Advertisement
E-Paper

বড় বাঙালিদের জগতে

পুজোর ছুটিতে দিন কয়েকের জন্য ইলাহাবাদে এসেছি। শহরের প্রান্তে ‘ঝুসি’-তে, হরিশ্চন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটে, বাল্যবন্ধু বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়ের কাছে।

শিবাজীপ্রতিম বসু

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
ঐতিহ্য: চিন্তামণি ঘোষের বাড়ি। জর্জ টাউন, ইলাহাবাদ

ঐতিহ্য: চিন্তামণি ঘোষের বাড়ি। জর্জ টাউন, ইলাহাবাদ

তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে, এখানকার কয়েকটা ফেমাস বাঙালিদের বারোয়ারি দুর্গা পুজো দেখিয়ে আনি— তার মধ্যে একটা চিন্তামণি ঘোষদের পরিবারের লোকজনরাই চালায়।’

‘চিন্তামণি ঘোষ কে?’

‘সে কী রে! এলাহাবাদে বসে এ কথা জিজ্ঞেস করছিস? একশো বছর আগে হলে করতিস না। চিন্তামণি হলেন ইন্ডিয়ান প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা...’, আমার অজ্ঞতাকে অধোবদন করে জানাল বিশ্বরূপ। একটু সামলে নিয়ে বললাম, ‘ইন্ডিয়ান প্রেস মানে যারা এক সময় রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিককার কিছু বই ছাপিয়েছিল?’ ‘শুধু প্রথম দিকের নয়, ১৯০৮ থেকে প্রায় সত্তর-আশিটা বিখ্যাত বই, যার মধ্যে ‘গীতাঞ্জলি’ও আছে, ওরাই তার প্রথম প্রকাশক। এখান থেকেই তো রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী’ আর ‘মডার্ন রিভিউ’ বেরোত।... চিন্তামণির নাতি কল্যাণদা ওই পুজোর মাথা, খুব কালচার্ড মানুষ। এলাহাবাদের প্রবাসী বাঙালিদের নাট্যচর্চার অন্যতম পুরোধা।... সন্ধ্যায় আরতির সময় গেলে দেখা হতে পারে।’ চটপট বেরিয়ে পড়লাম।...

পুজোর ছুটিতে দিন কয়েকের জন্য ইলাহাবাদে এসেছি। শহরের প্রান্তে ‘ঝুসি’-তে, হরিশ্চন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটে, বাল্যবন্ধু বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। পদার্থবিদ্যার উচ্চ-তত্ত্বচর্চার অতি বিখ্যাত গবেষণা কেন্দ্র এটি। এখানেই কাজ করেন অশোক সেন, ‘স্ট্রিং থিয়োরি’র ওপরে বিশ্ববিশ্রুত গবেষণার জন্য ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স প্রাইজ পেয়েছেন। লন্ডনের রয়াল সোসাইটির ‘ফেলো’ নির্বাচিত হওয়ার সময় ওঁর নাম সুপারিশ করেছিলেন স্বয়ং স্টিফেন হকিং! বিশ্বরূপও কৃতী ছাত্র, গবেষক ও শিক্ষক, বহু দিন আগেই ‘শান্তিস্বরূপ ভাটনগর’ পুরস্কার পেয়েছে।

গঙ্গার দীর্ঘ ব্রিজ পেরিয়ে ইলাহাবাদ শহর। দূরে যমুনার ব্রিজ ও গঙ্গাযমুনার ‘সঙ্গম’ স্থল দেখা যাচ্ছে। অতি প্রাচীন এই প্রয়াগ নগরের নাম ইলাহাবাদ হল, যখন বাদশা আকবর ১৫৭৫ সালে সঙ্গমের পাড়ে, রণকৌশলগত সুবিধার জন্য একটি কেল্লা বানান, যে কেল্লা পরে ব্রিটিশরা দখল করে, এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কব্জায়। বহু অমূল্য ঐতিহাসিক দলিল ও শিল্পসামগ্রী এই দুর্গে সংরক্ষিত থাকলেও ‘সুরক্ষা’র (দুর্জ্ঞেয়) কারণে তা সাধারণের নজরের বাইরেই থাকে। আধুনিককালে লোকে ইলাহাবাদকে চেনে উত্তরপ্রদেশের হাইকোর্টের অধিষ্ঠানস্থল, নেহরু পরিবারের (মোতিলাল-জওহরলাল-ইন্দিরার) বাসগৃহ ‘আনন্দ ভবন’, কিংবা কবি হরিবংশ রাই বচ্চন ও তাঁর চিত্রাভিনেতা পুত্র অমিতাভ বচ্চনের জন্য। কিন্তু এর পাশাপাশি, উনিশ শতক থেকে বহু বাঙালি কর্মসূত্রে গিয়ে এই শহরে গিয়ে, সাফল্য পেয়ে, প্রজন্মপরম্পরায় এখানেই থেকে গিয়ে ‘প্রবাসী’ তকমা পেয়েছেন।

ইলাহাবাদের বর্ধিষ্ণু বাঙালিরা থাকে পাশাপাশি দুটি অঞ্চল— টেগোর টাউন ও জর্জ টাউনে। দুটি জায়গাতেই ধুমধাম করে বারোয়ারি পুজো হয়। সন্ধের মুখে পৌঁছলাম, জর্জ টাউনের ‘জগত্তারণ’ মণ্ডপে, সেখানেই দেখা হল চিন্তামণি ঘোষের পৌত্র, কল্যাণ ঘোষের সঙ্গে। নানাবিধ কথার পর উঠল ওঁর পিতামহ চিন্তামণি ঘোষ, ইন্ডিয়ান প্রেস আর রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ। এ বিষয়ে সম্প্রতি যদিও কল্যাণবাবুর পরের প্রজন্মের অরিন্দম ঘোষ একটা পুস্তিকা লিখেছেন, তবুও ওঁর কাছ থেকেও জানতে কৌতূহল হল।

১৮৮৪ সালে ইলাহাবাদে ইন্ডিয়ান প্রেস স্থাপন করেছিলেন চিন্তামণি ঘোষ (১৮৫৪-১৯২৮)। আদি বাড়ি বালি-তে। অতি অল্প বয়সে ইলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত ইংরেজি ‘পায়োনিয়র’ পত্রিকায় ডেসপ্যাচ ক্লার্ক হিসেবে কাজ করতেন। তাতে সন্তুষ্ট না থেকে, সামান্য বেতন থেকে বারো টাকা জমিয়ে একটা ট্রেডল ছাপা-মেশিন কিনে, ইন্ডিয়ান প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। তিন বছরের মধ্যে চিন্তামণি, ম্যুয়র সেন্ট্রাল কলেজের (পরে যা ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যক্ষ ই জি হিল-কে দিয়ে, দু’হাজার টাকা পারিশ্রমিকে ভূগোলের পাঠ্যপুস্তক লিখিয়ে, বিপুল লাভ করেন। আরও বহুবিধ স্কুলপাঠ্য বইয়ের প্রকাশে ব্যবসা রমরম করে চলতে লাগল।

এর ফলেই, ইন্ডিয়ান প্রেস ইংরেজি ও প্রধানত হিন্দি ভাষায় সাহিত্যকর্ম প্রকাশ করতে থাকে। ১৯০০ সালে শুরু হওয়া সাহিত্য পত্রিকা ‘সরস্বতী’র প্রকাশ হিন্দি সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূচনা করল। মুন্সি প্রেমচাঁদ থেকে নিরালা, নেহরু, লালা লাজপত রায় থেকে গোবিন্দবল্লভ পন্থ, আচার্য নরেন্দ্র দেব, কে নেই লেখক তালিকায়! ছাপার ও অলংকরণের প্রযুক্তিতেও আধুনিক ভাবনা, ক্রোমোলিথোগ্রাফি প্রযুক্তি এনেছিলেন চিন্তামণি। যার ফলে, রাজা রবি বর্মা, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, অসিত হালদার, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদারদের মতো খ্যাতনামা শিল্পীদের ছবি ছেপেছে ইন্ডিয়ান প্রেস।

চিন্তামণির নেতৃত্বে এই জয়যাত্রায় একটি সুবর্ণ অধ্যায় অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইন্ডিয়ান প্রেসের সম্পর্ক। সূত্রটি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার সিটি কলেজ ছেড়ে ইলাহাবাদের কে পি কলেজের প্রিন্সিপাল, রামানন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন ভারতের সাময়িকপত্রের ইতিহাসে যুগান্তকারী দুই পত্রিকা: বাংলায় ‘প্রবাসী’ (১৯০১) আর ইংরেজিতে ‘মডার্ন রিভিউ’ (১৯০৭)। প্রকাশক ইন্ডিয়ান প্রেস। এই পত্রিকা দু’টির নিখুঁত ও ঝকঝকে সংস্করণ দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হন। প্রায় এই সময়েই প্রেসের কলকাতা শাখায় ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন রবীন্দ্রানুরাগী চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। চারুবাবুও চান রবীন্দ্ররচনা ছাপতে। রামানন্দ ও চারুচন্দ্র, উভয়ের অনুরোধে কবি সকৌতুক জানান, যদি চিন্তামণি তাঁর সাহিত্যিক ‘দুষ্কর্ম’-এর (‘মিসডিড’) ভার নিতে রাজি থাকেন, তবে তাঁর আপত্তি নেই।

সেই মতো প্রথমে ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ও ইন্ডিয়ান প্রেসের প্রথম চুক্তি হয়, ১৯০৯ সালে তার কিছু সংশোধন হয়, এর পর ১৯১৪ সালে (নোবেল পাওয়ার পর) একটি নতুন চুক্তি হয়, তাতে, সেই সময়ে অভূতপূর্ব, কবিকে ২৫ শতাংশ রয়ালটি দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। চুক্তিপত্রে রবীন্দ্রনাথ ও চিন্তামণির পাশে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেন অতুলপ্রসাদ সেন ও রবীন্দ্রনাথ-গাঁধীর বিশিষ্ট বন্ধু সি এফ অ্যান্ড্রুজ। এর বেশ কিছু পরে বিশ্বভারতীর গ্রন্থনবিভাগ চালু হলে রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে ১৯২২ সালে চিন্তামণি, ব্যবসায়িক লাভক্ষতির তোয়াক্কা না করে, ‘প্রেস’-প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনার প্রকাশন-স্বত্ব বিশ্বভারতীকে হস্তান্তর করে দেন। বিষয়টি চূড়ান্ত করতে নেপালচন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রনাথ ও রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে ইলাহাবাদে পাঠান কবি।

এই ভাবে রবীন্দ্রনাথ ও ইন্ডিয়ান প্রেসের দীর্ঘ পনেরো বছরের সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক ভাবে শেষ হয়। এই কালখণ্ডে চিন্তামণি রবীন্দ্রনাথের ৪৭টি গদ্য ও ৪০টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। যার মধ্যে কয়েকটি হল ‘বউঠাকুরানীর হাট’, ‘গোরা’, ‘চোখের বালি’, ‘গল্পগুচ্ছ’, ‘রাজর্ষি’, ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’, ‘অচলায়তন’, ‘স্বদেশ’, ‘সমাজ’, ‘ধর্ম’, ‘শান্তিনিকেতন’, ‘ছবি ও গান’, ‘কড়ি ও কোমল’, ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘মায়ার খেলা’, ‘মালিনী’, ‘সোনার তরী’, ‘শিশু’, ‘বিসর্জন’, ‘কথা ও কাহিনী’ প্রভৃতি এবং সর্বোপরি ‘গীতাঞ্জলি’।

প্রকাশনার উচ্চ গুণমানে বিশ্বাস করতেন চিন্তামণি। এক বার সঙ্গীত সংকলন ‘গান’-এ বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ থাকায় কবি ক্ষুব্ধ হলে, চিন্তামণি সমস্ত কপি নষ্ট করে প্রমাদমুক্ত বই নতুন করে ছেপে দেন। আর এক বার (১৯১৪) ইলাহাবাদে এসে রবীন্দ্রনাথ অনুরোধ করেন, যদি তাঁর ‘গীতালি’ বইটি পক্ষকালের মধ্যে ছেপে দেওয়া যায়। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে চিন্তামণি বাড়তি কর্মী নিয়োগ করে, তাঁদের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করে, যুদ্ধকালীন ভাবে দিনরাত খেটে বইটি প্রকাশ করেন। তা দেখে বিস্মিত রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘চিন্তামণিবাবু কি ম্যাজিক জানেন? এর বদলে আমি কী দিতে পারি?’ উত্তরে চিন্তামণি কবিকণ্ঠে গান শুনতে চাইলে, রবীন্দ্রনাথ গান, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে...’। ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন হলেও এই শ্রদ্ধার সম্পর্ক ঘোষ পরিবার টিকিয়ে রেখেছিলেন। চিন্তামণির মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংগ্রহ করতে ইলাহাবাদে এসেছিলেন (১৯৩৫) ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের দল নিয়ে। চিন্তামণি-পুত্র হরিকেশবকে কবি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু কোনও প্রেক্ষাগৃহ বিনা পয়সায় হল দিতে রাজি হল না। তখন হরিকেশব রাতারাতি ইলাহাবাদের সিভিল লাইনে একটি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করে এই অনুষ্ঠান সম্ভব করেন।

গঙ্গার ব্রিজ ধরে ফিরে যাচ্ছিলাম। মনে পড়ল, ক্ষুদ্রমনা ও বিশাল চিত্তের ইংরেজদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা একটা প্রবন্ধ, ‘ছোট ও বড়’র কথা। এতক্ষণ ধরে বোধহয় আমরা ‘বড়’ বাঙালিদের জগতে ছিলাম!... নবমীর চাঁদে গঙ্গার জল চিকচিক করছিল। আমার কানে বহুযুগের ওপার থেকে ভেসে এল, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার ’পরে...

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

Rabindranath Tagore Indian Press ইলাহাবাদ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy