অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা লইয়া নালিশ নূতন নহে। কিন্তু বাতানুকূল যন্ত্র সারাইবার মিস্ত্রিকে অভিজ্ঞ চিকিৎসক সাজাইয়া অ্যাম্বুল্যান্সে রোগীর সহিত পাঠাইবার সংবাদ ঈষৎ অভিনব বটে। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এক কিশোর বর্ধমান হইতে কলিকাতার পথে প্রাণ না হারাইলে হয়তো এমন চরম অনিয়ম সম্মুখে আসিত না। ফের স্পষ্ট হইল, সঙ্কটাপন্ন রোগীর পরিবারকে প্রতারণা করিয়া, চাপ দিয়া টাকা আদায়ের কী ভয়ানক ব্যবস্থা জেলায় জেলায় কাজ করিতেছে। ইহা নিয়ন্ত্রণের কাজটিও সহজ হইবে না। রোগীবাহী যানের সঙ্কট বড় কম নহে। এক তো সকল এলাকায় তাহা মেলে না। গাড়ি মিলিলেও পরিষেবা মেলে না। চালক ও সহায়কের রোগীর সহায়তার যথাযথ প্রশিক্ষণ নাই, রোগী তুলিবার-নামাইবার পদ্ধতি তাহারা রপ্ত করে নাই। অপটু কর্মীর হাতে রোগীর প্রাণসংশয় বাড়িতে পারে। অদক্ষতার সহিত জোড় বাঁধিয়াছে দুর্নীতি। অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের একাংশ কার্যত দালাল। ‘কমিশন’-এর বিনিময়ে জেলার স্বল্পশিক্ষিত, স্বল্পবিত্ত মানুষকে বড় শহরের বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোমে ঢুকাইয়া তাহারা টাকা নেয়। ইহাই প্রাণদায়ী পরিষেবার প্রকৃত রূপ।
কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নাই। বিধিও অত্যন্ত শিথিল। মোটরযান আইনের অধীনে ‘অ্যাম্বুল্যান্স’ হিসাবে গাড়ির নথিভুক্তি করাইলে যথেষ্ট। অপর কোনও শর্ত মালিক বা চালক মানিল কি না, দেখিবার কেহ নাই। সম্প্রতি সরকারি নানা প্রকল্পের অধীনে ‘মাতৃযান’ বা ‘নিশ্চয়যান’ হিসাবে কিছু গাড়ি চিহ্নিত হইয়াছে। কেন্দ্র-নির্দিষ্ট শর্তাবলি তাহাদের মানিতে হয়, অন্তত মানিবার অঙ্গীকার করিতে হয়। কিন্তু শিশু ও মায়ের জন্য নির্দিষ্ট সেই কয়েকটি যান অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবার কতটুকু? রোগীবাহী যানের বৃহত্তর অংশই সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত। এমনকী অ্যাম্বুল্যান্স কী কাজে ব্যবহৃত হইতেছে, তাহারও ঠিক নাই। অপর দিকে, নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির অভাবে নষ্ট হইতেছে বহুমূল্য যান। সাংসদ ও বিধায়করা নিজ-নিজ নির্বাচনী ক্ষেত্রে মূল্যবান, উচ্চ প্রযুক্তির অ্যাম্বুল্যান্স দান করিয়াছেন। প্রশিক্ষিত কর্মী নাই বলিয়া সেগুলি সাধারণ যানের ন্যায় ব্যবহার হইতেছে।
ইহা বিস্ময়কর যে সরকার ‘গোল্ডেন আওয়ার’— অর্থাৎ দুর্ঘটনা, হৃদরোগ, মস্তিষ্কে স্ট্রোক বা অন্যান্য কারণে রোগীর সঙ্কট উপস্থিত হইবার পর প্রথম এক ঘণ্টা— কাজে লাগাইবার উপর অত্যন্ত জোর দিতেছে, অথচ অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবার মানের দিকে তাহার নজর নাই। অ্যাম্বুল্যান্সেই কি রোগীর অতি-গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ঘণ্টার একটি বড় সময় অতিবাহিত হয় না? তখন তাঁহাকে আপৎকালীন চিকিৎসা দিয়া বাঁচাইয়া রাখিবে কে? ‘ইমার্জেন্সি টেকনিশিয়ান’ পদটিই এ রাজ্যে নাই, তাহাতে নিয়োগও নাই। কেন আপৎকালীন চিকিৎসায় প্যারামেডিক কর্মী যথেষ্ট গুরুত্ব পাইবে না? কেন অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবার উপর নজরদারির জন্য স্বাস্থ্য দফতরে নির্দিষ্ট আধিকারিক নাই? সরকারি ও বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সে কী কী সরঞ্জাম, ও কীরূপ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি থাকা প্রয়োজন, সে বিষয়ে সরকারি বিধিনিয়ম সর্বসমক্ষে প্রচার করিবার প্রয়োজনও কম নহে। এ বিষয়ে সাধারণের অজ্ঞতার সুযোগই লইয়া থাকে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অবিলম্বে অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবাকে স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও দক্ষ করা হউক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy