Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শিশু যে স্কুলবাজারের পুঁজি

জেলা শহরগুলোর অলিগলিতে চলছে প্লে-স্কুল। বাড়ির মালিক একতলা চুনকাম করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন। ‘কচিপাতা’, ‘হাসিখুশি’— কাব্যময় নাম লেখা হয় তাতে। ‘টুবিএইচকে’ ফ্ল্যাট হয়ে গেল স্কুল। ভর্তি হল জনা চল্লিশ শিশু।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সন্দীপন নন্দী
শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৬
Share: Save:

ঘরে একটাও জানালা নেই। চারটে ঘুলঘুলির ফাঁক আছে শুধু। তা দিয়ে রোদের ছিটেফোঁটা আসে, তাই সকাল এগারোটাতেই জ্বলছে এলইডি আলো। ভাদ্রের গরমেও লো ভোল্টেজে ঘুরছে একটা ফ্যান। কুড়ি-বাইশটি শিশুর বসার ব্যবস্থা মেঝেতে পাতা গালিচায়। দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘর থেকে আসছে কচি গলার গান, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।’ অথচ কী কুৎসিত ওই ক্লাসঘর।

জেলা শহরগুলোর অলিগলিতে চলছে প্লে-স্কুল। বাড়ির মালিক একতলা চুনকাম করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন। ‘কচিপাতা’, ‘হাসিখুশি’— কাব্যময় নাম লেখা হয় তাতে। ‘টুবিএইচকে’ ফ্ল্যাট হয়ে গেল স্কুল। ভর্তি হল জনা চল্লিশ শিশু। রান্নাঘর হয়ে উঠল লোয়ার কেজির ক্লাসরুম। আর একটু বড় ড্রয়িংরুম হল আপার কেজির ক্লাস। হয়তো প্রত্যুষের অসুবিধে হয় দূরের বোর্ডে লেখা দেখতে, প্রাযুক্তার কানে দিদিমণির সব কথা স্পষ্ট হয়ে আসে না। কিন্তু সে খোঁজ কেউ রাখে না। অভিভাবকরাও জানতে চান না, স্কুলের রেজিস্ট্রেশন আছে কি না। শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী। জানতে চান না, ‘স্কুল’ বলে যাকে দাবি করা হচ্ছে, তার একমাত্র ঘুপচি টয়লেট কতটা স্বাস্থ্যকর।

না, ভাবার সময় পাননি তাঁরা। এই বাবা-মায়েরাই হাইস্কুলে অথবা কলেজে সন্তানকে ভর্তির আগে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন— কোন প্রতিষ্ঠান ভাল, কতটা ভাল, যাচাই করেন। কিন্তু গোড়াতেই একটা নিঃশব্দ বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছে। আমরা ভাবছি, শিশুদের আবার ‘সাইকোলজি’ কী? ওরা তো অবুঝ, নবীন, কাঁচা। ওদের বোধ কম। শেষে কোনও অঘটন ঘটলে স্কুলে শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে টিভি চ্যানেলে বিতর্ক, সমাজমাধ্যমে পোস্ট, মোমমিছিলের ডাক।

অথচ প্লে-স্কুল কেমন হবে, কী থাকবে তাতে, তার নির্দেশিকা তৈরি করেছে জাতীয় শিশু অধিকার রক্ষা কমিশন। কুড়ি জন ছাত্রের জন্য এক জন শিক্ষক দিতে হবে। স্কুলভবনের চার পাশে উঁচু সীমানা প্রাচীর বাঞ্ছনীয়। মেয়ে ও ছেলে শিশুর জন্য পৃথক শৌচালয়। সিসিটিভি এবং আগুন নেভানোর বন্দোবস্ত থাকতেই হবে। ঘরগুলোতে প্রচুর আলোবাতাস আসা চাই। স্কুলে থার্মোমিটার রাখাও বাধ্যতামূলক। সর্বমোট ৯৭টি বিষয় রয়েছে ‘চেকলিস্ট’-এ। স্কুল কর্তৃপক্ষ সব শর্ত পূর্ণ করেছেন, এই অঙ্গীকার করে মুচলেকা দেওয়ার পর সরকারের তরফে অনুসন্ধান করা হবে। এই দায়িত্ব সমাজকল্যাণ দফতরের ‘নিবিড় শিশু উন্নয়ন পরিষেবা’ (ICDS) দফতরের। তত্ত্বাবধান করবেন অবর জেলাশাসক। নির্দেশিকা বলছে, আইসিডিএস-এর নোডাল অফিসার অনুসন্ধানের পরে আবেদনের ভিত্তিতে তাদের ‘প্লে-স্কুল’ হিসেবে রেজিস্ট্রেশন দিতে পারে জেলা প্রশাসন। অনুমোদনপ্রাপ্ত প্লে-স্কুলগুলোর নামের তালিকা প্রতি বছর রাজ্য স্টেট কাউন্সিল থেকে গেজ়েট আকারে প্রকাশ করতে হবে।

তিন থেকে ছয় বছর বয়সি শিশুদের শিক্ষা ও সুরক্ষার জন্য এই নীতি গৃহীত হয়েছিল ২০১৩ সালে। কাজের ক্ষেত্রে দেখা যায়, রেজিস্ট্রেশনের আবেদনও করেন না কর্তৃপক্ষ। জেলা প্রশাসনেরও মাথাব্যথা নেই বেসরকারি প্রাক্-প্রাথমিক স্কুলের হাল-হকিকত নিয়ে। আর প্রশ্ন তুলবেই বা কে? পরীক্ষক কি পাশ করবেন পরীক্ষায়? বছর পাঁচেক আগে আইসিডিএস প্রকল্প নিয়ে সমীক্ষা করায় রাজ্য সরকার। দায়িত্ব দেওয়া হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগকে। ২০১৪ সালের রিপোর্টে শহরের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে শিশুদের পুষ্টির ব্যাপারে উদাসীনতা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্নাবান্না, পানীয় জল ও শৌচাগারের অভাব সামনে এসেছিল। কেন্দ্রগুলি দিনে চার ঘণ্টা খোলা থাকার কথা, অধিকাংশ খোলা থাকে দেড়-দু’ঘণ্টা। দরজা ভেঙে পড়ছে। জানালা নেই। ওজনের যন্ত্রগুলিও বেহাল।

সম্প্রতি রাজ্য সরকার প্রায় ত্রিশ শতাংশ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রকে ‘মডেল’ বা ‘শিশু আলয়’ করে তুলেছে, সেগুলির চেহারা ফিরেছে অনেকটাই। কিন্তু বাস্তব এই যে, সরকারি প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন শহরের অভিভাবকরা। আর্বান অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারে প্রায় সর্বত্র ফাঁকা। উত্তরবঙ্গের একটি জেলায় গ্রামীণ কেন্দ্রে শিশুর গড় সংখ্যা একত্রিশ, শহরের কেন্দ্রে সতেরো। অফিসার ভিজ়িটের খবর পেলে কিছু শিশুকে ডেকে আনেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। মায়েরা কেউ কেউ দুপুরে বাচ্চার বরাদ্দ ডিমটা নিয়ে যান। কিন্তু অঙ্গনওয়াড়ির দিদিমণির হাতে শিশুর শিক্ষার ভার দিতে নারাজ তাঁরা। সাধ্যাতীত খরচ করে, মোটা টাকা ‘ডোনেশন’ দিয়েও তাঁরা শিশুকে পাঠাচ্ছেন ইংরেজি মাধ্যম প্লে-স্কুলে।

কিছু নামীদামি প্লে-স্কুল থাকে মফস্সল শহরগুলোতেও। যেখানে অভিজাত পরিবারের সন্তানরা পড়ে। কী নেই সেখানে— লাইব্রেরি, অডিটোরিয়াম, ফ্রিজ়, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, মডিউলার কিচেন, বাচ্চাদের বাতানুকূল রেস্টরুম, মিনি হসপিটাল। কিন্তু যাদের পয়সায় কুলালো না, সে সব উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বল্পবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য খুলে গেল পাড়ার নকল প্লে-স্কুল। স্কুলের পরিকাঠামো, শিক্ষকের প্রশিক্ষণ থেকে ক্লাসের পঠনপাঠন, কোনও কিছুই শিশুর উপযুক্ত কি না, তা কেউ খোঁজও নিল না। এটাও একটা বাজার, শিশুই যার পুঁজি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Child Education Play School
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE