষের এজেন্টদের ‘ম্যানেজ’ করা বিজেপির বাঁয়ে-হাত-কা-খেল। মোদীর প্রবল ব্যক্তিত্ব ও দীর্ঘদিন সরকারে থাকার সুবিধার পাশাপাশি বিজেপির যে বড় ‘অ্যাডভান্টেজ’-এর বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে লড়তে হচ্ছে, তার নাম সংগঠন— দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় এবং ‘ক্যাডার’ভিত্তিক দল না হওয়ায় বিরোধী দলের সংগঠনের অবস্থা বহু জায়গায় এমন লজ্‌ঝড়ে যে মনে হচ্ছে, দৈত্যাকার গলিয়াথ-এর সঙ্গে দুবলাপাতলা ডেভিডের অসম লড়াই!

কিন্তু জনতার এক বিপুল অংশের কাছে বিরোধীদের তোলা মূল অভিযোগগুলি তাতে বাতিল হয়ে যাচ্ছে না। আসল অভিযোগ সাধারণ মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো কল্যাণকর পরিষেবার ক্ষেত্রে সরকারি উদাসীনতা, গত দশ বছরে নব্য-উদারবাদী পথে যার বিপুল বেসরকারিকরণ ঘটেছে। ফলে, শহরগুলিতে ঝাঁ চকচকে বহুমূল্য প্রাইভেট স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গাঁ-গঞ্জে স্কুলছুটের সংখ্যা। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার হালও তথৈবচ। এক দিকে জিডিপি বৃদ্ধির হার চড়চড় করে বাড়ছে, অন্য দিকে সাধারণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, মেয়েদের অবস্থা, এই সবই জাতীয় গড়ের চেয়ে পিছনে পড়ে থাকছে। অন্য বার এগুলি ‘হিন্দুত্বের’ বড় কম্বলে ঢাকা দেওয়া গেলেও, এ বার, প্রায় দু’দশক পরে, জাতপাতের বিষয়গুলি বড় হয়ে যাওয়ায় আর তা চাপা দেওয়া যাচ্ছে না। ২০১৪-র বিধানসভা ভোটে ৪০টি এমন আসন ছিল, যেখানে জেতা-হারার ব্যবধান ছিল এক থেকে দশ হাজারের মধ্যে। এই আসনগুলি এ বার দুপক্ষের কাছেই নির্ণায়ক হতে পারে।

তবে, নির্বাচনে যদি বিজেপি অল্প কিছু আসনে পিছিয়ে থাকে এবং কংগ্রেস যদি সামান্য এগিয়েও থাকে, অর্থ ও ক্ষমতার অস্ত্রে শেষ পর্যন্ত বিজেপিই সরকার গড়বে, এমন একটা সম্ভাবনার কথা বলছেন অনেকেই। এ ক্ষেত্রে বর্তমান ইউপিএর শরিক শরদ পওয়ারের এনসিপি বা মায়াবতীর বিএসপি হয়তো, জাতীয় রাজনীতির সমীকরণ বদলে, বিজেপির পরিত্রাতাও হয়ে উঠতে পারে, এমন কথা রাজ্য রাজনীতির আঙিনায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে।

সব মিলিয়ে, গুজরাত ভোট নিয়ে নানা মত থাকলেও জাতীয় রাজনীতিতে তার অভিঘাতের ব্যাপারে কিন্তু এক ধরনের ঐকমত্য আছে!

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gujarat Assembly Election 2017 Seats BJP Congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE