Advertisement
০৭ মে ২০২৪

পথে নামতেই হবে, আর সময় নেই

ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশ বান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকদের একটু বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে। এ জন্য স্বেচ্ছাসেবক চাই। খুব বেশি নয়, আমরা প্রত্যেকে যদি সপ্তাহে অন্তত দু’ঘন্টা সময় এর পিছনে ব্যয় করি তা হলে অনেক কাজ করা যাবে। লিখছেন কাজী নিজামউদ্দিনগ্রেটার এই আন্দোলন বৃথা যায়নি। গ্রেটার ডাকে সাড়া দিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে ১১২ কোটি স্কুলের ছাত্রছাত্রী এই আন্দোলনে সামিল হয়।

গ্রেটা থানবার্গ। ফাইল ছবি

গ্রেটা থানবার্গ। ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৯ ০১:৪৪
Share: Save:

গ্রেটা থানবার্গ। সুইডেনের মেয়ে। বয়স ১৫ বছর। দু’সপ্তাহ ধরে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। স্কুলের যাওয়ার বদলে প্রতি দিন সে দেশের পার্লামেন্টের সামনে, পাথরের পথের উপরে চুপচাপ বসে থাকত। না, স্কুলের কোনও সমস্যা নয়। তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল, চলতি গ্রীষ্মে সুইডেনের তাপমাত্রা। সে দেশের ২৬২ বছর ধরে রাখা তথ্য ভাণ্ডার বলছে এমন গরম ও দেশে আগে পড়েনি। তীব্র গরম থেকে সে দেশে দাবদাহ শুরু হয়ে যায়। গ্রেটার দাবি ছিল, রাজনৈতিক নেতাদের এ বিষয়ে দ্রুত সক্রিয় হতে হবে। চুপচাপ বসে থেকে সে একটি লিফলেট বিলি করত। তাতে লেখা ছিল, ‘আই অ্যাম ডুইং দিস বিকজ় ইউ অ্যাডালটস আর শিটিং অন মাই ফিউচার’। কড়া কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যও। বড়দের দিকে সরাসরি আঙুল তুলে গ্রেটা জরুরি কাজটা করেছে।

গ্রেটার এই আন্দোলন বৃথা যায়নি। গ্রেটার ডাকে সাড়া দিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে ১১২ কোটি স্কুলের ছাত্রছাত্রী এই আন্দোলনে সামিল হয়। এর পরে গ্রেটার আন্দোলনকে রাষ্ট্রসঙ্ঘ মান্যতা দেয়। গ্রেটাকে আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তনের সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। গ্রেটার বক্তব্য সারা বিশ্বের বিবেক নাড়িয়ে দেয়। গ্রেটার অনুগামী ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বজুড়ে ‘ফ্রাইডে ফর ফিউচার’ পালন করে আসছে। কয়েক সপ্তাহ আগে হয়ে গেল ৪৬তম ফ্রাইডে ফর ফিউচার। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ধর্মঘট। বিশ্বজুড়ে একে ‘গ্রেটা এফেক্ট’ বলছেন পরিবেশ কর্মীরা। শিল্পমহলেও গ্রেটার এই আন্দোলনে চিন্তার ছাপ ফেলেছে। ‘অর্গানাইজেশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কানট্রিজ়’ (ওপেক)-এর মতে, এই আন্দোলন জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবসার কাঁটা হয়ে উঠতে পারে।

বিজ্ঞানীরা, যাঁরা এত দিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করে আসছেন, তাঁদের কথা এত দিন সে ভাবে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়নি। এ বার তাঁরাও সরব হয়েছেন। তাঁরা কোনও রাখঢাক না করেই জানিয়ে দিয়েছেন, ২০৩০ সাল পর্যন্ত আমরা সময় পাব। এর মধ্যে রাষ্ট্র, সাধারণ মানুষ, ছাত্রছাত্রী— সকলে মিলে কাজ করে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করতে হবে। অন্যথায় কী হবে কিছুই বলা যায় না!

যে ভাবে লাগাম ছাড়া হয়ে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করছি, যে ভাবে বনভূমি ধ্বংস করছি, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য যে ভাবে নষ্ট করছি, তাতে মানব সভ্যতা, এমনকি, পৃথিবীও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার, কীটনাশক ও কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য সমুদ্রের জলে মিশে যাওয়া, উপকারী ব্যাক্টেরিয়া যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে মানুষ ও অন্যান্য জীবের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। বেড়ে যাবে নানা মারণ রোগের প্রকোপ। আর বায়ুদূষণ অত্যন্ত ভয়াবহ আকার নিতে চলেছে। অত্যন্ত আশার কথা যে, আমাদের দেশে বৃক্ষরোপণের হার কিছুটা হলেও বেড়েছে। বৃক্ষনিধনের হারও কমেছে। তবে তা এখনও যথেষ্ট নয়।

তবে গ্রেটা একা নয়। যে যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া... প্লাস্টিক ও সমুদ্রতট দূষণ রোধে মুম্বইয়ের আফরোজ শাহ এবং কেরালার মুন্নার-এর অপর্ণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। আফরোজ মুম্বইয়ের ভারসোবা বিচ প্লাস্টিক মুক্ত করে ফেলেছেন। আফরোজ-এর এই কাজে সহায়তা করেছেন অমিতাভ বচ্চনের মতো ব্যক্তিত্বরা। অপর্ণা তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে মুন্নারের লেক থেকে প্লাস্টিক বোতলগুলি উদ্ধার করে তা দিয়ে ঘর সাজানোর জিনিস তৈরি করে বিক্রি করছেন এবং উপার্জিত অর্থ দিয়ে গাছ লাগানোর, বাঁচানোর কাজ করছেন।

আমাদের রাজ্যে ছাত্রছাত্রীরা এখনও এ কাজে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। তবে ছোট করে হলেও দুর্গাপুরের মতো শহরে কাজ শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগে বেশ কয়েকটি স্কুল এক সঙ্গে বৃক্ষরোপণ এবং এলাকার বাজারে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর জন্য সচেতনতার প্রচার করেছে। কিন্তু এখনও কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেনি। দোষটা তাঁদের নয়। কলেজের শিক্ষকদের এই সচেতনতার কাজে এগিয়ে আসতে হবে। গ্রেটা এবং তার ‘ফ্রাইডে ফর ফিউচার’ দল আগামী ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বজুড়ে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। সব ছাত্রছাত্রীদের এই আন্দোলনে সামিল করতে না পারলে পরিবেশ কর্মী হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে আমরা ব্যর্থ। প্রতিটি স্কুল, কলেজে ‘গ্রিন ভলেন্টিয়ার্স’ তৈরি হোক। ছাত্রছাত্রীরাই এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিক। আমরা তাদের সহযোদ্ধা হয়ে এই লড়াইয়ে সামিল হতে চাই।

রাজনৈতিক দলগুলিকেও সচেতন হতে হবে। কারণ, আশপাশে তাকিয়ে দেখুন। শ্রাবণ শুরু হয়ে গিয়েছে, কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে বিপুল বৃষ্টির ঘাটতি রয়েছে। কিছু দিন আগে চেন্নাই-এর জলসঙ্কট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কেন পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ পানীয় জল নিয়ে হবে বলে শোনা যায়। আসলে পরিবেশকে মূল রাজনীতির আঙিনায় নিয়ে না আসতে পারলে, ভোটের ইস্যু করে তুলতে না পারলে রাজনৈতিক দলগুলি এ নিয়ে চর্চা করবে না। পাশাপাশি, শিল্পক্ষেত্রকে সচেতন হতে হবে। শিল্পক্ষেত্রে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন আছে। কিন্তু সেই আইন ঠিক ভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না সে দিকে নজর রাখতে হবে। আইন যেন সবার ক্ষেত্রে একই ভাবে প্রয়োগ করা হয় সে দিকে নজর রাখা দরকার। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এর জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। শুধু সচেতনতার প্রচারে কাজ হবে না। জনবহুল বাজার এলাকায় প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি। ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশ বান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকদের একটু বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে। এ জন্য স্বেচ্ছাসেবক চাই। খুব বেশি নয়, আমরা প্রত্যেকে যদি সপ্তাহে অন্তত দু’ঘন্টা সময় এর পিছনে ব্যয় করি তা হলে অনেক কাজ করা যাবে। চারপাশে আমরা দেখতি পাচ্ছি ভূগর্ভস্থ জল রক্ষার যে আইন রয়েছে তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কী ভাবে কাজ চলছে। এ শহরে দামোদর বেসিনের দিকটায় মাটির নীচে পর্যাপ্ত জল আছে। কিন্তু অজয় বেসিনের দিকে জল অপেক্ষাকৃত কম। প্রশাসন কিন্তু এখনও নির্বিকার। বেঙ্গালুরু এবং চেন্নাইয়ে জলসঙ্কটের সময় আমরা জল-মাফিয়াদের কথা জেনেছি। তাই জল বাঁচাতে এবং জলের গুণগত মান বজায় রাখতেও চাই সচেতনতা। সময় কম। নয়তো পরবর্তী প্রজন্ম গ্রেটার মতো আমাদের দিকে আবার আঙুল তুলবে।

বিজড়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE