Advertisement
E-Paper

আজও কি চিনতে পেরেছি বাড়ির মহিলাদের?

সত্তরের দশকে মৃণাল সেন নির্মাণ করেছিলেন ‘একদিন প্রতিদিন’। মানুষের নিজেদের আরোপিত জেন্ডার ভাবনায় তিনি চাবুক কষিয়েছিলেন সেলুলয়েডে, সংলাপে এবং দৃশ্যে। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে  উঠে আসা  প্রশ্নমালার উত্তর  আজও অমীমাংসিত।  

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৪০
মৃণাল সেন। —ফাইল চিত্র।

মৃণাল সেন। —ফাইল চিত্র।

২০১৯ এর শুরুটা যদিও বাঙালির নিজস্ব বর্ষপঞ্জির নয়। অভ্যাসের নিউ ইয়ার যাপন। কিন্তু শুরুর আগেই এক জবরদস্ত ধাক্কা। মৃণাল সেনকে নতুন করে খুঁজে ফেরার পালা। ভেতরে শূন্য হতে থাকা মানুষের বুক জুড়ে সারি সারি ফাঁকা চেয়ারের ভিড়। যাঁদের কাছে কিছুই শেখা হল না, নেওয়া হল না তেমন করে কিছুই। প্রথাগত সমাজের বিশ্বাসের ভিতে খোদাই করে দিলেন যাঁরা হাজার প্রশ্ন। পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখার এমন এক চোখ নিয়ে চলে গেলেন মৃণাল সেন, সংলাপের যাদুকর, ক্যামেরার লেন্সে দুনিয়াদারিতে নিপুণ এক পরিচালক। সিনেমায় অ্যাকট্রেস বা নায়িকার উপস্থিতিকে চূড়ান্ত নম্রতার সঙ্গে তিনি উপস্থাপন করেন। সমাজে ও পরিবারে তাদের ঘিরে যে টানাপড়েন তার ‘সাবজেক্টিভ ভ্যালু’ নিয়ে নিরীক্ষণ চালিয়ে যান চলচ্চিত্র জুড়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে উঠে আসা প্রশ্নমালার উত্তর আজও অমীমাংসিত।

গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে দাঁড়িয়ে মৃণাল সেন নির্মাণ করেছিলেন ‘একদিন প্রতিদিন’। এক সমাজকে ধরে ফেলেছিলেন ৯৫ মিনিটের ঘড়ির কাঁটার হিসেবে। মানুষের নিজেদের আরোপিত জেন্ডার ভাবনায় তিনি চাবুক কষিয়েছিলেন ঘটনার উপস্থাপনে, সংলাপে, দৃশ্যে। পরিবারে মেয়েদের নিজেদের উৎসর্গ করা চিরাচরিত গৌরবের। সমঝোতা নামক এক বিপর্যয়ের ভার তার মাথায় ফেলে দিলে সকলে মুক্ত। এই অসম ভাবনার পেছনে লুকিয়ে থাকা নিরীহ সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার প্র্যাকটিস একইসঙ্গে লালিত।

সিনেমায় চিন্ময়ী সেনগুপ্ত ওরফে চিনুর চরিত্রের জন্ম এক সন্ধিক্ষণে। বাজার অর্থনীতির জোয়ার প্রায় এসে পড়েছে। কাজের ক্ষেত্র ও ধরন ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। যুবকের চেয়ে শিক্ষিত মেয়েদের কোম্পানি বা অফিসে কাজ পাওয়া তখন সহজ। সুতরাং বড় পরিবারে মায়ের হেঁশেলঘর ও যুবতী মেয়ের উপার্জনের শ্রমেই সংসার গাড়ির ইঞ্জিন চালু। যেখানে তথাকথিত ‘ভদ্দলোকে’র সংজ্ঞা নির্ভর করে পরিবারের মেয়ে রাতে ঠিক ক’টায় বাড়ি ফেরে সেই শর্তের উপরে। এই ‘ভদ্দলোক’ কারা? এই দলে নাম লিখিয়েছেন এমন মানুষ যারা ব্যক্তির স্বাধীনতায় নয়, আরোপিত সিদ্ধান্তের জীবনে বিশ্বাস করেন। এই আরোপের ইতিহাসকে বয়ে নিয়ে বেড়ানোর মধ্যেই নিজেকে আলাদা বা ব্যতিক্রম ঘোষণার অহং। মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মধ্যে সুখ ও শাসন দুই-ই আছে। এই শাসনের ইচ্ছা আসলে এক ধরনের জবরদস্তি। দুর্বল বা অধীনকে মনে করানো, যে অধিকার তাকে দেওয়া হয়েছে সেটার বাইরের হক তার দাবির মধ্যে থাকবে না। বাড়ি ভাড়া দিয়ে উপার্জন করা এক মালিকের ঠিক সেই জোর চলচ্চিত্রে। ঠিক কতক্ষণ আলো জ্বলবে, স্নানে ঠিক কতটা জল লাগবে, এমনকি বাড়ির পাশে নালা দিয়ে ঠিক কী বইবে, কতটা বইবে, মেয়েরা কতক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকবে তার নির্ধারণকর্তা তিনি নিজেই। চিনুর দাদা একসময় বিদ্রোহ করে। এমন ভদ্রলোক তথা মালিকের মুখে লাথি কষানোর কথা বলে ও মারতে উদ্যত হয়।

চিনুদি রাতভর বাড়ি না ফিরলে এলাকাজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি। বাড়ির মালিকের বাড়ি ছাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি। নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, মেয়ে ঘিরে বিপুল পারিবারিক সম্মানে আঁচড় না লাগার আকুতি। কিন্তু বাড়ির ছেলে বেওয়ারিশের মতো রাস্তায় খেলে মাথা ফাটালে তার আদর যত্নের শেষ নেই। বাড়িতে থাকা বেকার ভাই দিনরাত ঘুরে বেড়ালে কোনও অনুশাসনের পাঠ দেওয়া হয় না। কিন্তু চাকুরিরতা মেয়ে বাড়ি ফিরতে না পারলে তার বিরুদ্ধে লোক-হাসানোর অনুযোগ। দোরগোড়ার পড়শিও বলতে ছাড়ে না— মেয়েরা মেয়েদের মতো না চললে ওইরকমই হয়। যদি তখন বাচ্চা মেয়ে বলে ওঠে— আর মেয়েদের যখন ছেলেদের মতো কাজ করতে হয়? চলচ্চিত্রে তখন প্রতিবাদী মেয়ের মা-ঠাকুমাকে সতর্ক করা হয়— এই মেয়ে তোমায় ভোগাবে। প্রচলিত বিশ্বাসের সঙ্গে মানানসই বক্তব্য না দিলেই সেই মেয়ের ললাটলিখন— জনমভোর ভোগান্তি।

পারস্পরিক এই অন্যায় শর্তের জীবনকে কী ভাবে মেনে নেয় প্রতিবেশিরা তার প্রমাণ মেলে একজনের কথায়— আমাদের এরকম কিছু হলে আমরাও জানাতাম না, আমরা ভদ্রলোক। সন্ধ্যে ৬টা থেকে জল্পনা শুরু কিন্তু শেষপর্যন্ত ফিরে আসা মেয়েকে বাবা ঘুমিয়ে পড়তে বলে। কেউ এক বার প্রতিবাদ করে বলে না, কী হয়েছে মেয়ে রাতে বাড়ি না ফিরতে পারলে? ঘরে না ফিরতে পারার সীমাবদ্ধতার সঙ্গে যে গৃহসম্মানের অযৌক্তিক জুড়ে দেওয়া বদভ্যাসের ধারাবাহিকতা সেখানে কেউ ইতি টানার কথা ভাবে না। ভদ্রলোক যেন তখনই ভদ্রলোক যখন সে বাড়ির মহিলার উপর পরম্পরার বোঝা চাপিয়ে নিশ্চিত হতে পারে। মেয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে দমন করতে পারে। তার ব্যক্তিজীবনের পরিসরে অবাধে উঁকি দিতে পারে। চিরাচরিতকে মান্যতা দেওয়ার প্রশ্ন করা থেকে বিরত রাখতে পারে। কিন্তু শিক্ষা প্রশ্ন শেখায়, যুক্তি শেখায়। চাকুরিরতা মহিলার মধ্যে সম্মান ও স্বাধীনতাবোধ জন্মায় যা কোনও অনুশাসনের পরোয়া করে না।

অতি সাম্প্রতিক কালে হু এর এক রিপোর্ট নজর কাড়ে। জানা কথায় তথ্যের সিলমোহর পড়েছে বার বার। মেয়েরা তাদের নিজেদের বাড়িতে নিরাপদ কম। ভেতর তোলপাড় করা এই তথ্য যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার নাম ভদ্রতা। নিরাপদের সংজ্ঞার সীমানা যদি একটু বাড়িয়ে নেওয়া যায় তবে তার মধ্যে পড়ে ‘ক্যারেকটার অ্যাসাসিনেশন’। চরিত্রের কোতল করা নির্বিচারে। বাড়িতে একসঙ্গে বড় হওয়া ভাই ঘরে না ফেরা দিদি সম্পর্কে বলে ফেলছে— কোনও খারাপ কিছুর সাথে জড়িয়ে পড়ল কিনা! পড়শি ভাইয়ের বন্ধু ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দিচ্ছে অবলীলায়— তুই নিজের দিদিকে চিনিস না! যে সাত জনের পরিবার দিদির উপার্জিত পয়সায় পালিত হয় সেই পরিবার ব্যক্তি চিনুদিকে মোটেই সম্মান করে না। তাঁর বিবাহ না করা পরিবার একনিষ্ঠ জীবন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না তাদের চোখে। সন্দেহের বিষ তির যেন বিদ্ধ করতেই থাকে চিনুদির ঘরে না ফেরার অবাধ্যতাকে। পথঘাটের সীমাবদ্ধতার চেয়ে ব্যক্তি চিনুর চালচলন নিয়ে পরিবার প্রশ্ন তুলে ফেলে অজান্তেই।

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

Mrinal Sen মৃণাল সেন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy