ছবি: সংগৃহীত
আরও এক দফা সঙ্কটের সম্মুখীন ভারতীয় অর্থনীতি। এবং, আরও এক বার প্রমাণিত, সমস্যা কোনও বিশেষ একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নহে— সমস্যা গোটা দেশের আর্থিক ব্যবস্থার। ইয়েস ব্যাঙ্ক-এর অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ রাতারাতি বাড়ে নাই। ২০১৩-১৪ সাল হইতেই ব্যাঙ্কটি বিপজ্জনক ঋণ প্রদান শুরু করে। এবং, হিসাবের খাতায় অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ কমাইয়া দেখাইতে থাকে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তৎকালীন গভর্নর রঘুরাম রাজন অনাদায়ী ঋণ বিষয়ে কড়াকড়ি করিয়া একাদিক্রমে দিল্লির অধীশ্বর এবং ব্যাঙ্ককর্তাদের চক্ষুশূল হইয়াছিলেন। ক্ষমতার অলিন্দে কান পাতিলেই শোনা যাইতেছিল, রাজনের বাড়াবাড়িতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার গোপনীয়তা বলিয়া আর কিছু থাকিতেছে না। তাঁহার উত্তরসূরি উর্জিত পটেলও অনাদায়ী ঋণের প্রশ্নে কঠোর অবস্থান লইয়াছিলেন। তাঁহার পরিণতিও দেশ দেখিয়াছে। তাঁহাদের এই সুতীব্র উদ্বেগ কতখানি যথাযথ ও প্রয়োজনীয় ছিল, তাহা বোঝা যাইতেছে আজ— যখন হিসাব মিলিতেছে, ইয়েস ব্যাঙ্কে আমানতের তুলনায় ঋণের পরিমাণ বেশি। ব্যাঙ্কে গোলমালের আশঙ্কায় বড় আমানতকারীরা টাকা তুলিয়া লওয়ামাত্র এই পরিস্থিতি। কোনও ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় যাহা অকল্পনীয়, ভারতে ঠিক তাহাই রমরম করিয়া চলিয়াছে। ইয়েস ব্যাঙ্কের অবিশ্বাস্য দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় লাগাম পরানো হয় নাই, তবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের শীর্ষপদ হইতে রঘুরাম রাজন বা উর্জিত পটেলরা সরিয়াছেন। সেখানে এখন শক্তিকান্ত দাসের অধিষ্ঠান।
ইয়েস ব্যাঙ্ক যে সংস্থাগুলিকে বড় মাপের ঋণ দিয়াছিল, তাহাদের অনেকগুলিই আর্থিক ভরাডুবির সম্মুখীন। অনিল অম্বানী গ্রুপ, এসেল গ্রুপ, ডিএইচএফএল, আইএলঅ্যান্ডএফএস, ভোডাফোন, ক্যাফে কফি ডে— তালিকাটি সাংঘাতিক। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ইতিমধ্যেই গাহিয়া রাখিয়াছেন যে এই ঋণগুলি ২০১৪ সালের পূর্বেই দেওয়া। অর্থমন্ত্রী যে দায়টি ঝাড়িয়া ফেলিবার বৃথা প্রচেষ্টা করিতেছেন, তাহা প্রবল রকম প্রকট। ঋণগুলি কবেকার, সেই প্রশ্ন তুলনায় গৌণ— কেন এই জমানাতেই ব্যাঙ্কের টাকা ফেরত না দেওয়ার রোগটি মহামারির আকার ধারণ করিতেছে, উত্তর তাঁহাদের দিতে হইবে। অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ যখন বাড়িতেছিল, তখন কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হয় নাই কেন? উল্লেখ্য, ইয়েস ব্যাঙ্কের অনাদায়ী খাতকদের তালিকায় যাঁহারা রহিয়াছেন, তাঁহাদের এক জনের ভুঁইফোঁড় সংস্থা সরকারি হ্যাল-কে টপকাইয়া রাফাল যুদ্ধবিমান নির্মাণের বরাত পাইয়াছেন। অন্য এক জনের লিখিত বই প্রকাশ করিয়াছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, তাঁহার বাসভবন হইতে। সূত্রগুলি জুড়িতে বিশেষ সমস্যা হইবার কথা নহে। ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে এই অতলে নামাইবার দায় কাহাদের, ক্রমশ স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে না কি?
সাধারণ মানুষের নিকট একটি প্রশ্ন ক্রমে তীব্রতর হইতেছে— ব্যাঙ্কে টাকা রাখা কি আদৌ নিরাপদ? স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে বহু চেষ্টায় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার প্রতি যে আস্থা নির্মিত হইয়াছিল, গত কয়েক বৎসরে তাহা কার্যত উবিয়া গিয়াছে। নোট বাতিল এবং বিভিন্ন দফায় ব্যাঙ্ক সঙ্কট যে অবিশ্বাস তৈরি করিয়াছে, গত সাত দশকে তাহার তুল্য পরিস্থিতি ভারত দেখে নাই। সর্বাপেক্ষা উদ্বেগের কথা, গোটা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা দাঁড়াইয়া থাকে একটিমাত্র বস্তুর ভিত্তিতে— তাহার নাম বিশ্বাস। এই বিশ্বাস যে ব্যাঙ্কে টাকা রাখিলে তাহা মার যাইবে না। যদি এই বিশ্বাসটি উবিয়া যায়, যদি সব আমানতকারী একই সঙ্গে নিজেদের টাকা তুলিয়া লইবার জন্য ব্যাঙ্কে লাইন দেন, তবে দুনিয়ার সেরা ব্যাঙ্কও ফেল করিবে। ইয়েস ব্যাঙ্ক-বিপর্যয়ের পর অবিশ্বাসের জল কার্যত সেই স্তরেই বহিতেছে। বিশ্বাস ফিরাইবার পথ অবিলম্বে না খুঁজিলে কী হইতে পারে, নির্মলা সীতারামনেরা জানেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy