Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

দহন

মেয়েদের উপর অপরাধে পশ্চিমবঙ্গের স্থান যে লজ্জাজনক, তাহার অন্যতম কারণ অপরাধীর প্রতি পুলিশ-প্রশাসনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রশ্রয়।

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৪৮
Share: Save:

অ্যাসিডের দহনে মুখের ত্বক অথবা খাদ্যনালী দগ্ধ হইবার চাইতে যন্ত্রণাময় কী হইতে পারে? ক্ষত সারাইবার দীর্ঘ, খরচসাপেক্ষ চিকিৎসার যন্ত্রণাও কম নহে। কিন্তু তাহাতেও নিষ্কৃতি নাই, এই রাজ্যের অ্যাসিড আক্রান্ত মেয়েদের উপর চলিতে থাকে হুমকি, হেনস্থা ও ভুয়া মামলার উৎপীড়ন। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা অভিযুক্তদেরই প্রশ্রয় দেয়। কন্যাসন্তানের জন্ম দিবার ‘অপরাধ’-এ মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার এক ব্যক্তি স্ত্রীকে অ্যাসিড খাওয়াইয়াছিলেন বলিয়া অভিযোগ। স্ত্রী প্রাণ হারান নাই, কিন্তু এখন মেয়েকে হারাইবার ভয়ে কাঁপিতেছেন। অভিযুক্ত স্বামী কন্যাটিকে অপহরণের হুমকি দিয়াছে। দমদমে ২০১৪ সালে অ্যাসিড আক্রমণের এক ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তি তিন বৎসর ধরিয়া আক্রান্ত তরুণীকে ভয় দেখাইয়াছে। আদালত রাজ্য পুলিশের ডিজিকে ভর্ৎসনা করিবার পর সম্প্রতি তাহাকে গ্রেফতার করিয়াছে পুলিশ। এই ভয়ানক নকশা রাজ্যের সর্বত্র স্পষ্ট। পুলিশে অভিযোগ লিখাইবার পর মেয়েদের বিপন্নতা কমে নাই। ভীতিপ্রদর্শনের মুখে তাহারা ঘর ছাড়িতেছে। ছিন্নমূল, সহায়হীন অবস্থায়, ব্যথাকাতর দেহে তাহারা পরীক্ষা দিয়া, কাজ খুঁজিয়া, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিবার চেষ্টা চালাইতেছে। অপর দিকে অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেফতার এড়াইয়া, বা জামিনে মুক্তি পাইয়া নিজের এলাকাতেই ঘুরিতেছে। তাহার পরিবার প্রভাব খাটাইয়া অভিযুক্তের পরিবারকে আরও বিপর্যস্ত করিতেছে।

মেয়েদের উপর অপরাধে পশ্চিমবঙ্গের স্থান যে লজ্জাজনক, তাহার অন্যতম কারণ অপরাধীর প্রতি পুলিশ-প্রশাসনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রশ্রয়। মহিলা পুলিশ, মহিলা থানা, মহিলা আদালত, ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট, কিছুই নির্যাতিত মেয়েদের নিজগৃহে থাকিবার মতো নিরাপত্তা কেন দিতে পারে না? অ্যাসিড-আক্রান্তদের দ্রুত আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থাটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ করিয়া রাখা হইয়াছে কেন? কেনই বা প্রধানমন্ত্রীর তহবিল হইতে এ রাজ্যের মেয়েরা সহায়তা পায় নাই? দুই-চারিটি সমাজসেবক সংস্থা ব্যতীত আক্রান্ত মেয়েদের পাশে কেহ নাই। আক্রান্তরা অধিকাংশই স্কুল বা কলেজের ছাত্রী, অথবা তরুণী বধূ। অভিযোগের নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হইলে তাহাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হইবার, স্বাভাবিক জীবন পাইবার সম্ভাবনা ক্ষীণতর হইবে। বিচারপ্রার্থী মেয়েদের এমন দীর্ঘ বিপন্নতা দেখিয়া কিশোরী-তরুণীরা কি অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করিবার সাহস পাইবে? হুমকি ও হয়রানির নিদর্শন দেখিয়া পুলিশ-প্রশাসনে আস্থা রাখিতে পারিবে?

অপরাধ দমনের অস্ত্র আইন। দুর্ভাগ্য, প্রায়শই আইনকে ঢাল করিয়া পুলিশ অপরাধীকে আড়াল করিতেছে। অ্যাসিড আক্রমণ হইবার অর্থ, পুলিশ সেই এলাকায় অ্যাসিড-বিক্রয় নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। কেন পুলিশের শাস্তি হইবে না? সমাজ কল্যাণ, নারী সুরক্ষার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকেরা কেন অ্যাসিড-আক্রান্তের সুরক্ষার তদারকি করিবেন না? আক্রান্ত মেয়েরা যদি এলাকা ছাড়িতে বাধ্য হয়, কেন পুলিশ ও প্রশাসন জবাবদিহি করিবে না? যদি মেয়েটি যথাসময়ে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ না পাইয়া থাকে, কেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের পদাবনতি হইবে না? ইহাদের নিষ্ক্রিয়তার অর্থ অপরাধীর সহায়তা। নির্যাতিতা প্রতিবাদ করিলে তাহাকেই শাস্তি দেয় পুরুষতন্ত্র। আজ রাষ্ট্র সেই কাজটিই করিতেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

acid attack Police Administration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE