একের পর এক প্রাণ কাড়িয়া লইতেছে যে গুজব, কোন সমাজ তাহাতে বিশ্বাস করিতে পারে? যে সমাজ হোয়াটসঅ্যাপে ভাসিয়া আসা খবরে বিশ্বাস করিয়া গণপ্রহারে হত্যা করিতে পারে কোনও অপরিচিতকে, তাহার চরিত্রলক্ষণগুলি ঠিক কী? হায়দরাবাদে নিহত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মহম্মদ আজ়ম-এর মৃত্যু ফের এই প্রশ্নগুলির সম্মুখীন করিল ভারতকে। দেশ জুড়িয়া যে মৃত্যুমিছিল চলিতেছে, মহম্মদ আজ়ম ও তাঁহার বন্ধুরা সেই তালিকায় ব্যতিক্রমী। তাঁহারা দরিদ্র নহেন, ভবঘুরে নহেন, মানসিক ভারসাম্যহীন নহেন, বহুজাতিক সংস্থার সুপ্রতিষ্ঠিত কর্মী। অর্থাৎ, ছেলেধরা সন্দেহে মানুষ যে ‘অপর’কে ভয় পায়, মহম্মদ আজ়মরা দৃশ্যত সেই অপর ছিলেন না। তবুও, তাঁহারা আক্রান্ত। অর্থাৎ, হিংস্রতা শুধু শ্রেণি বা বর্গের গণ্ডিতে আবদ্ধ নাই, যে কোনও ‘অচেনা’ মানুষই এখন সন্দেহের কেন্দ্রে থাকিতে পারেন। অন্য ভাবে বলিলে, যে ভৌগোলিক গণ্ডিটুকু পরিচিত, শুধু সেই পরিসরেই মানুষ ‘নিরাপদ’। সেই গণ্ডির পরিধি কতখানি, তাহা সুনির্ধারিত নহে। নিজের রাজ্য, না কি শহর বা গ্রাম, অথবা পাড়ার ক্ষুদ্র গণ্ডি, কতটুকু এলাকায় মানুষ নিরাপদ? ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত হইলে তবেই কি নিরাপত্তা মিলিবে, না কি পরিচিতির বিভিন্ন উপাদানের সমতা মানুষকে নিরাপদ করিতে পারে? পরিচিতির কোন মিল তাহাকে নিরাপত্তা দিবে— ভাষার মিল, ধর্মের, বেশভূষার, আর্থিক অবস্থানের? প্রশ্নগুলির উত্তর অনুমান করা চলে। কিন্তু, একটি সভ্য দেশে এখনও যে এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজিতে হয়, তাহা চরম লজ্জার।
অপরিচিতের প্রতি এই হিংস্রতার কেন্দ্রে আছে একটি ‘লো ট্রাস্ট সোসাইটি’— স্বল্প পারস্পরিক বিশ্বাসভিত্তিক সমাজ। যে সমাজ বিশ্বাস করিতে অক্ষম, অপরিচিতের প্রতি সেই সমাজে কৌতূহল থাকে না, সন্দেহ থাকে। ভারতীয় সমাজ কি এমনই ছিল? দীননাথ বাত্রাদের ইতিহাস কী বলিবে, জানা নাই, কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস বলিতেছে, না। ভারতীয় সমাজের প্রাণকেন্দ্রে ছিল অপরিচিতের প্রতি উন্মুক্ত উদারতা। কখনও ধর্মের ভিত্তিতে, কখনও বর্ণের, কখনও ভাষার ভিত্তিতে সমাজকে বারে বারে দ্বিখণ্ডিত করিবার মাধ্যমে, বারে বারে ‘অপর’ চিহ্নিত করিবার মাধ্যমে সেই উদারতাকে ভারত বিদায় করিয়াছে। নরেন্দ্র মোদীর ভারত দেখিতেছে, অত্যল্প সময়ে কী ভাবে বিভাজনগুলিকে স্পষ্টতর করিয়া তোলা যায়। যে সমাজে নেতারা নিয়ত ‘আমরা-উহারা’র বাঁটোয়ারা করিয়া চলিতেছেন, সেই সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাস থাকিতে পারে না। বিদ্বেষ আর বিশ্বাস সংজ্ঞাগত ভাবেই পরস্পরবিরোধী। তাহাদের সহাবস্থান অসম্ভব।
অবিশ্বাস হইতে হিংস্রতার দিকে লাফটিও সামান্য নহে। কাহারও জন্য দরজা না খোলা এক কথা, আর তাহার উপর চড়াও হইয়া একেবারে প্রাণে মারিয়া দেওয়া আর এক। ছেলেধরা সন্দেহে কাহাকে ধরিলে তাহাকে মারিয়া ফেলাই এখন ভারতের দস্তুর। হিংস্রতা যখন সমাজের মজ্জায় থাকে, তখনই তাহার এমন বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই হিংস্রতা শুধু বাহিরের নহে, অন্দরের। এই হিংস্রতা অভ্যন্তরীণ। মনের যে হিংস্রতা পাকিস্তানের সহিত যুদ্ধ কামনা করে, যে হিংস্রতা পণের দাবিতে বধূকে না খাওয়াইয়া রাখে, যে হিংস্রতা সংখ্যালঘুদের সমানে কোণঠাসা করিতে চাহে, যে হিংস্রতা খাপ-এর অমতে বিবাহ করা যুবকযুবতীকে হত্যা করিয়া গাছে ঝুলাইয়া দেয়, সেই হিংস্রতাই ‘ছেলেধরা’ খুঁজিয়া পিটাইয়া মারিয়া ফেলে। সর্বাপেক্ষা দুঃখের, রাষ্ট্র এই হিংস্রতাকে এক প্রকার মান্যতা দিয়াছে। বিচ্ছিন্নতা আর বিভাজনের সহিত সমাজের অভ্যন্তরীণ হিংস্রতার ভয়াবহ মিশেল শেষ অবধি কত রক্তস্রোতের পর থামিবে, সেই আশঙ্কায় প্রহর গনাই বুঝি সার। এই হিংস্র মৃত্যু উপত্যকাই আপাতত ভারতবাসীর দেশ।