ইতিহাসের গতিপথ ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের ভিতরেই অবস্থান করে। আর ইতিহাস পরিবর্তন সহজ কর্ম নয়। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ও ক্ষমতা দখলের ভয়ঙ্কর স্রোত গোটা পৃথিবীকে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। এ তো গেল বিশ্বায়নের ভূমিকম্পের কথা। কিন্তু ভারত? গোটা ভারত শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গড়ে উঠেছে— সেটাও একটা আবেগের স্রোত। আর সেটা দেশপ্রেম কিংবা জাতীয় ধর্মের রাস্তাতেই। এই বহুর মধ্যে ঐক্যের ধাবমান ধারা রাজনৈতিক ধারণা থেকেই উঠে এসেছে। একে কেন্দ্র করেই সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টি ও শিল্পের বিকাশ। আগে যেটা ছিল রাজনৈতিক ও রাষ্ট্র নেতাদের স্লোগান, এখন সেটা একটা জাতির স্লোগান।
ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটেছে বলেই জাতীয়সত্তার বিকাশ ঘটেছে। ফলে, ভারতাত্মার নামে যে জাতীয় মেরুদণ্ড তৈরি হয়েছে সেটা খানিক শক্তপোক্ত। সাত দশক আগের পাওয়া স্বাধীনতা ও প্রজাতন্ত্রের হাত ধরে যে মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, তাতে ভারত নামটা নড়বড়ে হয়ে যায়নি, এটা অন্তত আশার কথা। আশার আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পরবর্তী রাজনৈতিক নেতাদের খানিক অবদান আছে। এর কারণ সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীন হওয়ার স্বপ্নভঙ্গ তখনও ঘটেনি। একটা উন্মাদনা তো ছিলই। এখানে বলে নেওয়া ভাল যে তখনও রাষ্ট্র নেতারা যে সাম্প্রদায়িকতায় ক্ষেত্রে ধোঁয়া তুলশি পাতা ছিলেন, এমন নয়। তবে সরাসরি ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে উস্কানি দেওয়া থেকে বিরত ছিল। আবার দেশভাগের যন্ত্রণাকাতর মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছিল না, এমন নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ কখনওই সারা জীবনের জন্য এই দ্বেষ পুষে রাখে না, এটাও সত্য। এর জন্য ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো অনেকাংশে সাফল্য দাবি করতে পারে। দেশ হারানোর যন্ত্রণা বাইরে না হোক, ভিতরে ভিতরে থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু খুঁচিয়ে ঘা করা এখনকার রাষ্ট্রনেতাদের রাজনৈতিক ইস্যু। দু’-তিন পুরুষের আগের ঘটনা পরবর্তী জেনারেশনে অনেকটাই ফিকে হয়ে আসে। আবার, তাকে উসকে দিলেও তার ফল এখনও পর্যন্ত যে মাত্রা ছাড়ায়নি, তার কারণও ওই ফিকে হওয়া। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি কিংবা কাজের সন্ধান দেওয়া যাদের মূল কাজ, তারা এখন সত্তর বছর আগের ভুলে যাওয়া ঘা-কে খুঁচিয়ে তুলতে ব্যস্ত।
পাঁচের দশক থেকে দেশের প্রগতিশীল বাম রাজনীতি শক্তি যতখানি সংগঠিত ভাবে মানুষকে সচেতন ও প্রগতিমুখী করার কাজ করেছিল, সেই শক্তিতে বেশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে বিভেদকামী রাজনীতি। বর্তমানে বাম রাজনীতির খানিক পেশাদারিত্বের অভাব আছে। ভিতর থেকে মেধাশক্তির কিংবা চিন্তাশক্তির ক্ষয় যে ঘটছে না, এমনও নয়। কেন ক্ষয়— তার বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। তবে এর জন্য অনেকাংশে দায়ী বিশ্বায়নের রণনীতি। মৌলবাদী শক্তি রাজনীতির হাতিয়ার এখন অনেক দেশেই। রাষ্ট্রশক্তি যখন মৌলবাদী শক্তির হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন তা ভয়ের কারণ হয়। বিশেষত, ভারতের মতো দেশে, বিশাল জনসংখ্যা যার মাথাব্যথার কারণ। ছোট দেশগুলোর ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা দমননীতির দ্বারা পরিচালিত হলেও অবনতি অতটা চোখে পড়ে না। কিন্তু এ দেশের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়।
অনেকেই এই সত্যটা বুঝতে পারছেন। পারছেন বলেই বিপন্ন বোধ করছেন। তাই মাঝে মাঝেই মুখ খুলছেন। কেউ বলছেন নিরাপত্তাহীনতা, কেউ আবার বলছেন অসহিষ্ণুতা। তবে এ দুটো অভিযোগই সত্যি। যাঁরা দূরদ্রষ্টা তাঁরা বুঝতে পারছেন, যে শক্তিতে ভারতের ঐক্যবন্ধন সেই শক্তি এক বার যদি আলগা হতে শুরু করে, তবে সমূহ বিপদ। আর এই কথায় যাঁরা আহত হচ্ছেন, তাঁরা নিজেদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়ে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন, এতে কোনও সন্দেহ নেই। আবার কেউ কেউ মৌলবাদের জবাব আর একটি মৌলবাদকে আশ্রয় করে দিচ্ছেন। এর কারণ সেই ভোট বৈতরণী পার। যেন আর কোনও রাস্তা নেই। এগুলোই সঙ্কট বর্তমান অবস্থায়। কোথাও ইমামভাতা, কোথাও হিন্দু সাধুদের ভাতা। কোথাও রথ, তার বিপরীতে খোল-করতালের কীর্তন। কোনও চিন্তাভাবনার অবকাশ নেই। দেশের নেতারাই দেখা যাচ্ছে অশিক্ষা কুশিক্ষা ছড়াচ্ছেন। মানুষের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে জাগানোর কাজ করছে রাজনীতি। নিজেদের স্বার্থেই। জঘন্য কুরুচিকর ভাষায় চলে এখনকার প্রচার। কে কত বেশি জঘন্য ভাষা ব্যবহার করতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। এগুলোই কি রাজনীতির পুঁজি? দারিদ্র মোচনের রাস্তা এখন ভাতা দেওয়ায়? মানুষকে মানুষ মনে না করে ভিক্ষুক কিংবা দাসে পরিণত করা?
এসবের পরেও প্রশ্ন থেকেই যায়। লোকতন্ত্র-গণতন্ত্রের দেশে মানুষ কি এটাই চায়? সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা কি সত্যিই গণতন্ত্রে প্রতিফলিত হচ্ছে? একটা বড় জিজ্ঞাসা আমাদের মনে উকি-ঝুঁকি মারে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভোটদান, ভোট দেবে মানুষ স্বাধীন ভাবে, মতপ্রকাশ করবে ইভিএমে কিংবা ব্যালটে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক বিষয় নিয়েই দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি প্রশ্ন তুলছে। এতেই বোঝা যায়, গণতন্ত্রের প্রয়োগই এখন প্রশ্নের মুখে। গণতন্ত্র ও নির্বাচন এখন শুধুমাত্র লোকদেখানো একটা প্রক্রিয়ায় পরিণত হচ্ছে না তো? যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা দখলই এর উদ্দেশ্য নয় তো? উত্তর খুঁজতেই হবে।
সাম্প্রদায়িকতার চরম শত্রু যথার্থ গণতন্ত্র। তার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কি না, আমাদের এখন সে দিকেই বেশি মাত্রায় নজর দেওয়া দরকার।
লেখক স্কুলশিক্ষক, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy