তখনও চলছে সংঘর্ষ। ছবি: রয়টার্স
মনে হচ্ছে, পথ হারিয়ে ফেলছি আমরা। কোনও এক গোলোকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছি, বা অন্ধগলিতে ঘুরে মরছি, রক্তাক্ত হচ্ছি। কিছুতেই বাইরে বেরনোর পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
উপত্যকায় রক্ত ঝরছে না, এমন একটা দিন খুঁজে বার করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় রোজ হিংসার খবর। সীমান্তে বা নিয়ন্ত্রণরেখায় তীব্র গোলাগুলি অথবা জঙ্গি অনুপ্রবেশের চেষ্টা অথবা সন্ত্রাসবাদী হামলা অথবা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয়দের একাংশের সংঘর্ষ।
দেশের বর্তমান শাসকরা সম্ভবত মনে করেন, উপত্যকার পরিস্থিতি কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। পূর্বতন মন্ত্রিসভাকে নরমে-গরমে চেষ্টা চালাতে দেখা গিয়েছিল। তাতে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল, তেমন মোটেই নয়। তাই নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ যখন কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়ে কঠোর পন্থা অবলম্বনের ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছিলেন, তখন সমালোচনা বা বিরোধিতা করার অবকাশ কমই ছিল। কিন্তু রাজনাথ সিংহরাও তো মসনদে চার বছর কাটিয়ে ফেললেন। প্রায় গোটা সময়কালটাতেই বজ্রমুষ্টিতে উপত্যকা শান্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। কিন্তু প্রায় গোটা সময়কালটা জুড়েই উপত্যকা আগের চেয়েও বেশি উত্তপ্ত হয়ে রইল। মোদী-রাজনাথদের কাশ্মীর নীতিকে এর পরেও প্রশ্নাতীত বলা যাবে কী ভাবে?
সীমান্তে বা নিয়ন্ত্রণরেখায় নজরদারি আগের চেয়েও কঠোর হয়েছে। ও পার থেকে গোলাগুলি এলে কয়েক গুণ তীব্রতায় এ পার থেকে জবাব দেওয়া হচ্ছে। সীমান্তে বা নিয়্ন্ত্রণরেখায় জঙ্গি-মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। উপত্যকায় সন্ত্রাস দমন অভিযান তীব্র হয়েছে। সরকারের এই পন্থা জঙ্গি সংগঠনগুলিকে ধাক্কা দিতে পারেনি একেবারেই, সে কথা বলা যাবে না। কিন্তু জঙ্গি সংগঠনকে জব্দ করার ভঙ্গিটা বোধ হয় বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আর প্রশাসনের মুখটাকে বেপরোয়া বা নির্মম দেখালে, অত্যন্ত দ্রুত বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে বাধ্য। উপত্যকা কি তেমনই কোনও প্রতিক্রিয়ায় আঁচে পুড়ছে রোজ? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জবাব খোঁজার চেষ্টা করা উচিত সরকারের।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে উপত্যকায় সন্ত্রাস দমন অভিযানে যত জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে, তা আগের জমানার তুলনায় অনেকটাই বেশি। জঙ্গিমৃত্যুর সংখ্যাটাকে নিরাপত্তা বাহিনীর তথা প্রশাসনের সাফল্য হিসেবেই তুলে ধরা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। কিন্তু সে প্রক্রিয়ায় উপত্যকার গোটা প্রেক্ষাপটটা বিরূপ হয়ে উঠছে না তো? সে কথা কিন্তু খেয়াল রাখতেই হবে। কারণ লক্ষণগুলো খুব ইতিবাচক নয়।
খুব বড় জঙ্গি নাশকতার পরিকল্পনাগুলো হয়তো রুখে দিতে পারছে বাহিনী অনেক ক্ষেত্রেই। কিন্তু ছোটখাটো অসংখ্য হামলা হচ্ছে। গত চার দিনে অন্তত ১০টি গ্রেনেড হামলা হয়েছে বলে খবর। বাহিনীর কনভয় দেখলেই পাথর ছোড়ার প্রবণতা বাড়ছে। লুকিয়ে থাকা জঙ্গিদের ধরতে নিরাপত্তা বাহিনী কোনও এলাকায় অভিযান চালালেই, পথে নেমে পড়ছে স্থানীয়দের একাংশ। তাঁরা বাহিনীর পথ আটকাচ্ছেন, জঙ্গিদের পালানোর পথ করে দিচ্ছেন।
এর অর্থ কী? এর অর্থ হল, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আগ্নেয়াস্ত্র কিয়ৎ দুর্বল হয়ে গিয়ে থাকতে পারে উপত্যকায়। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীরা, এমনকী জঙ্গিরাও, কোথাও কোথাও সহানুভূতি আদায় করে নিতে পারছে। উপত্যকার গোটা প্রেক্ষাপটটাকেই নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য প্রতিকূল করে তোলার চেষ্টা আগের চেয়েও বোধ হয় সফল ভাবে চালাচ্ছে সন্ত্রাসবাদীরা।
আরও পড়ুন: কাশ্মীরের শোপিয়ানে গ্রেনেড হামলায় জখম ১৬, দায় নিল জৈশ
আরও পড়ুন: অশান্ত কাশ্মীরে ফের অভিযানের ভাবনা
রমজানে উপত্যকার অন্দরে অভিযান বন্ধ থাকবে— সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সাধু। উপত্যকাবাসীকে একাত্মতার বার্তা দিতে এই সিদ্ধান্ত খুব জরুরি ছিল। কিন্তু সরকারের এই সাধু পদক্ষেপেও লাভ কিছু হয়েছে বলে কিন্তু মনে হচ্ছে না। অভিযান বন্ধ রাখার যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, তাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে তৎপর জঙ্গিরা। কিন্তু সন্ত্রাসের সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে খুব দৃঢ় কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হচ্ছে উপত্যকায়, এমনও তো নয়। রমজানের মধ্যে জঙ্গিপনা কেন— উপত্যকায় এ প্রশ্ন খুব জোরালো ভাবে তোলার জন্য বিপুল সংখ্যক নাগরিককে যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, তেমন নয়।
সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সংশয় নেই। যে কোনও সরকারই শান্তি তথা আইন-শৃঙ্খলা বহাল রাখতেই চায়। কিন্তু যে পথে উপত্যকায় শান্তি ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছে, সে পথ ঠিক কি না, তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে। আবার বলছি, যে কোনও সঙ্কটেই আলোচনা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। আলোচনা হল ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সংযোগের তথা আদান-প্রদানের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম। উপত্যকায় আলোচনার দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হওয়া কাম্য নয়। কথা হওয়া জরুরি। কথা বলার জন্য যে দরজা-জানালাগুলো রয়েছে, সেগুলো খোলা রাখার ব্যবস্থা করা জরুরি। নরেন্দ্র মোদী বা রাজনাথ সিংহকে সে কথাটা বুঝতেই হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy