Advertisement
০৮ মে ২০২৪
বাঁকা পথের সহজ পাঠ

গণ-আন্দোলনে নয়, নৈরাজ্য সৃষ্টিতেই উৎসাহ বিজেপির

সেই নিনাদ বিচলিত করেছে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনকেও। তাই আর পাঁচ জন যেটা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে বা বলার চেষ্টা করে, সেটাই সরাসরি উচ্চারণ করে বাঙালির শুভবুদ্ধিকে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘জয় শ্রীরাম’ বাংলার সংস্কৃতি নয়।

অশান্তিপর্ব: রাজ্যে নির্বাচন-পরবর্তী হিংসার প্রতিবাদে বিজেপির লালবাজার অভিযান, কলকাতা ১২ জুন।

অশান্তিপর্ব: রাজ্যে নির্বাচন-পরবর্তী হিংসার প্রতিবাদে বিজেপির লালবাজার অভিযান, কলকাতা ১২ জুন।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৯ ০০:৪৮
Share: Save:

রাম-ধোলাই, রাম-ধাক্কা ইত্যাদি শব্দবন্ধের সঙ্গে বাঙালি বেশ পরিচিত। এই সব ‘রাম’-এর সঙ্গে কৌশল্যানন্দনের কোনও সম্পর্ক আছে কি না, তা পণ্ডিতেরা বলতে পারবেন। তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে, এ ক্ষেত্রেও রাম বলতে সর্বোত্তম। অর্থাৎ, রাম-ধোলাই মানে সবচেয়ে ‘উৎকৃষ্ট’ মানের পিটুনি। ইদানীং বাংলার রাজনীতিতে উত্তর-ভারতীয় ভাবধারার আমদানি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য রাম-ধোলাই ভক্তিরসে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। এতে রামের ‘শ্রী’ বৃদ্ধি তো আছেই, অনুষঙ্গে তাঁর নামে সবল জয়ধ্বনিও বিষয়টিকে বেশ ওজনদার করে তুলতে পেরেছে। পিটুনির আগে তাই ‘জয় শ্রীরাম’ শোনা যায়।

সেই নিনাদ বিচলিত করেছে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনকেও। তাই আর পাঁচ জন যেটা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে বা বলার চেষ্টা করে, সেটাই সরাসরি উচ্চারণ করে বাঙালির শুভবুদ্ধিকে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘জয় শ্রীরাম’ বাংলার সংস্কৃতি নয়। এটা এখন প্রহারের মন্ত্র। তাঁর কথায়, ‘‘লোককে প্রহার করতে হলে এখন এ সব বলা হচ্ছে।’’

অমর্ত্য কিছু বললে তার প্রতিক্রিয়া প্রায়শই সুদূরপ্রসারী হয়। যেমন এখন হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিজেপির চার পয়সার নেতারাও আবার অমর্ত্য সেনের ইতিহাসের জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন! তিনি বিদেশে থেকে বাংলার সংস্কৃতি ও বাস্তব সম্পর্কে কী জানেন, সেই জবাবদিহি চাইতে গলায় পদ্মখচিত চাদর ঝুলিয়ে নেমে পড়েছেন অল্প দিন আগে ওই দলে যোগ দেওয়া নব্য নেতা। এমনকি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন কেন নিজের বিষয়ের বাইরে কথা বলবেন, কেউ কেউ তা নিয়েও যথেষ্ট ভাবিত ও ক্ষুব্ধ!

কিন্তু যত যা-ই হোক, বিজেপি যে তাদের ‘রাম-অস্ত্র’ ছাড়বে না, তা নিয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই। যদিও এটা ঘটনা যে, তাদের এই রাজনীতির সঙ্গে মানুষের জীবনের কোনও যোগ নেই। কারও ‘জয় শ্রীরাম’ বলা-না-বলার সঙ্গে জীবন-জীবিকা, জমির অধিকার, পেটের ভাত, পরনের কাপড়, চিকিৎসা বা মাথা গোঁজার ছাদ কিছুই নির্ভর করে না। বড়জোর মার খেয়ে মরার খানিক পরিসর তৈরি হয়।

তথাপি এই বিষয়টিকে সামনে আনার সুবাদে পদ্মাশ্রয়ীরা অন্তত এটা বুঝিয়ে দিতে পারছেন, এই মুহূর্তে সাধারণ জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনও রাজনৈতিক কার্যক্রম তাঁদের সামনে নেই। যা আছে, তা হল যে কোনও উপায়ে সামাজিক নৈরাজ্যের আবহ সৃষ্টি করা। যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অজুহাতে কেন্দ্র অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাতে বল তুলে দেওয়া সহজ হয়। বিজেপি নেতাদের নানা মন্তব্য ও প্রকাশ্য হুমকিতেও এটা স্পষ্ট।

লোকসভায় যথেষ্ট ভাল ফল করলেও রাজ্যে এখনও উল্লেখযোগ্য গণ-আন্দোলন এই দল গড়ে তুলতে পারেনি। বস্তুত রাজ্যে বিজেপির এই নির্বাচনী ফল কতটা তাদের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত জনমত, আর কতটা তৃণমূলের বিরুদ্ধে— সেই বিচারও উপেক্ষণীয় নয়। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, তৃণমূলের নিজেদের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে একটি বড় ক্ষোভের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বিরোধী শিবিরে সিপিএম ও কংগ্রেসের শূন্যস্থান ভরানোর জায়গায় উঠে-আসা বিজেপি সহজে তার সুফল পেয়েছে। এটা মূলত নেতিবাচক সমর্থন। এর জন্য বিজেপিকে রোজ পথে নেমে ঘাম-ঝরানো আন্দোলন করতে হয়নি। শাসক সিপিএমের বিরুদ্ধে বিরোধী মমতাকে যেমন করতে হয়েছিল। বিজেপির কাছে এই নির্বাচনী ফল খানিকটা পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো। এই ভোট ধরে রাখার সম্ভাবনা নিয়েও তাই সঙ্গত কারণেই বহু মত রয়েছে। তবে সাধারণ ভাবে বিরোধীদের সমর্থনের ভিত মজবুত রাখতে গেলে জনস্বার্থের আন্দোলন একটি বড় অস্ত্র।

এটা ঠিক যে, লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপি ১৮টি আসন পেয়ে যাওয়ার ফলে বহু হিসেবনিকেশই গুলিয়ে গিয়েছে। সঠিক ভাবে বললে, এই ঝাপ্টায় তৃণমূল অনেকটা দিশেহারা। দুর্বল শরীরে একের পর এক রোগ বাসা বাঁধার সুযোগ পায়। তারও লক্ষণ স্পষ্ট। তৃণমূলের অন্দরে তোলপাড়। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, জনবিচ্ছিন্নতার মতো বিষয়ে পারস্পরিক দোষারোপ, দলের ‘মনোবল’ ফেরাতে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগ, দলকে পুরনো ‘সংগ্রামী’ চেহারায় ফিরে যেতে তাঁর নিদান, এমনকি শাসক দলের শিবিরে ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোরের আবির্ভাব— সব কিছু মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে, ‘অল ইজ় নট ওয়েল!’ আগামী বিধানসভার দিকে লক্ষ্য রেখে এই অবস্থা তারা কাটিয়ে উঠতে পারবে কি না, পারলে কী ভাবে, তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। ভবিষ্যৎ জবাব দেবে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে বিজেপি যে মুখচ্ছবি দেখাচ্ছে, সেটাই বা কী! বিরোধীরা সরকারকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করবে, জনস্বার্থে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তৈরি করবে, তার মাধ্যমে জনমত সংগঠিত করার চেষ্টা করবে। এমনকি সংঘাতও হবে। এগুলি স্বাভাবিক। এর ফল পাওয়াও সাধারণত সময়সাপেক্ষ। কিন্তু বিরোধী রাজনীতি এ ভাবেই পরিপুষ্ট হয়। এতেই ভোট আসে। রাতারাতি ‘সরকার ফেলব’ বলে লাফালেই সরকার পড়ে না। অন্তত সোজা পথে সেটা করা বেশ কঠিন। যদিও বিজেপির কার্যকলাপে মনে হচ্ছে, তারা বোধ হয় সোজা পথের ধাঁধায় না গিয়ে বাঁকা পথে চলতেই বেশি আগ্রহী!

‘জয় শ্রীরাম’ সেই বাঁকা পথের সহজতম পাঠ। গত দু’তিন বছর ধরে এই রাজ্যে রাম-রাজনীতি আমদানি করতে বিজেপি যে খুব অসফল হয়েছে, তা বলা যাবে না। কারণ আমরা দেখেছি, তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে তৃণমূলকেও একই কাজে নামতে হয়েছে। গত কয়েক বছর জেলাগুলিতে রাম নবমীর বাড়বাড়ন্ত এর বড় উদাহরণ। মমতা পর্যন্ত এখন সভায় দাঁড়িয়ে ‘হিন্দুত্ব’ জাহির করেন। বঙ্গে এ সব ‘রঙ্গ’ আগে ছিল না। এখন আবার বিজেপির মুখে ‘রাম’ নাম শুনে মমতা ক্ষিপ্ত হচ্ছেন বুঝে তারাও সুকৌশলে মাত্রা চড়িয়েছে। উদ্দেশ্য, উত্তাপ বাড়ানো।

এ তো একটি দিক। ইদানীং আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে রাম-বাহিনীর আগ্রাসী আক্রমণ। কাউকে জোর করে ‘জয় শ্রীরাম’ বলানো এবং না বলতে চাইলে ফেলে মারার প্রবণতা। পুরাণের রাম এই বাংলায় সর্বজনপূজ্য ‘গণদেবতা’ হয়ে উঠতে পারেননি— এই চিরাচরিত সত্য ভুলিয়ে দেওয়ার জুলুম তো আর রাজনীতি হতে পারে না। কিন্তু এর ফলে যে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়, সেটা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে আঙুল তুলে দিতে পারে। যার দায় হবে রাজ্য প্রশাসনের। এটা ভেবেচিন্তেই করা।

বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ যে ভাবে পুলিশকে আক্রমণ করার জন্য প্রকাশ্যে প্ররোচনা দিচ্ছেন, কাটমানি আদায়ের জন্য মানুষকে মারমুখী হতে উৎসাহ জোগাচ্ছেন, তার পিছনেও একই কৌশল কাজ করছে। তাঁর দলের এক যুবনেতা তো সে দিন প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন, তৃণমূলের ২১ জুলাইয়ের সভায় আসার জন্য জেলা থেকে যে সব বাস আসবে, তাতে চড়াও হয়ে ‘জনগণ’ কাটমানির টাকা ফেরত চাইবে। সত্যিই যদি তাঁরা এটা করতে চান, তা হলে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে, ভেবে শিউরে উঠতে হয়।

অথচ তাঁরা এ সব নির্বিবাদে বলতে পারছেন। কারণ তাঁরা জানেন, অমিত শাহ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে মমতার রাজ্যকে তিনি রেয়াত করবেন না! সস্তায় কিস্তিমাত করার এ এক ‘সুবর্ণ সুযোগ’।

পুনশ্চ: মুকুল রায় জানিয়ে রেখেছেন, সংসদের অধিবেশন শেষ হলেই কেন্দ্রের নখদাঁত দেখা যাবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE