১৪ জানুয়ারি, ১৯৪৯। ভোর থেকেই কলকাতার মানুষ ময়দানের পথে। রেডিয়োতে ধারাবিবরণী চলছে। স্বাধীনতার পরে এত বড় আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান এ শহরে প্রথম। প্রতিবেশী সব দেশ তো বটেই, প্রতিনিধি এসেছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকেও।
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিশেষ বিমানে আগের রাতেই শহরে এসে পৌঁছেছেন। কলকাতা বন্দরে ‘এইচএমআইএস তির’ কলম্বো থেকে এসে নোঙর ফেলেছে। ‘তির’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত যুদ্ধজাহাজ হলেও সে আজ শান্তির দূত। কারণ সে বয়ে এনেছে ক্ষত্রিয় সিদ্ধার্থের দুই প্রিয় ব্রাহ্মণ অন্ত্যেবাসী অর্হন সারিপুত্ত এবং মোগ্গল্লানের পূত দেহাবশেষ, প্রায় শতবর্ষ পূর্বে ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার কানিংহাম যা সাঁচি থেকে সংগ্রহ করে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়মে চালান করেন। অবশেষে মহাবোধি সোসাইটি এবং তার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে সেই পূত দেহাবশেষের স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন। ১৩ তারিখ রাতে জন্মভূমিতে পৌঁছনো পূত স্মারকের আচ্ছাদিত স্বর্ণপেটিকার স্থান হয়েছিল রাজভবনের দরবার হলে। ১৪ তারিখ সকালে পেটিকা সহ শোভাযাত্রার শুরু। রাজভবন থেকে ময়দানের সভাস্থল এক মাইল। সে-দিনের ওই বর্ণময় শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন রাজ্যপাল কৈলাসনাথ কাটজু, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, এবং তাঁর ক্যাবিনেটের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। পা মিলিয়েছিলেন নানা দেশের কয়েকশো বৌদ্ধ ভিক্ষুও।
নেহরুর ধূসর অচকনে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্রের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে লাগানো হলুদ গোলাপ। সভার মূল উদ্যোক্তা শ্যামাপ্রসাদ অন্য দিনের মতোই পরেছেন সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। পায়ে চটিও নেই। এই শ্রদ্ধার পরম্পরা তাঁর রক্তে। কয়েক বছর আগে পিতা স্যর আশুতোষও জুতো খুলে কলকাতার রাজপথে হেঁটেছিলেন বুদ্ধের পূত দেহাবশেষ গ্রহণ করে। আশুতোষ ছিলেন মহাবোধি সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা অনাগারিক ধর্মপালের অতি প্রিয় মানুষ। আমৃত্যু সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতির পদে ছিলেন তিনি। তাঁর পর সোসাইটির সভাপতি হন শ্যামাপ্রসাদ, তিনিও আমৃত্যু সেই পদেই ছিলেন।
খবরের কাগজের রিপোর্ট অনুসারে সে-দিন ময়দান ছিল জনসমুদ্র। পাঁচ লক্ষ মানুষের সমাবেশ। কুড়ি ফুট উঁচু মঞ্চের উপর ১৯ তোপ ধ্বনির পর জনতাকে সাক্ষী রেখে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু স্বর্ণপেটিকাটি তুলে দিয়েছিলেন বৌদ্ধসভার প্রতিনিধি শ্যামাপ্রসাদের হাতে। ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে যুক্ত হয়েছিল এক নতুন অধ্যায়। সে অধ্যায় এখন বিস্মৃত। শ্যামাপ্রসাদ যে ভারতে বৌদ্ধধর্মের পুনরুত্থানের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, বাঙালিও সে কথা ভুলতে বসেছে। ১৯৪২ সালে শ্যামাপ্রাসাদ মহাবোধি সোসাইটির সভাপতির পদ গ্রহণ করেন। এ কথা শুনলে আজ হয়তো অনেকে অবাক হবেন। কিন্তু সত্য এই যে শ্যামাপ্রসাদ নানা বর্ণে গেঁথেছিলেন তাঁর জীবন, তাঁর রাজনীতি।
কলকাতার সমাবেশের সময় শ্যামাপ্রসাদ দলবিহীন মানুষ। ১৯৪৮-এ তিনি হিন্দু মহাসভার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীন ভারতে হিন্দু মহাসভার দরজা অহিন্দুদের জন্যও খুলে দিতে। তাতে নারাজ ছিলেন মহাসভার অন্যান্য নেতারা। অতএব পদত্যাগ। যে ভাবে দু’বছর পর নেহরু মন্ত্রিসভা থেকেও তিনি বের হয়ে আসবেন পাকিস্তান প্রশ্নে নেহরুর সঙ্গে মতবিরোধের জন্য।
শুধু মহাবোধি সোসাইটি নয়, বৌদ্ধদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। ‘বেঙ্গল বুদ্ধিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা কৃপাসরণ মহাস্থবিরের স্নেহের পাত্র ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৩৪-৩৮) হিসেবে পালি ভাষা প্রসারে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি, স্যর আশুতোষের মতোই। ১৯৪৯ সালে বিহার বিধানসভায় ঐতিহাসিক ‘বোধগয়া টেম্পল অ্যাক্ট’ প্রণয়নেও শ্যামাপ্রসাদের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের বক্তৃতায় প্রায়ই শোনা যায় ‘বুদ্ধ ডিপ্লোম্যাসি’-র কথা। সাত দশক আগে শ্যামাপ্রসাদ সেই কাজই করেছিলেন। লন্ডন থেকে ভারতে আনার আগে প্রায় এক বছর ধরে সারিপুত্ত ও মোগল্লানের পূত দেহাবশেষ শ্রীলঙ্কাতে প্রদর্শিত হয়েছিল। এর পর বাংলা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, অসম, কাশ্মীর প্রভৃতি রাজ্যের পর ভুটান, সিকিম, নেপাল, তিব্বত এবং ব্রহ্মদেশেও তা প্রদর্শিত হয়। ব্রহ্মদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকিন নু স্মারক গ্রহণ করতে ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০ কলকাতা এসেছিলেন। সদ্য-স্বাধীন ব্রহ্মদেশ উদ্বেলিত হয়েছিল পূত দেহাবশেষকে কেন্দ্র করে। আড়াই মাস ব্রহ্মদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে বৌদ্ধ স্মারক ভারতে ফেরে এপ্রিলে।
ব্রহ্মদেশ দীর্ঘ দিন ধরেই আবেদন করছিল ওই পবিত্র স্মারকের একাংশ স্থায়ী ভাবে পেতে। সেই আবেদন পূরণের জন্য শ্যামাপ্রসাদ উদ্যোগী হন। ভারত সরকার ব্রহ্মদেশের আবেদনে সাড়া দিয়ে ওই স্মারকের একাংশ সে দেশকে ‘স্থায়ী ঋণ’ হিসেবে দিতে রাজি হয়। ব্রহ্মদেশের প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে (২৭ নভেম্বর, ১৯৫০) কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শ্যামাপ্রসাদকে লেখেন, “The whole of the Buddhist World, I am sure, would join me in saying ‘Sadhu! Sadhu! Sadhu!’ for the noble gesture and meritorious deed of your good self and the Mahabodhi Society of India.”
’৫১-র ২০ জানুয়ারি কলকাতার রাজভবনে এক অনুষ্ঠানে শ্যামাপ্রাসাদ ও রাজ্যপাল কাটজু ব্রহ্মদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উ উইনের হাতে পূত দেহাবশেষ তুলে দেন। তা সংরক্ষণের জন্য রেঙ্গুনের পার্শ্ববর্তী শ্রীমঙ্গলে নতুন গবা-য়ে (বিশ্ব শান্তি) প্যাগোডা নির্মিত হয়। সেখানে স্থায়ী ভাবে বৌদ্ধ স্মারক স্থাপনের দিন ঠিক হলে থাকিন শ্যামাপ্রসাদকে রেঙ্গুনে আমন্ত্রণ জানান। ৫ মার্চ, ’৫২ স্মারকের অস্থায়ী অবস্থান বোটাটাও প্যাগোডা থেকে পূত স্মারক নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ, থাকিন নু-দের সঙ্গে গবা-য়ে প্যাগোডার পথে পা মেলান। যা আজও ব্রহ্মদেশের গর্বিত ইতিহাসের অঙ্গ।
এই সময় শ্যামাপ্রসাদ বৌদ্ধ-প্রধান তাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম ভ্রমণ করেন। বৌদ্ধহিতৈষী তথা সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে তাঁর অভূতপূর্ব আপ্যায়ন হয়। আজকের প্রেক্ষাপটে শ্যামাপ্রসাদের এই আন্তর্জাতিক, বহুত্ববাদী রূপটি স্মরণীয়।
ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজের সম্পাদক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy